বাইরে জটলা, ভেতরে সুনসান: যা ঘটল কুমিল্লার ভোটে

প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা বলেছেন, কেন্দ্রের চৌহদ্দীর বাইরে সমাগম নিয়ে তাদের কিছু করার নেই।

মাসুম বিল্লাহও আবদুর রহমান, কুমিল্লা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 March 2024, 01:57 PM
Updated : 9 March 2024, 01:57 PM

বাইরে মোড়ে মোড়ে বাস মার্কার প্রার্থী তাহসীন বাহার সূচনার কর্মী-সমর্থকদের জটলা, আর ভেতরে সুনসান পরিবেশে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপ-নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন নগরবাসী।

কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ের পক্ষে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের এমন অবস্থানকে ভোটার ঠেকানোর ‘পাহারা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য প্রার্থীরা।

কেন্দ্রের বাইরে জটলা থাকলেও যে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে পৌঁছাতে পেরেছেন, তারা খুব ভালোভাবে ভোট দেওয়ার কথাই বলেছেন। প্রিজাইডিং কর্মকর্তারাও বলেছেন, কেন্দ্রের চৌহদ্দীর বাইরে সমাগম নিয়ে তাদের কিছু করার নেই।

শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সিটি উপ-নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন; ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫ কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিলেন দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন।

ভোটের সময়ে দুয়েক জায়গায় ‘সহায়তার’ নামে ভোটার ছাড়া অন্যদের গোপনকক্ষে ঢুকে যেতে দেখা গেছে; একটি ভোটকেন্দ্রের ফটক ‘অকারণে’ বন্ধ ছিল প্রায় আধা ঘণ্টা।

বাস প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অন্য সব প্রার্থীর অভিযোগের মধ্যে সকাল ৮টায় ইভিএমের এই ভোটগ্রহণ শুরু হয়।

কিছু সময় পর সদর দক্ষিণ এলাকার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রের বাইরে সংঘর্ষ বাঁধে, সেখানে দুজন গুলিবিদ্ধ হন, সব মিলিয়ে আহত হন চারজন।

দলীয় প্রতীকবিহীন এই নির্বাচনের প্রার্থী, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিষ্কৃত সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সারের ভাষ্য, বাস প্রতীকের প্রার্থী সূচনার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধরা তার সমর্থক।

অন্যদিকে সূচনার দাবি, “যত দূর আমি জানি, আমাদের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রলীগের কর্মী গুলি খেয়েছে। অভিযোগ আমার দিকে কেন, সেটা আমি জানি না।”

ভোটাররা যাতে লাইন ধরে দাঁড়াতে পারেন, সেই প্রস্তুতি ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই নিয়েছিলেন ভোটগ্রহণের সঙ্গে যুক্তরা; কিন্তু সেই লাইন চোখে পড়েনি। সময়ে সময়ে দুই-একজন করে এসে ভোট দিতে দেখা গেছে সেখানে।

এর বিপরীতে কেন্দ্রের বাইরে ছিল বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন বাস প্রতীকের সমর্থক।

ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কায়সার এবং হাতি প্রতীকের প্রার্থী, মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর-উর রহমান তানিমের ওই কেন্দ্রে তাদের কিছু সমর্থককেও দেখা গেছে।

কেন্দ্র থেকে বের হয়ে রানীর দীঘির পাড় ধরে কিছুদিন এগোলেও অলিগলিতে বাস মার্কার সমর্থকদের চোখে পড়ে।

ওই কেন্দ্রের সকাল সকাল ভোট দিতে আসেন দুই জমজ ভাই জামাল উদ্দীন ভুঁইয়া এবং কামাল আবু নাসের। তাদের জন্ম ১৯৬১ সালে।

তাদের মধ্য দুই পা অবশ জামালকে ক্র্যাচে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে হাঁটতে হয়। ২০০৫ সালে পা ভাঙে তার, ২০২১ সালে স্ট্রোকে হয়েছে চলৎশক্তিহীন। তাকে তার ভাই কামাল এবং অন্য একজন ভোটকেন্দ্রে যেতে সহায়তা করেন।

ভোট দিয়ে বের হয়ে জামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাধারণ মানুষের জন্য পাঁচ মিনিটের হাঁটার দূরত্বে মাদারকেয়ার হাসপাতালের পাশে তাদের বাসা। বাস প্রতীকের প্রার্থীর রিকশায় চড়ে তারা কেন্দ্রে এসেছেন।

