নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে ঐক্য খোঁজার মধ্যে নতুন বছরে রাজনীতিতে বদলের চ্যালেঞ্জও বড় হয়ে উঠতে পারে।
Published : 02 Jan 2025, 01:43 AM
জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পালাবদলের নতুন বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চ, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চান ৩৬ দিনের সফল এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা।
তাদের ভাষায়, প্রচলিত রাজনীতি গত ৫৩ বছর ধরে জাতিগোষ্ঠিকে ‘বিভক্ত’ করে রেখেছে; এখন তারা চান নানা মতের ও নানা বিশ্বাসের মানুষকে একই ধারায় এনে নতুন রাজনীতির বয়ান তৈরি করতে।
সে কারণে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণায় উদ্যোগী হয়েছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, আর তাতে বাহাত্তরের সংবিধান ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করার কথা বলেছেন ছাত্র নেতারা।
বাংলাদেশকে নতুন এক বাস্তবতায় এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ২০২৪ সালের শেষদিন ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের ঘোষণা এসেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের কাছ থেকে।
পরে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ তৈরির প্রতিশ্রুতি আসায় কর্মসূচি বদলান নেতারা।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাহাত্তরের সংবিধান বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এমন অবস্থান রাজনীতির মাঠে স্বস্তিতে থাকা বিএনপির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, “বাহাত্তরে প্রণিত সংবিধান কবর দেওয়ার কথা শুনলে কষ্ট লাগে। এই সংবিধানে যদি খারাপ কিছু থাকে নিশ্চয় সেটা বাতিলযোগ্য।”
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনের ইতি ঘটার পর রাষ্ট্রের পুরনো ছাঁচ ভেঙে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে সামনে থেকে পথ দেখাতে চায় তরুণরা।
‘দায় ও দরদের’ সমাজ গড়ায় নেতৃত্ব দিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন দল গঠনের পথে রয়েছে।
আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিবাদী’ ব্যবস্থাকে চিরতরে বিদায় করার পাশাপাশি আর যেন কর্তৃত্ববাদী কোনো ব্যবস্থা মানুষের ওপর চেপে বসতে না পারে সেজন্য ‘অনুগত’ কর্মী নয়, দক্ষ নেতা তৈরি করতে চায় ক্ষমতার পালাবদলের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি।
গণআন্দোলনের তোড়ে আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের সমালোচিত ও বিতর্কিত শাসন ধসে যাওয়ার পর দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসের’ অভিযোগে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আন্দোলনের সময় হত্যা, ‘গণহত্যা’, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মামলা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে।
তাদের বিচারের আগে আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে ফিরতে পারবে কি না, অথবা বিচার হওয়ার পর কীভাবে ফিরবে সেই আলোচনা আছে। নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
সংস্কারের মধ্য দিয়ে ‘মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার’ রাজনৈতিক কাঠামো গড়ার কাজ শুরু করার পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন করে জনগণের নির্বাচিত নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।
সরকারের এই চাওয়ার সঙ্গে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির মতভিন্নতা রয়েছে। সংস্কার কে করবে, তা নিয়েও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপিরও ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে। সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আরো অনেক দল।
অন্তর্বর্তী সরকার চার মাস পার করেছে, ঘোষণা করতে পারেনি নির্বাচনের রোডম্যাপ, তারপরও রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাস, ২০২৫ সাল তাদের আলোর মুখ দেখাবে।
রাজনীতির যোগ-বিয়োগ এবং গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ ও মানুষের মধ্যে থাকা আলোচনার প্রেক্ষাপট বলছে, নতুন বছরটি নানা দিক থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জের হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো ‘এখন যেসব সংস্কারের কথা বলছে’, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ‘সেগুলো করেনি বলেই এটা দরকার হয়েছে’ মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
তিনি বলেন, “২০২৬ সালের প্রথম দিকেই নির্বাচন দেওয়া হবে বলে শোনা যাচ্ছে। ফলে গণঅভ্যুথানের মধ্য দিয়ে আমরা যে একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের পথে হাঁটছি, তাতে কেবল নির্বাচন দিলেই সেটি সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। আমাদের নীতিগত অবস্থান বা বোধ তৈরির কাজটিও করতে হবে।”
‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নতুন চিন্তা’
জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হবে, এমন খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। ভিন্ন বৈশিষ্ট ও চিন্তার জ্বালানি নিয়ে দল গঠনের বিষয়ে ছাত্রনেতারা বলছেন, নতুন দলের মূল লক্ষ্য হবে জনগণের আস্থা অর্জন করা।
‘জনশক্তি’ নামে দল গঠনের খবর আসার পর জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই নামে দল গঠনের সিদ্ধান্ত কিংবা আলোচনা হয়নি।
