নির্বাচন বাঁচিয়ে না রাখলে রাজনীতি উধাও হবে: সিইসি

ইসির সবাই ‘সাধু পুরুষ’ কি না, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলেরও নজরদারি থাকা দরকার বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2022, 11:54 AM
Updated : 26 July 2022, 11:54 AM

অর্থশক্তি, পেশিশক্তির ব্যবহার আর ভোট চুরির ‘অপসংস্কৃতির’ পরও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের ওপর জোর দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, নির্বাচন যদি না থাকে, তাহলে রাজনীতিরই বিপদ।

তার ভাষায়, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট করতে রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে হবে।

“পলিটিক্স থেকে কিন্তু গণতন্ত্রের জন্ম। গণতন্ত্র থেকে পলিটিক্সের জন্ম হয়নি। অনেক আগে যখন ক্ষমতা নিয়ে..., তারপর আস্তে আস্তে উনারাই সৃষ্টি করলেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের। সেই নির্বাচনটিকে যদি বাঁচিয়ে রাখা না যায় তাহলে পলিটিক্স উধাও হয়ে যাবে, পলিটিক্স থাকবে না। এটাকে পলিটিক্সও বলা যাবে না, গণতন্ত্রও বলা যাবে না।”

মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের অষ্টম দিনে এ মন্তব্য করেন সিইসি। এদিন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির সঙ্গে বৈঠক করেন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শুধু ‘আস্থা’ নয়, কমিশনের কাজের সমালোচনা এবং নজরদারিও চান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেন, “আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এই প্রতিশ্রুতির কিছু মূল্য থাকা তো উচিত। একেবারে যে আমরা ডিগবাজি খেয়ে যাব, তা তো না। সেটা হওয়ার কথা নয়।”

‘অপসংস্কৃতি’

মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ সংলাপে অংশ নেয়। নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে ১১ দফা প্রস্তাব পেশ করে দলটি।'অর্থ ও পেশীশক্তি' ব্যবহারের কারণে ইসির 'অসহায়ত্বের' অতীত অভিজ্ঞতার কথাও তারা তুলে ধরেন।

সংলাপে সিইসি বলেন, “বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। বলতে চাচ্ছি- সমস্যাগুলো বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে ব্যালেন্স করে অর্থবহ, যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচন করা যায়, এমন কথা আমার সহকর্মীরাও বলেছেন। কাজেই আমাদের উপর আস্থা রাখেন। আস্থা রাখতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলে হবে না।”

গোপনে টাকা দিয়ে ভোট কেনার যে অভিযোগ নির্বাচনের সময় আসে, তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হলেও এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে মনে করেন সিইসি।

তিনি বলেন, “আপনাদের নজরদারি থাকতে হবে। আমরা কি আসলেই সাধু পুরুষ? নাকি ভেতরে ভেতরে অসাধু? নজরদারি যদি না রাখেন, তাহলে আপনাদের তরফ থেকে দায়িত্ব পালন করলেন না। অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে পাঠাবেন।”

হাবিবুল আউয়ালের ভাষায়, “এখানে অপসংস্কৃতি হয়ে গেছে, পয়সা্ ঢালছে, মাস্তান ভাড়া করছে। একজন প্রফেশনাল কিলারকে হায়ার করতে খুব বেশি পয়সা লাগে না, আজকাল যেটা হয়েছে।

“অর্থশক্তি, পেশিশক্তিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সকলকে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। মাঠ আপনাদের থাকতে হবে। আমাদের তথ্য দিলে আমরা আপনাদের সাহায্য করব।”

সিইসি এদিন আবারও দাবি করেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের দায় বর্তমান ইসির নয়। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সব দায়িত্ব তারা নেবেন।

“১৮ সালের যে নির্বাচনের কথা বলেছেন, না, ওভাবে নির্বাচন হবে এটি আপনারা আশা করেন না। আমরা সেটি জানিও না, দেখিওনি। নির্বাচন নির্বাচনের আইন অনুযায়ী হবে। সময় দেওয়া হবে। ভোটাররা যাবেন। ভোট দিতে থাকবেন। আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের অংশের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করব।”

পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও কিছু দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেন সিইসি।