ভিড় না থাকায় নিজে ভোট দিতে সুবিধা হলেও ভোটার কম হওয়ার আক্ষেপ ঝরে তার কণ্ঠে। তিনি বলেন, “এত কম ভোটার হবে ভাবি নাই, এর কারণ কি তাও জানি না।”

ভোটগ্রহণের শুরু থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা ওই কেন্দ্রে অবস্থান করেও ভোটারদের উপস্থিতি কমই দেখা গেছে; তবে, বাইরের জটলা ঠিকই ছিল।

সকাল পৌনে ৯টায় ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন হাতি মার্কার প্রার্থী তানিম; নিজ দলের আরেক প্রার্থী সূচনার কর্মী-সমর্থকরা তার পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া এবং ভোটারদের চাপ প্রয়োগের অভিযোগ করেন তিনি।

এরপর সকাল ১০টার দিকে সেখানে ভোট দিতে আসেন ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কায়সার; তারও ছিল একই অভিযোগ এবং লক্ষ্যবস্তু বাস প্রতীকের সূচনাই।

রানিরদীঘির পাড় ধরে ওই কেন্দ্রের বিপরীতমুখী ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ কেন্দ্রে ঢুকতে হয় বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের জটলা পেরিয়ে।

নারীদের ওই কেন্দ্র সকাল ১১টার দিকে ভোট দিতে আসেন বাস প্রতীকের প্রার্থী সূচনা; নিজের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগকে ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দেন তিনি।

দুপুর ১২টার দিকে নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার মডার্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে গিয়েও বাইরে এবং অলিগলিতে বেশ জটলা দেখা যায়। তবে, ভেতরটা সুনসানই ছিল।

এর আধা ঘণ্টা পরে সদর দক্ষিণ থানায় ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে মাঠ ঘিরে থাকা দুই স্কুলে দেখা যায় একই পরিস্থিতি। ঠাকুরপাড়া থেকে দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার হলেও চিত্রে কোনো ভিন্নতা ছিল না।

সেখানকার নেউরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী এবং নেউরা মমিনুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ে পুরুষ ভোটারদের কেন্দ্র। কেন্দ্র থেকে কয়েকশ গজ উত্তরে বাড়ির সামনে জটলা পাকিয়ে ছিলেন বাস প্রতীকের একদল সমর্থক; ভোটারদের নানা রকম নির্দেশনা দিতে দেখা যায় তাদের।

ওই জটলা পার হয়ে ভোট দিতে আসেন এলাকার বাসিন্দা জাহানারা বেগম; ৬৩ বছর বয়সী এই গৃহিণী বলেন, বাসার কাজকর্ম শেষ করে ভোট দিতে এসেছেন তিনি।

“আমি একেবারে একা একা চলে আসছি। কোনো সমস্যা হয় নাই।”

ভোটার উপস্থিতি অন্য সময়ের তুলনায় কম থাকার কথা বললেও তার কারণ জানা না থাকার কথা বললেন এই ভোটার।

ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা অর্পণ পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কেন্দ্রের ভেতরে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা তারা পাননি। পাঁচটি কক্ষের মধ্যে দুটিতে টেবিল ঘড়ির এবং সবকটিতে বাস প্রতীকের এজেন্ট রয়েছে।

১ হাজার ৯৪৬ ভোটারের এই কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫৩২টি ভোট পড়ার কথা জানান তিনি। দিন শেষে তা ৪০ শতাংশ হওয়ার আশা প্রকাশ করেন।

এই কেন্দ্রের সামনের সড়ক ধরে কিছুদূর এগিয়ে রাজাপুর চৌমুহনী থেকে বাঁয়ে গেলে পাওয়া যায় মুন্সি এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র; যেখানে সকালে সংঘর্ষের ঘটনায় দুজন গুলিবিদ্ধ হন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দল এবং সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এলাকা ছিল থমথমে; গলির মুখগুলোতে বাস প্রতীকের সমর্থকদের সতর্ক উপস্থিতি দেখা গেছে।