তবে আগামী দুই মাসের মধ্যে একাধিক নতুন রাজনৈতিক দল আসবে, সম্প্রতি পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে সারজিস আলমের এমন বক্তব্য, দেশের রাজনীতির মাঠে নতুন দলের আগমনের যে সম্ভাবনা, তার পালে নতুন করে হাওয়া দিয়েছে।
দলের সম্ভাব্য নাম এখনো ঘোষণা করা না হলেও উদ্যোক্তা আরেক সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর ভাষ্য, “এই দলটি হবে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে। এখানে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদী কাঠামোর কোনো স্থান থাকবে না। পুরনো সমস্যা, যেমন- টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জনআকাঙ্ক্ষার বিপরীত কর্মকাণ্ড বা কোনো বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে তারা হাঁটবে না।”
‘রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা’ পূরণের কোন পর্যায়ে আছেন- এমন প্রশ্নে তিনি খোলাসা করে কিছু বলেননি।
“গত ৫৩ বছরের যে চর্চাটা ছিল, সেটা ফ্যাসিবাদী সিস্টেমে রূপ লাভ করেছিল। এখান থেকে বের হওয়ার জন্য বাংলাদেশ খুব উদগ্রীব হয়ে ছিল। সেজন্য তারা মাঠে নেমে এসেছিল। আগামীতে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হবে, সেই প্রক্রিয়ায় এই মানুষগুলো অংশ নেবে। আমরা সবাই একসাথে কাজ করব। যত দ্রুত সম্ভব আমরা আমাদের ডটগুলো একত্রিত করতে সক্ষম হব, তত দ্রুত আমরা সামনে এগিয়ে যাব,” বলেন নাসীরুদ্দীন।
নতুন এ রাজনৈতিক দলটি কেমন হতে পারে? ছাত্রনেতারা বলছেন, তারা এতদিনের প্রচলিত রাজনীতির ধারা থেকে ‘আলাদা কিছু’ উপস্থাপন করবেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, “নতুন যে রাজনৈতিক দল আসবে, আমরা আশা করছি তারা কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। কাজের মাধ্যমে প্রমাণ দেবে। এই দলকে জনগণের প্রত্যাশা বুঝতে হবে। বিগত সময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য দলগুলো জনগণের প্রত্যাশা বুঝতো না। আশা করি, এই দল তেমন হবে না।”
নতুন রাজনীতির ঘোষণায় কোন আদর্শ স্থান পায় তা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে চান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর অভ্যুত্থানের বিভিন্ন মতাদর্শের একসঙ্গে যুক্ত থাকার চর্চাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।
সাবেক ছাত্র নেতা ও ১৯৮৯-৯০ মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি তারা নতুন কোনো রাজনীতি আনতে পারে, যেটা পুরোনো দিনের রাজনৈতিক পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠতে পারে সেটা দেখার বিষয়। এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু তো আমরা দেখছি না।
“এখন দেখার বিষয় হচ্ছে যে, তারা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দর্শনকে সামনে আনছে। কারণ পূর্বতন পরিচয়ে বিপরীত মেরুর লোকজন এখন একসাথে আছে। একসাথে কমন পয়েন্টে আন্দোলন হতে পারে, অতীতেও এমনটা হয়েছে। কিন্তু একটা রাজনৈতিক দল যদি একটা ঐক্যের জায়গা আনতে পারে সেটা ইন্টারেস্টিং। সেটা দেখার বিষয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব আমরা।”
তরুণদের নতুন দল গঠনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুলাই পরবর্তী সরকারকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক হতে হবে। এই ব্যাপারে কোনো ‘যদি’ অথবা ‘কিন্তু’র সুযোগ নেই।
“তার কারণ হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট তা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক… এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। যেই ছাত্ররা ১৫ বছরে ফ্যাসিজমকে প্রতিহত করেছে আমি মনে করি, সেই ছাত্রদের হাত দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল আসতে পারে।”
“সেই সাথে এই রাজনৈতিক দল যাতে কিংস পার্টিতে পরিণত না হয় কারণ, তাদের মাথার উপর এই গভার্নমেন্ট বেশিদিন থাকবে না।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গভার্নমেন্ট ও পলিটিক্স বিভাগের শিক্ষার্থী বদর উদ্দিন বলেন, “১/১১ এর বিরাজনীতিকরণ তথা টু মাইনাস থিওরির বাস্তবায়ন করতে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার ‘কিংস পার্টি’ করেছিল। কিন্তু জনগণ সেই টু-মাইনাস থিওরি প্রত্যাখান করেছিল, কিংস পার্টিও আর কোনো কুলকিনারা পায় নাই।
“এখনও সেই একই কাণ্ড শুনছি… গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে এই দল গঠনের কাজ চলছে।”
আওয়ামী লীগের সামনে অনিশ্চয়তা
গত ৫ অগাস্ট সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন, না হয় ধরা পড়েছেন। বেশির ভাগই আত্মগোপনে।
দলটির ঢাকার ধানমণ্ডি ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কার্যালয় এখন পরিত্যক্ত। সারা দেশে কার্যালয়গুলোও দখল হয়ে গেছে, অথবা ভাঙচুরের শিকার হয়েছে।
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটিও এখন ধ্বংসস্তূপ।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে যা দেখা যায়নি, ২০২৪ এ তাই দেখেছে বাংলাদেশ। স্বৈরশাসক হু. মো. এরশাদের পতন ঘটার পর তিনি পালিয়ে না গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
নব্বইয়ের আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত জাতীয় পার্টি অংশ নিয়েছিল, এরশাদ যে দলটি গড়েছিলেন সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় এসে।
