“অপেক্ষা করুন, ঢাকায় যা দেখবেন, তা আপনারা নিজেরা স্বচক্ষে দেখবেন,” বলেছেন বিএনপি মহাসচিব।
Published : 08 Dec 2022, 06:08 PM
বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে কয়েকশ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তারের পর পুলিশ নয়া পল্টনের দিকে যখন কাউকে ভিড়তেই দিচ্ছে না, তখনও নয়া পল্টনেই শনিবার সমাবেশ করার ঘোষণা দিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সেই সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন তিনি।
আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে উত্তাপের মধ্যে নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে জড়ো হওয়া নেতা-কর্মীদের উপর বুধবার বিকালে চড়াও হয় পুলিশ। সেখানে সংঘর্ষে একজন নিহত এবং অনেকে আহত হন।
এরপর বিএনপি কার্যালয়ে ঢুকে দলটির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ৩ শতাধিক নেতা-কর্মীকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। মির্জা ফখরুলকে তখন কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি।
বৃহস্পতিবার এক বার নয়া পল্টনে গেলেও পুলিশের ব্যারিকেডে আটকে দলীয় কার্যালয়ে না ঢুকেই ফিরতে হয় বিএনপি মহাসচিবকে। এরপর গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন।
শনিবার সমাবেশ হবে কি না- জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, “আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট- আমরা আমাদের সমাবেশ অনুষ্ঠান করবই। এর জন্য চেয়েছিলাম নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। আমার অবশ্যই আমাদের সমাবেশস্থলে যাব। এখন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এই সমাবেশটাকে শান্তিপূর্ণভাবে করার ব্যবস্থা করা।”
নয়া পল্টনের দুই পাশই পুলিশ অবরুদ্ধ করে রাখায় সেখানে কীভাবে সমাবেশ হবে- প্রশ্নে তিনি বলেন, “আপনারা ২২ অগাস্টের্ আগে অনেকেই বলেছেন, বিএনপি কিছুই পারে না। ২২ তারিখের পরে ৯টি সমাবেশ হয়েছে না। আপনারা নিজেরাই দেখেছেন জনগণ কীভাবে উঠে দাঁড়াচ্ছে?
“একটা কথা আমি বিশ্বাস করি, আমরা সবাই বিশ্বাস করি যে, এই বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। সেই গণতন্ত্র আজকে পুরোপুরিভাবে এরা লুট করে নিয়ে চলে গেছে। সেটাকে ফিরে পাওয়ার জন্য জনগণ উঠে দাঁড়াচ্ছে, জনগণ ফুঁসে উঠছে, নদী সাঁতরিয়ে পার হচ্ছে, ভেলা দিয়ে নদী পার হচ্ছে, ১০০ মাইল সাইকেলে, হেঁটে চিড়া-মুড়ি-গুঁড় নিয়ে সমাবেশগুলোতে উপস্থিত হচ্ছে।
“অপেক্ষা করুন, ঢাকায় যা দেখবেন, তা আপনারা নিজেরা স্বচক্ষে দেখবেন।”
১০ ডিসেম্বর: কথার খেলা গড়াল সহিংসতায়
নয়া পল্টনে পুলিশ বাধ্য হয়ে বুলেট ছুড়েছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বিএনপি কার্যালয় ‘ক্রাইম সিন’, নিরাপত্তার কারণেই প্রবেশ নিষেধ: পুলিশ
অফিসে ঢুকতে পারলেন না ফখরুল, বললেন ‘সমাবেশ হবে’
বিএনপির সমাবেশ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা অপপ্রচার চালাচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমরা ওদের এই প্রচারণায় বেশি গুরুত্ব দিই না। কারণ জনগণ ওদের এই প্রচারণায় বিশ্বাস করে না। জনগণ খুব ভালো করে বুঝে গেছে যে আওয়ামী লীগ একটা মিথ্যাচার করা দল।
“তারা এই মিথ্যাচার করে, মানুষকে ভুল বুঝিয়ে যেমন উন্নয়ন বিভ্রম সৃষ্টি করেছে, একইভাবে ভুল প্রচার করে গণতন্ত্র ও রাজনীতি নিয়ে বিভ্রম শুরু করেছে।”
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে তারা যে বলেছে, পাড়া-মহল্লায় পাহারা দেবে, এরকম বিষয়গুলোতে খুব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে তারা পুরোপুরিভাবে একটা সন্ত্রাসী দল। তারা যে ভয় ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে দেশ পরিচালনা করছে, সেটা আরেও স্পষ্ট হয়।
“ওবায়দুল কাদের (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) সাহেবের কথা থেকে এবং ঢাকার ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এটা একটা পরিকল্পিত প্লট যে প্লট তৈরি করে তারা ১০ ডিসেম্বর আমাদের শান্তিপূর্ণ যে সমাবেশ সেটাকে পণ্ড করতে চায়। এটা আমরা প্রথম থেকে বলে আসছি। আওয়ামী লীগ যে দল তার দুইটা বিষয় আছে, একটা হচ্ছে সন্ত্রাস আরেকটা হচ্ছে দুর্নীতি।”
পুলিশ বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে বলছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বৃহস্পতিবারও বলেছেন, কোনোভাবেই সড়কে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না।
সেই হুঁশিয়ারির মধ্যেই নয়া পল্টনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে ফখরুল বলেন, “এই সমাবেশ থেকে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব। আমাদের যেসব দাবি রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর … আমরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব।”
অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এই আন্দোলনে যুগপৎভাবে থাকবে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এনামুল হক চৌধুরী, আবদুল কাইয়ুম, কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, নাজিম উদ্দিন আলম, জহির উদ্দিন স্বপন, ফাহিমা মুন্নী, জি এম সিরাজ, আলী নেওয়াজ খৈয়াম, সুলতান মো. বাবু, আবুল হোসেন, তাইফুল ইসলাম টিপু, বেলাল আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশি অভিযান ‘কর্তৃত্ববাদের বহিঃপ্রকাশ’
দলীয় কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের নিন্দা জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, “গতকাল নয়া পল্টনে পুলিশের এই জঘন্য, ন্যক্কারজনক, বর্বরোচিত হামলা সরকারের ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই ঘটনা প্রমাণ করে বর্তমান সরকার গণতন্ত্র বিশ্বাস করে না। তারা বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবার সাংবিধানিক অধিকারও কেড়ে নিয়েছে, যা গণতন্ত্র, রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত।
“পুলিশের বর্বরোচিত, কাপুরষোচিত হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দার ভাষা আমাদের নেই। গতকালের ঘটনা গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার শামিল। আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে গণ-আন্দোলনে পতনের ভয়ে ভীত হয়ে দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।”
সরকারকে অগণতান্ত্রিক পথ থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে গ্রেপ্তার বিএনপি নেতাদের মুক্তি, তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার, কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পুলিশ প্রত্যাহার এবং ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের প্রতিবন্ধকতা দূর করার দাবিও করেন তিনি।
বোমা বিস্ফোরক উদ্ধার ‘নাটক’
বিএনপির কার্যালয় থেকে হাতবোমা উদ্ধারের যে দাবি পুলিশ করেছে, তা নিয়ে ফখরুল বলেন, “আমাদের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে পুলিশ সেখান থেকে গ্রেপ্তার করেছে, অফিসের কর্মচারীদেরও তারা গ্রেপ্তার করেছ। এরপর পুলিশ নিজেদের রেখে আসা বোমা উদ্ধার ও বিস্ফোরণ নামের নাটক সাজায় ও মিথ্যাচার করে।
“আমি যখন গতকাল বিএনপি অফিসে যেতে চাই, সেখানে তারা আমাকে ঢুকতে দেয়নি। আমার সামনেই পুলিশ সেখানে অসংখ্য বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। শুধু পুলিশ নয়, পুলিশের সাথে সোয়াট বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এই সন্ত্রাসে নিয়োজিত ছিল। যে গুলি করেছে তার আলোকচিত্র এসেছে গণমাধ্যমে, আর্জেন্টিনার ড্রেস পরে গুলি করছে।”
পুলিশ বেআইনিভাবে বিএনপির কার্যালয়ে ঢুকেছে অভিযোগ করে ফখরুল বলেন, “আইন হচ্ছে কোনো বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালাতে যদি হয়, সেই বাড়ির মালিককে সঙ্গে রাখতে হবে, নিরপেক্ষ সাক্ষী থাকতে হবে। সাধারণত এই ধরনের তল্লাশি চালাতে হলে সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করতে হয়।
“এই ক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি। উপরন্তু আমাদের কার্যালয়ে না ঢুকতে দিয়ে পুলিশ চার ঘণ্টা বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে ভাংচুর করেছে, বোমা রেখে্ছে, এই সমস্ত বিস্ফোরক নাটক তারা তৈরি করেছে।”
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “পুলিশ বিএনপি অফিসে অযাচিতভাবে প্রবেশ করে নিচ তলা থেকে ৬ তলা পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন কক্ষ তছনছ করেছ। এমনকি দলের চেয়ারপারসনের কক্ষ, মহাসচিবের কক্ষ, অফিস কক্ষের দরজা তারা অন্যায়ভাবে ভেঙে প্রবেশ করে এবং সকল আসবাবপত্র, ফাইল, গুরুত্বপূর্ণ নথি তছনছ করে।
“তারা কম্পিউটার, ল্যাপটপ, হার্ডডিস্ক এমনকি দলীয় সদস্যদের প্রদেয় মাসিক চাঁদার টাকা, ব্যাংকের চেক বই, নির্বাচন কমিশন সংক্রান্তসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ নথি নিয়ে গেছে।”
চাল নিয়ে ‘মিথ্যাচার’
বিএনপির নেতা-কর্মীরা নয়া পল্টনে অবস্থানের জন্য কার্যালয়ের ভেতরে চাল-ডাল-পানি মজুদ করেছিল- পুলিশের এমন অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় ফখরুল বলেন, এমন মজুদের খবর তার জানা নেই।
“আমাদের ঢাকা বিভাগের সমাবেশ। বিভিন্ন জেলার নেতা-কর্মীরা আসবেন সমাবেশে। আমি জানি না, আমার নলেজেই নাই। এমনও তো হতে পারে সেটা দেওয়া হয়েছিলো ওই সমাবেশে যারা আসবেন, তাদের জন্য খিচুরি-টিচুরি রান্নার করার জন্য।
“তবে ওইখানে ১৬০ বস্তা চাল রাখার কোনো জায়গাই নাই। এটা পুরোপুরি মিথ্যা, এ টোটালি ব্ল্যাটেড লাই। আর দুই লক্ষ বোতল পানি রাখারও জায়গা সেখানে নেই,” বলেন বিএনপি মহাসচিব।