সকালে যে স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে গিয়ে দেখা যায় গলির মুখে জড়ো হয়ে থাকা ব্যক্তিদের ধাওয়া দিচ্ছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দল। এই সময় ভোটার ছাড়া অন্যদের জটলা না করতে বলা হচ্ছিল মাইকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন তৎপরতার মধ্যে দুয়েকজন নারী ভোটার কেন্দ্রের দিকে গেলেও একজন বয়স্ক নারীকে পাওয়া গেল, তিনি ভোট দিতে যেতে ইচ্ছুক নন।

কারণ জানতে চাইলে লাঠিতে ভর দিয়ে সংঘর্ষের এলাকা পার হতে থাকা ওই নারী বলেন, “যা অবস্থা এখানে ভোট দিতে যামুই না।”

ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা হাসান আহমেদ কামরুল বলেন, “কেন্দ্রের ভেতরে কোনো সমস্যা হয়নি, বাইরে কী হয়েছে আমি জানি না। এখানে যারা ভোট দিতে আসছে, তারা ভালোভাবে ভোট দিতে পারছেন।”

ভোটার উপস্থিতিতে কোনো প্রভাব না পড়ার দাবি করেন তিনি। দুপুর ১টা পর্যন্ত তিন হাজার ৫১ ভোটের মধ্যে ৯৮১ ভোট পড়ার কথা তিনি জানান।

ওই কেন্দ্র থেকে কুমিল্লার পুরাতন হাইওয়ের দিকের রাস্তার ধরে কিছুদূর এগোলে পাওয়া যায় ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের গোয়ালমথন আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র।

কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার সাইফুর রহমান যখন স্কুলের মাঠে গিয়ে পায়চারি করছিলেন, তখন একটি ভোটকক্ষে চারজন নারী ভোটারকে নিয়ে ঢোকেন এক ব্যক্তি।

কেবল ভোটকক্ষে গিয়ে শেষ নয়, ওই নারীরা ভোট দেওয়ার সময় একে একে গোপন বুথেও ঢোকেন ওই ব্যক্তি। সেখান থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “উনারা আমার মা, পিসি, আত্মীয়- ভোট দিতে সহযোগিতাতো করতেই হবে।”

গোপনকক্ষে ঢোকার বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসার সাইফুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “গোপন বুথে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে, সে নির্দেশনা আমি দিয়েছি। সেখানে যাওয়ার সুযোগ নাই। আর কেউ ঢুকবে না।”

২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চৌয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় গিয়েও ভেতরে সুনসান পরিস্থিতি দেখা যায়। তবে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে কুমিল্লা শহরের দিকে এগোলে রাস্তার মুখগুলোতে বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি দেখা গেছে।

বিকাল ৩টার দিকে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মুরাদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে গলির মুখগুলোতে চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেছে তাহসীন বাহারের কর্মী-সমর্থকরা।

বাস প্রতীকের সমর্থকরা যাদেরকে সঙ্গে করে ওই কেন্দ্রে নিয়ে আসছিলেন, তাদের বাইরে ওই সময়ে তেমন ভোটার দেখা যায়নি।

বিকাল ৩টার ঠিক আগে মুরাদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যাটারিচালিত নৌকায় ভোট দিতে আসেন অশীতিপর বৃদ্ধা চঞ্চলা রানী সরকার। এরপর তাকে রিকশা থেকে কোলে করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যান নাতি পলাশ চন্দ্র সরকার।

চঞ্চলা জন্মগ্রহণ করেছেন ব্রিটিশ আসলে ১৯৪০ সালে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছেন। তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে এক ছেলেও বেঁচে নেই। এখন নাতি পলাশের সঙ্গে মুরাদপুর এলাকায় থাকেন।

ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোট দিয়ে ভালো লাগছে। সবসময় এইহানেই ভোট দিই।”

বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কুমিল্লা ইসলামিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে ফটক বন্ধ পাওয়া যায়। ভেতরে বাস প্রতীকের সমর্থকদের আনাগোনা তখনও ছিল।

সাংবাদিক পরিচয়ে ঢুকতে চাইলে খোলার ব্যবস্থা হয়। কেন্দ্র বন্ধ থাকার খবর পেয়ে ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দীন কায়সারও ছুটে আসেন।

বিকাল ৪টায় ভোট শেষে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কুমিল্লা জিলা স্কুল মিলনায়তনে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ফল ঘোষণা শুরু হয়।