বেলাজিওকে বলা হয় পার্ল অব দ্য লেক কোমো। মোটরশিপ থেকে এ শহরটায় পা ফেলতেই মনে হচ্ছিলো শহরটা আমার অনেক দিনের চেনা।
Published : 14 Aug 2021, 10:25 AM
একপাশে লেকের মনোরম সৌন্দর্য; আরেকপাশে নানা রঙের বাড়ি, সুভ্যেনির শপ, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, অল্প কিছুসংখ্যক টুরিস্টের পদচারণা, সবমিলিয়ে অসাধারণ! আমাদের হোটেল চেকইন আরও বেশকিছু সময় পর। এ সুযোগে দুজন শহরটাকে এক্সপ্লোর করতে লাগলাম। বেশ কিছুটা পথ যাবার পর চোখ আটকে গেলো এক কোবলস্টোনের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এলের দিকে।
আমিতো তাইরে নাইরে না করে উঠতে লাগলাম। আর পেছন থেকে রবির সতর্কতা বাণী আস্তে যাও, ব্যাথা পেওনা যেন! কে শোনে কার কথা! সিঁড়ির দুপাশে জেলাটো শপ, সিল্কের কাপড়ের শপ, ইতালিয়ান কিছু নামিদামি ব্র্যান্ডের শপ। বলে রাখা ভালো, পুরো ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর, মসৃণ ও দামি সিল্ক এখানে তৈরি হয়ে আসছে সেই পনেরশো শতাব্দী থেকে। এ জায়গাটা আসলে বেলাজিও টাউন সেন্টারের অংশ।
উপরে উঠছি তো উঠছি, সিঁড়ি আর শেষ হয় না। যেই মাত্র উঠে এসে লেকের দিকে মুখ করে তাকালাম, আমি আনন্দে চিৎকার করে রবিকে ডাকছি তাড়াতাড়ি উঠে আসার জন্য। উঠেই রবির চোখে মুখে ঝিলিক। আরে এটাতো সেই জায়গা, মিতু! হ্যাঁ রবি সেই জায়গা! আচ্ছা ‘সেই জায়গার’ একটা গল্প আছে। গল্পটা ছোট করে বলেই ফেলি।
লেখক ও তার স্বামী ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান রবি
সে আমাকে বলেছিলো, ‘আমি আমার ডাক্তার বন্ধুকে গিফট করবো। আমি চাই আমার দেওয়া গিফট সে তার চেম্বারে ঝুলিয়ে রাখুক।’ শুনে তো আমার মাথায় হাত! এই আনাড়ি হাতের উপর এতো ভরসা করছে! একটু একটু করে বেশ সময় নিয়ে, খুব যত্ন করে এঁকেছিলাম সেই ছবিটা। গুগল সার্চ করে একটা ছবি পছন্দ করলাম, সেটাই এঁকেছিলাম। তখনও জানতাম না কোন শহরের ছবি আঁকছি।
এক ব্রিটিশ ব্লগারের কোমো বিষয়ক লেখা পড়তে গিয়ে ‘সেই জায়গার’ ছবিটা আবারও চোখে পড়ে। কিন্তু লেক কোমোর কোন শহরের ছবি এটা ঠাওর করতে পারিনি। সেদিন যখন চোখের সামনে এ ভিউটা দেখতে পেলাম, আমি আমার আনন্দ ধরে রাখতে পারিনি। শুধু রবিকে বলছি, ‘এই যে সেই চেয়ার টেবিল যেটা দেখে তুমি বলেছিলে টেবিলটা ভালো হয়নি, আরেকটু পলিশ করো। ওই যে দূরের পাহাড়, যেটা দেখে তুমি বলেছিলে যেন পাহাড়ের গায়ে আলো আধারের শেডটা বোঝা যায়। এইতো দেখো এই সেই স্টোনের রাস্তা!’
