১৯৯৩ সালে তার গঠন করা গণফোরাম রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে না পারলেও কামাল হোসেন সব সময় ছিলেন আলোচিত।
Published : 27 Oct 2023, 08:39 PM
পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনের অবসানের ঘোষণা দিলেন কামাল হোসেন।
আওয়ামী লীগের হাত ধরে শুরু হওয়া ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের শেষ তিনটি দশক তিনি ছিলেন ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু গণফোরামের নেতৃত্বে। সেই দলটিকেও এক রাখতে না পারার এক বছর পর এল ‘থামার ঘোষণা’।
১৯৯৩ সালে নিজ হাতে গড়া দলের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণাটি এসেছে শুক্রবার দলের বিশেষ এক সম্মেলনে।
শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি বলেন, ‘‘দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আপনাদের নিয়ে পথ চলেছি, জাতীয় সমস্যা ও সংকট নিরসনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। এখন আমার বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় আর সক্রিয়ভাবে সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না।
‘‘এ অবস্থায় আমি সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে তথা গণফোরামের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি নেয়ার ঘোষণা দিচ্ছি।”
রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলেও দেশের জন্য সাধ্যমত কাজ করে যাওয়ার কথা বলেন ৮৬ বছর বয়সী এই আইনজীবী।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি বলেন, ‘‘আমি আমার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে দেশ ও জাতির জন্য আমার সাধ্য মোতাবেক অবদান রাখতে চেষ্টা করব। দলের প্রতিও আমার আন্তরিকতা, দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আমার আবেগ-অনুভূতি, সহানুভূতি-সহযোগিতা ও পরামর্শ সব সময়ই থাকবে।
‘‘এ অবস্থায় গণফোরামের আজকের এই বিশেষ জাতীয় কাউন্সিলে উপস্থিত কাউন্সিলরদের অনুরোধ করব, আপনারা দলকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে আজ নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করবেন।”
পরে বিশেষ কাউন্সিলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মফিজুল ইসলাম খান কামালকে সভাপতি পদে নির্বাচন করা হয়।
বয়সের ভারে ন্যূজ কামাল হোসেন জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনের এই আয়োজনে আসেন বেশ কয়েকজন নেতার সহযোগিতায়।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘‘আজকের এই কাউন্সিলে আপনারা গণতান্ত্রিকভাবে যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করতে যাচ্ছেন, আমি আশা করব, এই কমিটি আগামী দিনে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
দেশের গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনারা সর্বদা সক্রিয় সচেষ্ট থাকবেন। জয় হোক গণফোরামের, জয় হোক জনতার।”
এক নজরে কামাল হোসেন
কামাল হোসেন রাজনীতিতে সব সময়ই ছিল বড় এক নাম। পাকিস্তান আমলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবীদের একজন।
১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ড. কামাল। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন তিনিও। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ১০ জানুয়ারি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে ফেরেন।
১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের ৬৫ শতাংশের বিপরীতে নৌকা নিয়ে পান ২৬ শতাংশ ভোট।
সে সময় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দলের নীতি নির্ধারণে তার ভূমিকা ছিল ব্যাপক। তবে ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।
সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর শেখ হাসিনা আনেন সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ। তবে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. কামাল বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’
শেখ হাসিনার কাছে দেওয়া এক চিঠিতে তিনি নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরেন।
১৯৯২ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ড. কামাল। এরপর তিনি গণতান্ত্রিক ফোরাম নামে একটি উদ্যোগ নেন।
১৯৯২ সালের ১৯ এবং ২০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের পর দলের সভাপতিমণ্ডলীর পদ হারান তিনি।
১৯৯৩ সালের অগাস্টের শেষ দিকে গণতান্ত্রিক ফোরামের তিনব্যাপী জাতীয় মহাসম্মেলন আহ্বান করা হয়। এই সম্মেলনের মাধ্যমে ২৯ অগাস্ট গণফোরাম গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
সে সময় এই দলটি বেশ আলোড়ন তোলে। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ভোটে অংশ নেয় গণফোরাম। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারেনি। সারা দেশে মোট ভোটের কেবল ০.১৩ শতাংশ পায় তারা।
তবে কামাল হোসেন কখনও আলোচনার বাইরে যাননি। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন সব বিরোধী দলগুলোকে এক মঞ্চে এনে মহাজোট গঠনের চেষ্টা করে, তখন এক মঞ্চে ওঠেন শেখ হাসিনা ও কামাল হোসেন।
তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে ঘটে নতুন এক মেরুকরণ। বিএনপির সঙ্গে জোটে যান কামাল হোসেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে সেই জোটের প্রধান নেতায় পরিণত হন তিনি।
ভোটের আগে ভারতের একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, জামায়াত থাকবে জানলে তিনি সেই ভোটে যেতেন না।
সেই নির্বাচনে বিএনপি তার ২০ দলীয় জোটও চালিয়ে যাচ্ছিল এবং জোটের প্রার্থীরাও ধানের শীষ নিয়ে ভোটে লড়েন। কামাল হোসেনের দলের প্রার্থীদেরও ছিল একই মার্কা।
ভোট শেষে বিএনপির সঙ্গে কামাল হোসেনের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। বিএনপি সব দলকে নিয়ে যে যুগপৎ আন্দোলনে নামে, তখন তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
বারবার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান করে আসা কামাল হোসেন তার নিজের দলকেই ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেননি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দলে টানা রেজা কিবরিয়াকে ঘিরে শুরু হয় ভাঙন।
২০২০ সালে দলের পঞ্চম কাউন্সিলের পর কামাল তার দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুকে বাদ দিয়ে রেজা কিবরিয়াকে ওই পদে আনলে ভাঙনের সূচনা হয়। পরে মন্টুরা আলাদা সম্মেলন ডাকেন।
এরপর দুই অংশের মধ্যে বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের ঘোষণা আসে। জাতীয় প্রেসক্লাবে আলাদাভাবে বর্ধিত সভাও করে তারা। এরমধ্যে রেজা দল ছাড়লেও বিরোধ থামেনি।
গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কামাল হোসেনকে অব্যাহতি দিয়ে গণফোরামের আলাদা কমিটি গঠন করেন মন্টু। নিজে হন সভাপতি।
ড. কামালকে সভাপতি করে অন্য একটি অংশ রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকে।