অনেক দেরিতে হলো, তবু মন্দের ভালো

মাহমুদউল্লাহর যা পারফরম্যান্স, মাঠে দিনের পর দিন তার যে শরীরী ভাষা, তাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2022, 06:32 PM
Updated : 14 Sept 2022, 06:32 PM

বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল ঘোষণার ঘণ্টাখানেক পরে কথা হচ্ছিল সংশ্লিষ্ট একজনের সঙ্গে। টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাদ পড়ার পর মাহমুদউল্লাহর অনুভূতি তিনি জানেন। তার উপলব্ধি, “যা বুঝলাম, রিয়াদ মনে হয় এখনই অবসর নেবে না…।”

এই ৩৬ বছর বয়সে টি-টোয়েন্টি দলে জায়গা হারানোর পর তাকে ঘিরে এই কৌতূহল স্বাভাবিক। পরের বিশ্বকাপ আরও দুই বছর পরে। নতুন ঘরানা ও ধ্যান-ধারণাকে আপ্ত মেনে দল তাকাচ্ছে সামনে। সব বাস্তবতাই বলছে, অতি চমকপ্রদ কিছু না হলে মাহমুদউল্লাহর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের এখানেই সমাপ্তি। সাধারণ্যে তাই তার অবসর সংক্রান্ত আলোচনা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বোর্ডের কারও যখন এই ভাবনা থাকে, তখনই প্রশ্ন উঠে যায় সংস্কৃতিটা নিয়ে। যারা দায়িত্বশীল, তারা কেন কারও অবসরের অপেক্ষায় থাকবেন!

প্রশ্নটা পুরনো, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। মাহমুদউল্লাহর ক্ষেত্রেও সেটা সত্যি। তার অবসরের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই কি বাদ দিতে এত দেরি!

মাহমুদউল্লাহর যা পারফরম্যান্স, তাতে দলে তার জায়গা নড়বড়ে তো বেশ আগে থেকেই। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্ব থেকে এবারের এশিয়া কাপ পর্যন্ত ১৬ ইনিংসে তার কোনো ফিফটি নেই। তার যে ব্যাটিং পজিশন, সেখানে অবশ্য ফিফটি বা ধারাবাহিকতা কিংবা ব্যাটিং গড় খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু যেটা সবচেয়ে জরুরি, সেটিই সবচেয়ে মলিন-স্ট্রাইক রেট।

অবিশ্বাস্যভাবে, এই সময়ে তার স্ট্রাইক রেট ১০১.৫৬। এই সময়ে একটি ইনিংসে তিনি সাতে ব্যাট করেছেন। বাকি সবকটিতে পাঁচ ও ছয়ে। সেখানে ১৫ ইনিংসে তার স্ট্রাইক রেট স্রেফ ১০০। টি-টোয়েন্টিতে যে কোনো মানদণ্ডে, যে কোনো প্রেক্ষাপটে এই স্ট্রাইক রেট কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এই পরিসংখ্যান কতটা বিবর্ণ, একটা নমুনা দেওয়া যেতে পারে। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্ব থেকে এই পর্যন্ত ৫ ও ৬ নম্বরে ১০টির বেশি ইনিংস খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে বাজে স্ট্রাইক রেট মাহমুদউল্লাহরই। আর কারও স্ট্রাইক রেট ১১১-এর নিচে নেই।

এই সময়টায় বাংলাদেশেরই আফিফ হোসেন এই দুই পজিশনে ১১ ইনিংস খেলে রান করেছেন ১২০.৪২ স্ট্রাইক রেটে।

২৫০ বল খেলে এই সময়টায় ২৫০ রান করেছেন মাহমুদউল্লাহ। এই দুই পজিশনে আড়াইশর বেশি বল খেলেছেন আর কেবল শ্রীলঙ্কার দাসুন শানাকা। ৩১৬ বল খেলে তার রান ৪৪৩, স্ট্রাইক রেট ১৪০.৮২!

