রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদও এখনকার পাঁচ বছরের বদলে চার বছর করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
Published : 15 Jan 2025, 08:35 PM
সংসদের মেয়াদ চার বছর করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ দুইবার দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন; একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পদের শূন্যতায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে গঠিত হবে সেটির সাংবিধানিক রূপরেখাও প্রস্তাব করেছে তারা।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা তুলে দেন কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল, প্রধানমন্ত্রী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিভিন্ন রূপরেখা প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সংবিধান সংস্কারের এ কমিশন গঠন করেছে।
এ কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়ার কথা জানান আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আইনসভার নিম্নকক্ষে যে সদস্যের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন আছে তিনি সরকার গঠন করবেন। নাগরিকতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা দ্বারা প্রয়োগ করা হবে।
কমিশন সুপারিশ করেছে, “একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুইবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
“তিনি একাদিক্রমে দুই বা অন্য যে কোনোভাবেই এই পদে আসীন হন না কেন তার জন্য এ বিধান সমভাবে প্রযোজ্য হবে।”
প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না, এমন সুপারিশও করা হয় প্রতিবেদন।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে সংসদ ভেঙে দেওয়ার উপায় হিসেবে বলা হয়, “আইনসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে যদি কখনও প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা আস্থা ভোটে হেরে যান কিংবা অন্য কোনও কারণে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতির নিকট এটা স্পষ্ট হয় যে, নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সমর্থন অর্জন করতে পারছেন না, তবেই রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন।”
রাষ্ট্রপতির মেয়াদও চার বছর, নতুন নির্বাচন পদ্ধতি
রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদও এখনকার পাঁচ বছরের বদলে চার বছর করার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রপতিও সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলে প্রস্তাব করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের নতুন পদ্ধতি অবলম্বনের সুপারিশ করে সংস্কার কমিশন বলছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেক্টোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন।
কোন ভোটারদের সমন্বয়ে নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হবে, সেই ধারণা দিয়ে সুপারিশে বলা হয়, আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্য প্রতি একটি করে ভোট; প্রতিটি 'জেলা সমন্বয় কাউন্সিল' সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট [উদাহরণ: ৬৪টি 'জেলা সমন্বয কাউন্সিল' থাকলে ৬৪টি ভোট]; এবং প্রতিটি 'সিটি কর্পোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল' সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট।
রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের পদ্ধতি হিসেবে কমিশন সুপারিশ করেছে, “রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে।
“নিম্নকক্ষ অভিশংসন প্রস্তাবটি পাস করার পর তা উচ্চকক্ষে যাবে, এবং সেখানে শুনানির মাধ্যমে অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।”
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল
কমিশন রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে নয় সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছে।
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি’ গঠনের এ সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশনে থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয়কক্ষের কোনো একজন সংসদ সদস্য।
সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের বাইরে আইনসভার উভয় কক্ষের বাকি সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তাদের মধ্য থেকে ওই সদস্যকে মনোনীত করবেন।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, “উক্ত ভোট আইনসভার উভয় কক্ষের গঠনের তারিখ থেকে ৭ (সাত) কার্য দিবসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
“জোট সরকারের ক্ষেত্রে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল ব্যতীত জোটের অন্য দলের সদস্যরা উক্ত মনোনয়নে ভোট দেওয়ার যোগ্য হবেন।”
আইনসভা ভেঙে গেলেও, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শপথ না নেওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান এনসিসি সদস্যরা কর্মরত থাকবেন, এমন প্রস্তাব করে সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছে, আইনসভা না থাকাকালীন এনসিসির রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদের দুইজন সদস্য হবেন এনসিসির সদস্য।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, এনসিসি নিম্নলিখিত পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে।
নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; অ্যাটর্নি জেনারেল ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল; সরকারি কর্ম কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার; প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো পদে নিয়োগ।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন
আইনসভার মেয়াদ শেষ হবার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত, একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে বা আইনসভা অকালে ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে সুপারিশে।
সেখানে বলা হয়, “এই সরকারের প্রধান 'প্রধান উপদেষ্টা' বলে অভিহিত হবেন। আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ (পনের) দিন পূর্বে অথবা আইনসভা ভেঙে গেলে, পরবর্তী অন্যূন ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা সর্বোচ্চ ১৫ সদস্যের একটি উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে কার্য পরিচালনা করবেন, এমন সুপারিশ করেছে আলী রীয়াজ কমিশন।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, “অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৯০ দিন হবে, তবে যদি নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হয় তবে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণমাত্র এই সরকারের মেয়াদের অবসান ঘটবে।”
প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) সিদ্ধান্তসহ মোট সাতটি পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
>> কমিশনের সুপারিশের ৪.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, “এনসিসির নয় সদস্যের মধ্যে নূন্যতম সাত সদস্যের সিদ্ধান্তে এনসিসির সদস্য ব্যতিত নাগরিকদের মধ্য হতে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।”
>> অনুচ্ছেদ ৪.১ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না হলে, সকল অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্য থেকে একজন গ্রহণযোগ্য এনসিসির ৯ (নয়) সদস্যের মধ্যে নূন্যতম ৬ (ছয়) সদস্যের সিদ্ধান্তে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
>> উপরের অনুচ্ছেদ ৪.২ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না হলে, এনসিসির সব সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
>> উপরের অনুচ্ছেদ ৪.৩ অনুযায়ী এনসিসি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন।
>> উপরে উল্লেখ করা অনুচ্ছেদ ৪.৪ অনুযায়ী যদি উক্তরূপ সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে না পাওয়া যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হন, তা হলে তার অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। একইভাবে তাকেও না পাওয়া গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হলে পর্যায়ক্রমে অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হবেন।
>> উপরের অনুচ্ছেদ ৪.৫ অনুযায়ী যদি কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হন, তবে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন।
>> উপরের অনুচ্ছেদ ৪.৬ অনুযায়ী যদি উক্তরূপ আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হন, তা হলে তার অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারক প্রধান উপদেষ্টা হবেন। একই ভাবে তাকেও না পাওয়া গেলে অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে অসম্মত হলে পর্যায়ক্রমে অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারক প্রধান উপদেষ্টা হবেন।
সংবিধান সংস্কার: রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম বদলের সুপারিশ