রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
Published : 23 Jun 2023, 11:12 AM
বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে আওয়ামী লীগের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির উদ্বোধন করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ সারা বিশ্বে যে মর্যাদার আসন অর্জন করেছে, সেই অর্জন ধরে রেখেই বিশ্বে আরও উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, সেটাই আমার প্রতিজ্ঞা।"
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের, প্রায় দুই যুগ পর যে দলটির নেতৃত্বে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, "আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারাগারে বন্দি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীদের দাবি সমর্থন করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। বন্দি অবস্থায় তাকে এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক করা হয়।
"আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করেছে। বিজয় অর্জন করছে মুক্তিযুদ্ধে।"
শেখ হাসিনা বলেন, "নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে আজকে সারা বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ আজকের উন্নয়নশীল মর্যাদা পেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার থাকলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী, সন্ত্রাসী দল বিএনপি-জামায়াতসহ, যারা স্বাধীনতার চেতনা বিশ্বাস করে না, তারা এদেশকে ধ্বংস করবে।"
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আপনাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দিয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, শিক্ষার আলো জ্বলেছে সকল ঘরে, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে গেছে, মানুষের যাতায়াতের সুবিধা করে দিয়েছে, আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
“ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। সমগ্র গ্রামপর্যায়ে পর্যন্ত ওয়াইফাই কানেকশন দিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, হাতে হাতে মোবাইল ব্যবহার রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার থাকলে দেশ আরও উন্নত সমৃদ্ধ হবে।”
শেখ হাসিনা বলেন, "২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট অর্থনীতি আমাদের গড়ে উঠবে। আমার দেশ এগিয়ে যাবে। কৃষি, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজকে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করছে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আজকে মর্যাদা পেয়েছে। যেখানে দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে মানুষ করুণার চোখে দেখত, আজকে বাংলাদেশের জনগণ প্রবাসে যেই যাক, তাকে সম্মানের চোখে দেখে। এই সম্মান এনে দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।"
তিনি বলেন, অবৈধভাবে যারা সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় এসেছিল, তারা এদেশের স্বাধীনতার চেতনাকে ধূলিসাৎ করেছিল।
“আওয়ামী লীগ যখন সরকারে এসেছে, তখনই এদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন এসেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। আজকের প্রমাণিত সত্য।
“২০০৮ এর নির্বাচনে জনগণ ভোট দিয়েছিল, আমরা সরকার গঠন করেছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ নৌকায় ভোট দিয়ে আবারও পুনরায় ক্ষমতায় আনে। ২০১৮ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ আবার নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদেরকে জয়যুক্ত করে।"
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসে যারা দলের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
৭৪ বছরের পথযাত্রা
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল একটি অংশের উদ্যোগে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ লেখেন, “কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।”
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা সেদিন রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল- ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।
“আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।”
১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার 'মুকুল' প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সংগঠনের ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব।
আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যাত্রা শুরু করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ১৯৫৫ সালে কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। নতুন নাম হয়-‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম নেয় দলটি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ৫০ এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য ১৯৫৭ সালে দল ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ।
পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘসময় এই দলটি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে আস্থার স্থান তৈরি করে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেন বঙ্গবন্ধু, যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার ভিত্তিতেই ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর অভ্যূদয় ঘটে বাংলাদেশের।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসনে নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনকে। নেতাদের মধ্যেও দেখা দেয় বিভেদ।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসাবে দেশে ফিরে কয়েকভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন, আন্দোলন শুরু করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে।
২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। কিন্তু, দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়েছে।
এরপর দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়ে পুনরায় সরকারে ফেরে।
২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
কর্মসূচি
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুক্রবার ভোরে বঙ্গবন্ধু ভবন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সকালে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা।
আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল সকালে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতেও শ্রদ্ধা নিবেদন করবে।
বিকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে হবে আলোচনা সভা।