তবে পরিসংখ্যানই আসলে সবকিছু নয়। তাকে দলের বাইরে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল তার ব্যাটিংয়ের ধরনও।

ব্যাটিংয়ের ধরনের দুটি দিক আছে। একটি হলো সামর্থ্য, আরেকটি তাড়না। মাহমুদউল্লাহ দিনের পর দিন পাশ মার্ক পাচ্ছিলেন না কোনোটিতেই। বয়স তার রিফ্লেক্সে প্রভাব ফেলেছে প্রবলভাবেই। শরীর আর আগের মতো কথা শুনছে না। হয়তো জোর করলেও সাড়া দিচ্ছে না। চোখদুটোও আর আগের মতো তীক্ষ্ণ নয়, হাত দুটি নয় বিশ্বস্ত। সবই জগতের নিয়ম!

তাড়না কিংবা ‘ইন্টেন্ট’ দিয়েও তিনি পুষিয়ে দিতে পারেননি অন্য ঘাটতিগুলো। উইকেটে গিয়েই দ্রুত রান তোলার তাড়া, পরিস্থিতির দাবি মেটানোর তাগিদ, এসব খুব একটা ফুটে ওঠেনি তার ব্যাটিংয়ে।

ব্যাটিংয়ের বাইরে মাঠে তার উপস্থিতি, শরীরী ভাষা, ফিল্ডিংয়ে নিজেকে উপস্থাপনা, সবকিছুই ছিল বেশির ভাগ সময় দৃষ্টিকটূ।

টি-টোয়েন্টিতে তিনি যে জায়গায় ব্যাট করেন, সেখানে নিজের ব্যাটসম্যানশিপ সমৃদ্ধ করার খুব একটা প্রয়াসও দেখা যায়নি তার মধ্যে। ওজন কমিয়ে ঝরঝরে হয়েছেন বটে, কিন্তু বড় শট খেলার মতো পেশির জোর বাড়ানো, কবজির শক্তি বাড়ানোর প্রমাণ দেখা যায়নি। স্কিল হিটিং, উদ্ভাবনী নানা শটে নিজেকে শানিয়ে নেওয়ার ছাপও রাখতে পারেননি।

এখানে দিনেশ কার্তিকের উদাহরণ দেওয়া যায় অনায়াসেই। বয়স মাহমুদউল্লাহর চেয়েও বেশি। কিন্তু ভারতের মতো দেশে, যেখানে মানসম্পন্ন ক্রিকেটারের অভাব নেই এবং বিকল্প অনেক, সেখানেও তিনি এই ৩৭ বছর বয়সে বাধ্য করেছেন তাকে বিশ্বকাপ দলে রাখতে। কিভাবে?

মাহমুদউল্লাহ যে ভূমিকায় খেলেন, অনেকটা সেই ভূমিকায় ভারতীয় দলে ফেরাকে নিজের লক্ষ্য বানিয়েছিলেন কার্তিক। এরপর সেই চাওয়া পূরণের অভিযান শুরু। ফিটনেস নিয়ে ঘাম ঝরিয়ে নিজের পেশি, কাঁধ, কোমরের জোর বাড়িয়েছেন। সঙ্গে স্কিল নিয়ে কাজ করেছেন। ক্রিকেট শটের পাশাপাশি দারুণ সব উদ্ভাবনী শটেও তিনি এখন এলোমেলো করে দেন বোলারকে। নিজেকে তিনি এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন, দল তাকে সাদরে ফিরিয়ে এনেছে আবার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কার্তিকের ব্যস্ততা না থাকায় নিজেকে তৈরি করার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছেন, এটা অবশ্য সত্যি। মাহমুদউল্লাহর জন্য সেই সময়টা একটু কম ছিল। ভারতের মতো জায়গায় ভালো ফিটনেস ট্রেনার, কোচ, ভালো উইকেটসহ আরও অনেক সুযোগ-সুবিধাও কার্তিক পেয়েছেন, মাহমুদউল্লাহ যেখানে অসহায়। কিন্তু যতটুকু তার করার ছিল, ততটুকু কি ঠিকঠাক করতে পেরেছেন?

মাহমুদউল্লাহ যে পারছেন না, তা স্পষ্ট অনেক আগে থেকেই। তবু তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে কিংবা তার ওপর দল ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ সিদ্ধান্তটি হতে পারত গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই!

বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পরই দলের খোলনলচে পাল্টে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া যেত। বাংলাদেশের ক্রিকটে একজন মাহমুদউল্লাহর অবদান অনেক। সেটা শুধু কিছু রান বা সংখ্যায় নয়, সার্বিক অনেক দিক থেকেই। কিন্তু জাতীয় দলে জায়গা কারও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়, এটাও তো চিরন্তন সত্য। তার সঙ্গে একান্তে বসে খোলামেলা কথা বলে, তাকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে সামনে তাকানো যেত তখনই। কিন্তু তা করা হয়নি।

বিশ্বকাপের পরপরই ছিল পাকিস্তান সিরিজ। সেই সিরিজের পরও নতুন করে ভাবা যেত। সেটাও হয়নি।

অবশেষে গত জুলাইয়ে জিম্বাবুয়ে সিরিজে তাকে বিশ্রামে রাখা হয়। নতুন ভাবনার ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু নুরুল হাসান সোহান চোটে পড়ার পর আবার পেছন পানে হেঁটে সেই মাহমুদউল্লাহকেই ফিরিয়ে আনা হয়। অথচ নতুন পথচলা শুরুর সুযোগ ছিল তখনও।

সুযোগটা ছিল এশিয়া কাপের আগেও। করা হয়নি কিছুই।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল বেশ আগেই। তবু দল সামনে না এগিয়ে চেষ্টা করেছে দেয়াল ঠেলে আরও পেছনে হাঁটার।

কিংবা অপেক্ষা চলেছে, তিনি কখন নিজে থেকে সরে যান!

অথচ বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা ভীষণ কঠিন। কজন ক্রিকেটারই বা নিজ থেকে ছাড়তে চান জায়গা! তামিম ইকবাল ছেড়েছেন, এশিয়া কাপ থেকে ফেরার পর মুশফিকুর রহিমও। কিন্তু সংখ্যায় তারা বিরল।

একজন ক্রিকেটার বা অ্যাথলেটের জন্য নিজেকে বোঝানো কঠিন যে, তিনি আর উপযুক্ত নন। তার মাথা এরকম কিছু ভাবলেও হয়তো হৃদয় সায় দেয় না। ভেতরের যে সত্ত্বা, যে অহম, তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আরেকটু চেষ্টা করা, আবার নিজেকে মেলে ধরার নেশা জেঁকে বসে। আরেকবার জবাব দেওয়ার তাড়নার কাছে তখন বাস্তবতা গৌণ হয়ে ওঠে। অনেক কিছুই তার কাছে ধরা পড়ে না।

তখনই সেটা ধরিয়ে দিতে হয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের। উদ্যোগটা তাদেরই নিতে হয়। একজন ক্রিকেটার, একজন অ্যাথলেটের অধিকার আছে অবসর না নেওয়ার, খেলা চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু দল নির্বাচনের দায়িত্ব যাদের, নির্বাচক কমিটি, টিম ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিসিবি সভাপতি, ছোট-বড় যে কোনো সিদ্ধান্তই তাকে ছাড়া প্রায় অসম্ভব, তাদের তো দায়িত্ব দলের স্বার্থ দেখার, দেশের ক্রিকেটের ভালোর জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার। বলতেই হবে, তারা সেটা সময় মতো পারেনি।

অবশেষে বেলা যখন গড়িয়ে গেল অনেক, বিশ্বকাপ চলে এলো দুয়ারে, টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট হয়ে আসা শ্রীধরন শ্রীরাম যখন নাড়া দিলেন, তখন কাটা পড়লেন মাহমুদউল্লাহ। এই সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হলে হয়তো তার বিকল্প কেউ এতদিনে তৈরি হয়ে যেত, কিংবা অন্তত তৈরি হওয়ার পথে থাকত। এখন এই বিশ্বকাপের জন্য সেই সুযোগ সামান্য।

তবে একেবারেই না হওয়ার চেয়ে অবশ্যই দেরিতে হওয়া ভালো। টি-টোয়েন্টিতে মাহমুদউল্লাহর পারফরম্যান্সের যা চিত্র, দলের যা অবস্থা, তাতে যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো সময় পরিবর্তনের পালা শুরু করা যেত।

শ্রীরামের হাত ধরে সেটিই হয়েছে। পরিবর্তনের হাওয়া এবার সত্যিকার অর্থেই লেগেছে। বিসিবির শিক্ষা হয়েছে কিনা, কে জানে!