মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চান একাত্তরে সরব যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা

গত বছর ১৯ জুলাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী ১২ জনকে এক প্রজ্ঞাপনে 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারপর থেকেই স্বীকৃতির দাবি নিয়ে সক্রিয় রয়েছেন বেশ কয়েকজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2022, 10:11 AM
Updated : 5 August 2022, 10:11 AM

একাত্তরে ‘বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখায়’ মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি চান কয়েকজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

গত বছর ১৯ জুলাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী ১২ জনকে এক প্রজ্ঞাপনে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারপর থেকেই স্বীকৃতির দাবি নিয়ে সক্রিয় রয়েছেন বেশ কয়েকজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।

এ বিষয়ে ওয়াশিংটন ডি.সিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম বলেন, “যুক্তরাজ্যের রেফারেন্সে আমরা সরকারকে অনুরোধ জানাতে পারি। তবে তার আগে কংক্রিট একটি তালিকা দরকার।”

সেই তালিকার সন্ধানে যোগাযোগ করা হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে রাজপথে এবং কংগ্রেসে নানা তৎপরতার পাশাপাশি অস্ত্রভর্তি জাহাজ আটকে দেওয়ার মতো দুঃসাহসী কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া কয়েকজন প্রবাসীর সঙ্গে।

ফিলাডেলফিয়ায় নোঙর করা পাকিস্তানি এক জাহাজ অবরোধের পর ভেতরে ঢুকে ১৩ জন নাবিককে নামিয়ে এনেছিলেন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব দেলওয়ারে ভ্যালি’-এর সে সময়ের প্রেসিডেন্ট মাযহারুল হক। সেই নাবিকেরা পরবর্তীতে ফিলাডেলফিয়াতেই বসতি গড়েন।

পেশায় প্রকৌশলী মাযহারুল হক বলেন, “আমরা ফিলাডেলফিয়া ও ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার নানা র‌্যালি-জনসংযোগে অংশ নিয়েছি। সিনেটে কথা বলেছি। আমাদের কর্মসূচির সমর্থনে রাজপথে সরব হয়েছিলেন বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকেরাও। এক পর্যায়ে আমার প্রয়াত স্ত্রী ফরিদা খানম তার সবগুলো শাড়ি দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের। সেসব পরে ওরা বাঙালি হিসেবে র‌্যালিতে অংশ নেন।”

পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযোগ করার স্মৃতিচারণ করে নিউ ইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাসরত আব্দুর রাজ্জাক খান বলেন, “সেসময়ে আইডাহো থেকে নির্বাচিত ইউএস সিনেটর ফ্র্যাঙ্ক চার্চ (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য) আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এতটাই সমর্থক ছিলেন যে এক পর্যায়ে তার অফিস ব্যবহারের সুযোগ দিতেও কুণ্ঠা করেননি। শুধু তাই নয়, এই সিনেটরের চেষ্টায় ১৯৭১ সালে সিনেটে একটি সংশোধনী বিল পাশ হয়েছিল। তারপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাক হায়েনাদের আর কোন অর্থ সহায়তা সম্ভব হয়নি। ”

আব্দুর রাজ্জাক খান আরও জানান, আমার স্ত্রী জাকিয়া খান তখন ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক। তিনিও যোগ দিয়েছিলেন র‌্যালিতে। এটা জেনে কর্তৃপক্ষ তাকে সাবধান করেছিলেন। কিন্তু তাকে দমাতে পারেনি।

নব্বই বছর বয়সী মাযহারুল হক বলন, “সেসময় শিকাগো, বস্টন, লস অ্যাঞ্জেলেস প্রভৃতি স্থানের প্রবাসীরাও নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিধি আরও বিস্তৃত এবং জোরালো করার অভিপ্রায়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি যন্ত্র ক্রয় করেছিলাম। সেটি এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্স বিনা ভাড়ায় কলকাতায় নিয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাছে হস্তান্তর করেছে কিনা নিশ্চিত হতে পারিনি।”

তিনি বলন, “একাত্তরের পহেলা অগাস্ট নিউ ইয়র্কে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ চলাকালে বাইরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে লোকজনের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন মোনায়েম চৌধুরী। সেসব স্মৃতি এখনও ভেসে বেড়ায় অবচেতন মনে।”

রাজ্জাক খান ও মাযহারুল হক আরও বলেন, “আমরা তো কোনকিছুর আশায় ওইসব কর্মসূচির আয়োজন কিংবা অংশ নিইনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যাশা পূরণে দূরদেশ থেকে চেষ্টা করেছি। তাই স্বীকৃতির ধার ধারিনি। দেশের জন্য কিছুটা হলেও করতে পেরেছি এটাই বড় তৃপ্তি। সব সময় গৌরববোধ করি যে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে আমরাও ছিলাম।”

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ফিলাডেলফিয়া অঞ্চলে তৎপরতায় অংশ নেওয়া রওশন আরা বেনু গত সপ্তাহে মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে প্রবাসের মুক্তিযোদ্ধারা তার কফিন জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করে স্যালুট দিয়েছেন। বেনুর জানাজায় অংশ নেওয়া প্রবাসীরাও আহ্বান জানিয়েছেন একাত্তরের সেই সংগঠকদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি দেওয়ার।

গত বছর ১৯ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল যে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা বিশ্ব জনমত গঠনে কাজ করেছেন তারা আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করতে পারবেন।

ফোবানার সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক পুনরায় একই কথা বলেছিলেন। তবে সে আহ্বানে সাড়া দিতে রাজি নন ওইসব বাঙালিরা। এ প্রসঙ্গে তারা জানান, একাত্তরে কে কে এই যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করেছি তার একটি তালিকা অবশ্যই সরকারের কাছে রয়েছে। সেটিইতো বড় প্রমাণ। এটা রাষ্ট্রের দায়, রাষ্ট্র নিজ থেকেও তালিকা করতে পারে। কারণ, এখনও অনেকেই জীবিত রয়েছি এবং স্মৃতি রোমন্থনেও কোন সমস্যা হচ্ছে না।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি চাওয়া যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের দাবির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের প্রেসিডেন্ট মুক্তিযোদ্ধা লাবলু আনসার, সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বারি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার মনসুর ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের মিয়া।