হাবিবুল আউয়াল বলেন, “আমরা দায়িত্বটা শেয়ার করব। আপনারা আমাদেরকে অবশ্যই চাপে রাখবেন। আমি বিশ্বার করি, এটা প্রয়োজন আছে। আপনাদেরকেও আমাদের উপর নজরদারি রাখতে হবে। আমাদের থেকে কোনো অনিয়ম লক্ষ্য করলে তা প্রকাশ করে দেবেন। আমরা কোনোভাবেই পক্ষপাতিত্ব করতে চাই না।”

‘চাপে রাখবেন’

দুপুরে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয়। সব কেন্দ্রে ইভিএম, সামরিক বাহিনীর অন্তত ৫ জন করে সদস্যকে কেন্দ্রে মোতায়েরসহ সাত দফা প্রস্তাব দলটি পেশ করে।

বৈঠকে সিইসি আশ্বস্ত করেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নেবেন। নির্বাচনকালীন ইসি আইন-বিধি বিধান অনুযায়ী চলবে। সরকারের সহযোগিতাও থাকবে।

হাবিবুল আউয়ালের ভাষায়, “নির্বাচন সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ যথেষ্ট কঠিন কাজ। এ কঠিন কাজের ক্ষেত্রে সবার আন্তরিক, সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থন লাগবে।

“বারবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছি। অংশগ্রহণ হলেই কি অবিচার, ভোট চুরি হবে না? তা তো নয়। অংশগ্রহণ হলে ভারসাম্য আসে, প্রতি কেন্দ্রে বড় বড় দল থাকে, তাদের কর্মী সমর্থকরা ভারসাম্য সৃষ্টি করে, ইসির কাজটা সহজ করে দেয়। আমি বারবার চাই- অবাধ, নিরপেক্ষ অংশগ্রহনমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।

দলগুলোর প্রতি সিইসির আহ্বান- “আমাদের অবশ্যই চাপে রাখবেন। আমাদের সতর্কতা সজাগ থাকবে। আমাদের ওপর অনাস্থা থাকতেই পারে। সেই অনাস্থা আমাদেরই দূর করতে হবে কাজের মধ্য দিয়ে।”

হার মেনে নেওয়া শিখতে হবে

বিকালে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির সঙ্গে বৈঠক শেষে সমাপনী বক্তব্যে সিইসি বলেন, “জিতি বা হারি- সেটা বড় কথা নয়। এমন মনস্তত্ত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে- কোনোভাবেই হারব না। হারতে তো একজনকে হবেই। এ মনস্তত্ত্বিক পরিবর্তনটাও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

“নির্বাচন হবে, ভোটাররা ভোট দেবেন। আমি হারতেও পারি, জিততেও পারি। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক যে সংকট কোনোভাবে হারা যাবে না- এটা অর্থশক্তি, দ্বন্দ্ব বা বিরাজমান রাজনীতির কারণে হতে পারে। কিন্তু সে অবস্থা থেকে আমাদের উঠে আসা প্রয়োজন।”

গণতন্ত্রের বিকাশ এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার বিষয়টিও ‘বুঝতে হবে’ মন্তব্য করে সিইসি বলেন, “ছোট দল, বড় দল, সবার সহযোগিতা দরকার রয়েছে। নির্বাচনের সময় ইসির কাছে অনেকটা ক্ষমতা এসে যায়। ইসি সরকারের সহায়তা আদায় করে নেবে। আইন-বিধি প্রয়োগের চেষ্টা করব। রাজনৈতিক শক্তি সামষ্টিকভাবে এগিয়ে এসে সহায়তা করে তাহলে ইসির দায়িত্ব পালন, কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।”

নির্বাচনের সময় ‘রাজনীতির কারণে পুলিশি হয়রানি’ যাতে না হয়, সে দিকে ইসি ‘লক্ষ্য রাখবে’ বলে কমিশন আশ্বস্ত করে সংলাপে।

চেয়ারম্যান শেখ ছালাউদ্দিন ছালুর নেতৃত্বে এনপিপির একটি প্রতিনিধি দল ইসির সংলাপে অংশ নেয়। দলটির পক্ষ থেকে তফসিল ঘোষণার পর কোনো রাজনৈতিক মামলা না দেওয়া, প্রার্থী বা কর্মীদের অযথা হয়রানি না করাসহ ১৬ দফা সুপারিশ করা হয়।

এদিন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকেও আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইসি, তবে তাদের কোনো প্রতিনিধি দল যাননি।

ধারাবাহিক এ সংলাপে বুধবার বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, জাকের পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে বসবে কমিশন।