তবে হ্যাঁ, এখানে আসার পর আমি আমার আঁকা ছবিটার অনেক ভুলত্রুটি ধরতে পেরেছিলাম।
ভিলার গার্ডেনে ঢুকতেই মনে হয়েছে, সবকিছু ছবির মতো এতো পরিপাটি করে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়! ব্যক্তিগত চ্যাপেল, বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাচু, জাপানি গার্ডেন, বাহারি ফুলের গাছ যেমন- ক্যামেলিয়া, আজালিয়া, রোডোডেন্ড্রন থেকে শুরু করে কি নেই এখানে! ভিলার সামনের ট্যারেস থেকে লেকের দৃশ্য, সুবিশাল গাছের সারি, পাখির কিচিরমিচির সবমিলিয়ে অন্য এক পৃথিবী।
এখানে আসার আগে প্রতিটা ভিলার ওপেনিং ক্লোজিং আওয়ারগুলো চেক করার সময় দেখলাম, এই গার্ডেন দুপুর ১২টায় ওপেন হয়। মনে মনে একটু মেজাজ খারাপ হয়েছিলো। এতো দেরিতে খোলার কি আছে? এখানে এসে বুঝলাম, তাদের প্রতিটা কাজ খুব সিস্টেমেটিক। প্রতিদিন, প্রতিটা মুহূর্ত একই রকম রাখতে হলে এর পরিচর্যাটাও তেমন করতে হয়। রাস্তায় একটা পাতা পড়লেও সেটা ক্লিন করে টিপটপ করে রাখছে সঙ্গে সঙ্গেই। গাছের নিচে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিলেও মন ভরবে না। মনে হবে আরও একটু বসে থাকি। মেলজি সাহেব আসলেই কি নিশ্চিন্ত মনে সময় কাটিয়েছিলেন এখানে! তিনি কি ভেবেছিলেন দুইশ বছর পর আমাদের মতো কেউ এসে তার স্মৃতিচারণ করবেন!
গার্ডেনে বসেই দুই বাসায় ভিডিও কলে কথা বলে মুহূর্তটা তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। মেলজি সাহেবের এলাকা থেকে লেকের ধার ঘেঁষে ফুল গাছের সমারোহ। ল্যাম্পপোস্টগুলোকেও জড়িয়ে দিয়েছে গোলাপ গাছ দিয়ে। একপাশে লেক, পাহাড়; অন্যপাশে শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা সবকিছুর মাঝেও ছিলো না কোনো যান্ত্রিকতা।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ভারেন্না। ভারেন্না শহরটা বেলাজিও থেকে বোটে বিশ মিনিটের পথ। আমাদের সেখানে লেইট লাঞ্চ করার প্ল্যান। ভারেন্না নিয়ে পরের পর্বে লিখবো ভাবছি। শেষ বিকেলের দিকে আবার বেলাজিওতে ফিরে এলাম। ভিলা সার্বেলোনি ততক্ষণে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা দুজন পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেঁটে বেশ উপরে উঠলাম লেকটাকে উপর থেকে দেখার জন্য।
ডিনার সেরে আমরা তড়িঘড়ি করে বের হয়ে এলাম সূর্যাস্ত দেখবো বলে। ততক্ষণে সন্ধ্যা লেগে গেছে, লেকের ধারে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। বেলাজিওতে রাত নেমে আসছে একটু একটু করে। দূরের বাড়িগুলোতে আস্তে আস্তে আলো জ্বলতে শুরু করেছে, দুই একটা বোট এপার ওপার করছে। বিশাল পাহাড়গুলোকে দেখে মনে হচ্ছে তারা আজকের দিনের মতো সব আয়োজন গুটিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছে, কাল খুব ভোরে সূর্যোদয়ে আবার জেগে ওঠবে। আমরাও হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।
খুব সকালে আমাদের হাঁটতে যাবার কথা ছিলো, কিন্তু ভোর থেকে বৃষ্টি তাই আর ভোরে বাইরে যাওয়া হলো না। তবে রুম থেকে লেকের ভিউ চমৎকার দেখা যাচ্ছিলো। বসে বসে বৃষ্টি দেখলাম কিছুক্ষণ। ঘণ্টা দুয়েক পর মেঘ কাটিয়ে রোদের ঝিলিক,আমরাও বেরিয়ে পড়লাম। নাস্তা শেষে রবি এই সাত সকালেই জেলাটোর পায়তারা করছিলো। জেলাটো শেষ করতে না করতেই আমাদের বোট দেখি টার্মিনালে এসে হাজির! আমিও ঝটপট সুভ্যেনির কিনে বেলাজিওকে বিদায় জানিয়ে বোটে উঠে গেলাম।
বোট ছাড়লো, যতদূর চোখ যায় আমি তাকিয়ে রইলাম মেলজি সাহেবের ভিলার দিকে, ভিলার পেছনে আমাদের হোটেলের দিকে, আমাদের হেঁটে যাওয়া রাস্তার দিকে, লেকের ধারের বাড়িগুলোর দিকে।একটু একটু করে ছিমছাম সাজানো গোছানো ছবির মতো এতো সুন্দর জায়গাটা মিলিয়ে যেতে থাকলো, আর অসম্ভব সুন্দর কিছু স্মৃতি, বেশ কিছু মজার অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে ছুটলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে। পরবর্তী গন্তব্য লেনো।
চলবে...
লেখক: পেশায় একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট। যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন। বসবাস করেন ইতালির পাভিয়া শহরের ভিয়া কাশশিনাজ্জা এলাকায়
আগের পর্ব
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |