“তথাকথিত এই ডামি নির্বাচন সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে নাশকতা চলছে, তাতে শুধু গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই নন, নিপীড়ন নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছেন খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষ,” বলা হয়েছে চিঠিতে।
Published : 01 Jan 2024, 12:44 AM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘একতরফা’ আখ্যা দিয়ে, নেতা-কর্মীদের ওপর ‘দমনপীড়নের’ অভিযোগ জানিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে বিএনপি।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী রোববার এক ভার্চুয়াল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “আজ নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আজ ঢাকায় জাতিসংঘসহ বিদেশি সব মিশনেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।”
নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপির হরতাল-অবরোধের মধ্যে যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার যেসব ঘটনা ঘটছে, সেজন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করা হয়েছে চিঠিতে।
চিঠির পুরো বিষয়বস্তু ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে পড়ে শোনান রিজভী। সেখানে বলা হয়, “অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আন্তর্জাতিকভাবে কলঙ্কিত ও ধিকৃত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনের পটভূমিতে আবারও আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে একটি প্রহসনমূলক ও সহিংস কারচুপির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তথাকথিত এই ডামি নির্বাচন সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে নাশকতা চলছে, তাতে শুধু গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই নন, নিপীড়ন নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছেন খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষ।
“সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-কাঠামোতে, বিশেষত বাস-ট্রেনে পরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে জনগণের জানমাল ও নিরাপত্তা-স্বাধীনতা বিনষ্ট করছে আওয়ামী লীগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশ।”
চলমান অগ্নিসংযোগের প্রতিটি ঘটনায় ‘একটি সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে’ মন্তব্য করে বিএনপির চিঠিতে বলা হয়েছে, “এর একমাত্র বেনেফিশিয়ারি আওয়ামী লীগ ও তার অধীনস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র, আর প্রধান ভুক্তভোগী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন শীর্ষ নেতৃত্ব এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ‘কোনো তদন্ত তথ্য বা সূত্র ছাড়াই’ প্রতিটি ঘটনার পর তার দায় ‘অবলীলায় ও একই সুরে’ বিএনপির উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে চিঠিতে।
বিএনপি দাবি করেছে, “নিজেদের সুপরিকল্পিত এই ধ্বংসযজ্ঞকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার করে তারা রাষ্ট্রীয় দমন নিপীড়নকে উসকে দিচ্ছেন, যা শেখ হাসিনার প্রতিহিংসামূলক বক্তব্যে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
“আমরা ইতোপূর্বে তার কিছু সহিংস দিক-নির্দেশনা দেখেছি, যার মাঝে রয়েছে বিএনপির সকল নেতা-কর্মীর হাত পুড়িয়ে ফেলা ও ভেঙে দেওয়া, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু থেকে ফেলে দেওয়া, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মা নদীতে চুবিয়ে আনা এবং এমন বহুবিধ বয়ান।”
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের এক দফা দাবিতে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকা মহাসমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ওই সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর দফায় দফায় হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিতে থাকে দলটি।
গত দুই মাস ধরে চলা এসব কর্মসূচিতে সারা দেশে প্রায় তিনশ যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। নাশকতার কয়েকটি ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটে।
ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ভোট ঠেকাতে ২০১৩ এবং ২০১৫ সালের মতই ফের ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ শুরু করেছে বিএনপি। তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, ক্ষমতাসীনরা এসব করে দায় তাদের ওপর চাপাচ্ছে।
হরতালের মধ্যে গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় চারজনের মৃত্যুর বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপির চিঠিতে বলা হয়, “ওই ঘটনা বিশ্লেষণে প্রতীয়মান যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি চিহ্নিত অংশের যোগসাজশে এই নাশকতা সংঘটিত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের দুই দিন আগেই ১৯ ডিসেম্বরের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বিশেষভাবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা, জরুরি পরিষেবা, ডাক্তার এবং অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
“আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই নির্দেশনাটি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। ডিএমপির এই প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়েছিল, নাশকতার সুস্পষ্ট তথ্য ও পরিকল্পনা তাদের কাছে কীভাবে এল এবং তারপরও এটি রোধে কেন তারা কোনো ব্যবস্থা নিলেন না, জনমনে এসব প্রশ্ন রয়েছে।”
বিএনপি বলছে, ক্ষমতাসীনরা এসব ঘটনার দায় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করছে, বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করে ‘প্রহসনের নির্বাচন’ করতে চাইছে।
আর সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করছে এবং তারা আন্দোলনের ‘শান্তিপূর্ণ’ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বলে দাবি করা হয়েছে চিঠিতে।
রিজভী বলেন, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তাদের ২৫ হাজার নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ২৭ জনকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান তাদের চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের যৌথ এই উদ্যোগ আসলে সরকারের মাস্টার প্ল্যানেরই অংশ। প্রথমে তারা মিডিয়া কাভারেজ দিয়ে নাশকতার ঘটনা তৈরি করে। এরপর বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিসমূহের উপর দায় চাপিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার করে।
“পরবর্তীতে তারা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায় প্রদান করে এবং আমাদের চলমান আন্দোলনকে বিতর্কিত করার একটি হীন প্রচার চালায়। এই পরিকল্পনারই অবিচ্ছেদ্য অংশ হল দেশব্যাপী অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি এবং এই নাশকতাগুলোকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেওয়া।”
চিঠিতে দাবি করা হয়, পুলিশ যেসব ‘কাল্পনিক মামলা এবং বানোয়াট অভিযোগ’ নথিভুক্ত করেছে, সেখানে বিএনপির ‘মৃত এবং গুমের শিকার’ নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হচ্ছে।
“কোনো নিরপেক্ষ বা স্বাধীন সাক্ষী ছাড়াই মিথ্যা পুলিশি সাক্ষ্যকে একমাত্র প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বিচার বিভাগের ধারাবাহিক পূর্বপরিকল্পিত এই রায়সমূহ আইনের অনুশাসনের সার্বিক অবক্ষয়কে পুনঃপ্রমাণিত করে তুলছে।”