কিন্তু আওয়ামী লীগকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের ভাষ্য, বিচারের আগে দলটিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া আন্দোলনে নিহত ছাত্র-জনতার রক্তের সঙ্গে ‘বেঈমানি’ করার সামিল।
তবু, সংবাদমাধ্যমে আসা শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্যে বিবৃতিতে থেকে রাজনীতিতে ফেরার কথা শোনা গিয়েছিল।
১৫ অগাস্ট ঢাকার ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছে হামলার মুখে পড়েন দলের নিচের সারির নেতা ও সাধারণ কর্মীরা।
গত নভেম্বরে নূর হোসেন দিবসে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগকে পিছু হটতে হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর প্রতিরোধের মুখে।
ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পরের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ যে চেতনায় ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করেছে, এবার তা একেবারে ভিন্ন।
পুরান ঢাকার বংশাল মোড়ের হার্ডওয়্যারের দোকানের কর্মী শফি মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই এখানে (বংশাল), এমন আওয়ামী লীগার আছে যারা লুটপাট করে মোটাসোটা হয়েছেন, তারা এখন আওয়ামী লীগ পরিচয় দিতে ভয় পান।”
ষাট বছর বয়েসী শফি বলেন, “তবে আমরা যারা সুবিধা পাইনি, এমন কর্মী-সমর্থকরা বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ পরিশুদ্ধ হয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াবে।”
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, দলটির নেতা-কর্মীদের ‘ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য’ তাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার বিচারের উদ্যোগ, সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নেওয়া, আদালতে হেনস্তা ইত্যাদি ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সমর্থক, শান্তিনগরের বাসিন্দা এইচএম ইসহাক মনে করেন, এসবে বরং আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের ‘সহানুভূতি’ বাড়ছে।
রাজনীতিরে মাঠে ফেরার বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই দেশে আওয়ামী লীগের মত বড় দলকে বাইরে রেখে কিছু করা সম্ভব নয়। অতীতের মত আবার ঘুরে দাঁড়াবে দল।”
অন্য অধ্যায়ে বিএনপি-জামায়াত
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর রাজনীতিতে ‘বহুদলীয়’ চর্চার সূত্রপাত ঘটানোর কৃতিত্বের দাবিদার বিএনপি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলেই জামায়াতে ইসলামী আবার বাংলাদেশ রাজনীতি করার সুযোগ পায়।
নব্বইয়ের পালাবদল দুটি দলকে কাছে আসার সুযোগ করে দেয়। বিএনপির বিগত জোট সরকারেও প্রধান শরিক ছিল জামায়াত। ২০০৯ সালে থেকে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও বিএনপির জোটে ছিল দলটি।
তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার পর বিএনপি ও জামায়াতের মৈত্রীর বন্ধন আলগা হতে শুরু করে।
তখন বিএনপি বলেছিল, জামায়াতনির্ভরতা কাটানো এবং রাজনীতিতে ‘বিএনপি-জামায়াত’ নামে যে নেতিবাচক প্রচার রয়েছে, সেটি কাটানোও জোট ভেঙে যুগপৎ আন্দোলনের পথে হাঁটার অন্যতম লক্ষ্য।
বিএনপি জামায়তের সেই ছাড়াছাড়ি আর জোড়া লাগেনি। বরং এখন দুটি দলের অবস্থান দুই মেরুতে। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে তাদের আলাদা অবস্থান দেখা গেছে।
‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’, ‘নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো নয়’– তিন মাস ধরে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এমন কথা বলে এলেও নভেম্বরের শেষে দলটির নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান ‘যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার শেষ করে’ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন।
২১ ডিসেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক সভায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, “আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৫ সালের মধ্যেই হতে হবে। এর মধ্যেই শেষ করতে হবে সব সংস্কার। আশা করি, প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার শেষ করেই ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবেন “
অন্যদিকে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। ২৭ ডিসেম্বর ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত সংলাপে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “সংস্কার নিয়ে যত বেশি সময় যাবে আমার কাছে মনে হয়, আমাদের কাছে মনে হয় যে, সমস্যাগুলো তত বাড়বে।”
চাঁদাবাজি দখলবাজির অভিযোগ নিয়েও দুই দলের নেতাদের বাহাস দেখা গেছে।
২৯ ডিসেম্বর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভী জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা কীভাবে ইসলামী ব্যাংক গ্রাস করে নিল জনগণ দেখেছে।”
রিজভীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। এক বিবৃতি বলেছেন, “জামায়াতের রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এ ভূমিকা জাতি গ্রহণ করেছে। এ কারণেই সম্ভবত রিজভীর গাত্রদাহ হয়েছে।”
নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে
‘জাতীয় ঐক্য’ সৃষ্টির লক্ষ্যে দুইদিনের জাতীয় সংলাপ করেছে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ (এফবিএস)। ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ শীর্ষক সংলাপে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
‘ফ্যাসিবাদী কাঠামোতে রূপান্তরিত’ হওয়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কার না করে নির্বাচন দিলে সেই গণতন্ত্রের সুফল জনগণ পাবে না বলে মত এসেছে ওই জাতীয় সংলাপে।
কয়েকজন আলোচক অভিযোগ করেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চার মাসের মধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র সংস্কার ও নির্বাচনকে ‘মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে’।
বিজয় দিবসের দিন জাতির উদ্দেশে ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সীমা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্য্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হতে পারে।
পরদিন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেন, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে কম সংস্কার হলে তা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হতে পারে।
তাদের বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় হতাশার কথা জানায় বিএনপি। দলটি বলছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তা না হলে সমস্যা বাড়তে থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসে নানা ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শেখ হাসিনা সরকার হটানোর আন্দোলনে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, এই সরকারকে ব্যর্থ করতে পতিত আওয়ামী লীগের ‘দোসররা’ বিভিন্নভাবে চক্রান্ত করছে। একে রুখতে হলে দ্রুত নির্বাচন জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাইসা তাব্বাসুম বলেন, “একটা ক্রেডিবেল ইলেকশন (বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন) করতে হলে বর্তমান যে নির্বাচন ব্যবস্থা আছে তা সংস্কার করতে হবে। বিগত সরকার টানা ক্ষমতায় থেকে এই ব্যবস্থা ধবংস করে ফেলেছে।
“সেজন্য এখন যেটা জরুরি, সেটা হচ্ছে নির্বাচনী সংস্কারগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে শুরু করা। তা না হলে নতুন বছরের মধ্যে একটা নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে- তারা দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দিতে চায় কিনা।”
বিএনপিসহ ৬২টি ছোট-বড় রাজনৈতিক দল ও জোট সংস্কারের নানা প্রস্তাব ইতোমধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর কাছে জমা দিয়েছে।
বিএনপি মনে করে, সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। এর জন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন। সে কারণে, নির্বাচিত সংসদে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সংস্কার বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।
২০২৫ সালে ভোটের চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি গোছাতে সমঝোতাকে অগ্রাধিকার দিতে চান কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, “আমি এখন নির্বাচনের পক্ষে নয়। আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে আমরা একটা রিকনস্ট্রাকশন বা রিকন্সিলেশন কাউন্সিল গঠন করতে পারি।
“আমাদের মধ্যে যে ক্ষতটা তৈরি হয়েছে, আমরা যে বিভক্ত হয়ে আছ, এটাকে যেন দ্রুত কাটাতে পারি, নিরাময় করতে পারি সেই কাজটাই এখন করা জরুরি।”
‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পথ খুলেছে’
ছাত্র-জনতা রক্তঝরা অভ্যুত্থানের পরে দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল একটি ‘নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে।
তবে নতুন ভোটার নীলফামারীর টুনিরহাটের আরমান আলী ভালভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পরের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। যেনতেন প্রকারে আর নির্বাচন করা যাবে না।
“রাজনীতির যোগ-বিয়োগে এবার ভোটের সমীকরণ আগের মতো হবে না। লাইনে দাঁড়াইয়া ভোট দিতে হইব, কেরামতির দিন শেষ। আমরা যারা নতুন ভোটার তাগো ভোটের দাম বেশি। এবার বাকিটা বুইজ্জা নেন।”
এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছিল, ১৭ ডিসেম্বর তার কিছু অংশ বাতিল ঘোষণা করেছে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।
এ রায়ের ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের যে বিধান আওয়ামী লীগ করেছিল, তা বাতিল হয়ে সেখানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরার পথ খুলেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেছেন, হাই কোর্টের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার পথ খুলেছে, তার সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা ‘সাংবিধানিকভাবে সাংঘর্ষিক হবে না’।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসে। ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়।
এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে টানা পনের বছরের বেশি ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। সর্বশেষ এই বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয় দলীয় সরকারের অধীনে।
১৯৯০ সালে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর প্রধান দুই বিরোধী দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। দেশের ইতিহাসে তার নেতৃত্বাধীন ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।