সরকারকে ‘গণবিচ্ছিন্ন’ আখ্যা দিয়ে ফখরুল অভিযোগ করেছেন, তারা গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে।
Published : 31 Jul 2024, 08:23 PM
কোটা সংস্কারের চলমান ছাত্র-গণআন্দোলনে ‘সরকার দিশেহারা’ হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বুধবার বিকালে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারের দমনপীড়নের অভিযোগ সামনে এনে এমন মন্তব্য করেছেন তিনি।
সরকারকে ‘গণবিচ্ছিন্ন’ আখ্যা দিয়ে ফখরুল অভিযোগ করেন, তারা গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে।
তারা ভাষায়- আন্দোলন দমনে নির্বিচার হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারযোগ্য অপরাধ।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা বলতে চাই, এই ‘নির্লজ্জ’ সরকার যতই ‘মিথ্যাচার’, সাজানো মামলায় ‘নির্বিচারে’ গ্রেপ্তার অব্যাহত রাখুক না কেন, কোনো কিছুতেই ছাত্র-গণআন্দোলনে ‘দিশেহারা’ আওয়ামী লীগ সরকার তার পতন ঠেকাতে পারবে না।”
জনসাধারণের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, ‘‘সুশীল সমাজসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ যেভাবে সাহসের সাথে সরকারের অন্যায়-অবিচার, ‘গণ-হত্যা’র বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, তেমনি এর ধারাবাহিকতায় আপামর জনসাধারণের প্রতি আহ্বান থাকবে, আসুন আপনারাও আরও ব্যাপকভাবে রাজপথে নেমে আসুন।
“রাজপথে চলমান ছাত্র-গণআন্দোলনে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করে রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে সকল অন্যায়, অবিচারের অবসান ঘটাতে আপনারা সহযোগী হোন।”
গ্রেপ্তারকৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি, সান্ধ্য আইন (কারফিউ) প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিও করেন বিএনপি মহাসচিব।
‘সরকার যা ইচ্ছা করছে’
ফখরুল অভিযোগ করেছেন, গণবিচ্ছিন্ন সরকার আইন, সংবিধান, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি, মানবিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে জনরোষ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সুবিধা ও ইচ্ছামাফিক যা ইচ্ছা তাই করছে। এসব করতে গিয়ে তারা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও মানবিক চরিত্র গুম করেছে।
তার ভাষায়- গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে সরকার ‘বর্বরভাবে’ নস্যাৎ করতে গিয়ে দেশকে ‘একনায়কতন্ত্র’ এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব। শিক্ষার্থী মাসরুর হাসানের নিখোঁজ থাকার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এখনও অনেক অভিভাবক তার শিক্ষার্থী সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছে না। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসরুর হাসানকে ডিবি গত ২৫ জুলাই রাতে তুলে নিয়ে আসলেও তার অভিভাবকরা থানা, ডিবি অফিস, বিভিন্ন হাসপাতালে তার কোনো খোঁজ না পেয়ে গতকাল (মঙ্গলবার) রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করতে এলে মাসরুরের বাবা ও ভাইকে ডিবি সেখান থেকে তুলে নিয়ে যায়।”
এরকম অসংখ্য শিক্ষার্থীদের খোঁজ তাদের অভিভাবকরা না পেয়ে উদ্বিগ্ন, অসহায় অবস্থায় আছেন বলে অভিযোগ করেছেন ফখরুল।
“আটকের ২৪ ঘণ্টা মধ্যে আদালতের সামনে হাজির করার আইন থাকলেও ডিবি হেফাজতে ৪৫ দিন রেখে বেআইনি কাজ করছে ‘গণবিরোধী’ সরকার। শুধু তাই নয়, আবার আটক না করেই নিরাপত্তার নামে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডিবি অফিসে তুলে এনে তাদের জিম্মি করে রেখেছে। আইনি ভিত্তি ছাড়াই হেফাজতের কাহিনি নজিরবিহীন।”
‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও পুলিশি হামলা’
বিবৃতিতে ফখরুল বলেন, নিজেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগের ক্যডার দিয়ে ‘গণহত্যা’, নৈরাজ্য চালিয়ে ‘নির্লজ্জ’ সরকার লোক দেখানো রাষ্ট্রীয় শোকের নামে মায়াকান্না করলেও প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে গতকাল (মঙ্গলবার) যে অভূতপূর্ব ‘লাল ডিজিটাল প্রতিবাদ’ করেছে, তাতে আপামর জনসাধারণের ঐক্য জানান দিয়েছে। জনগণ ‘খুনি’ সরকারের লোক দেখানো রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে তাদের দায়ী করে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
বুধবারের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি সম্পর্কে ফখরুল বলেন, “আজও ঢাকা, চট্ট্রগাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে 'মার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, গ্রেপ্তার-নির্যাতন করে বাধা প্রদান করে।
“আদালত চত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা জনগণের সমর্থনে 'মার্চ ফর জাস্টিস' কর্মসূচি পালন করে হত্যার বিচার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি করেছে। শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচি পালনেও সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বাধা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোক আহত হয়েছেন।
“আমরা পুলিশের এহেন কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাই।”
‘জনগণের বিরুদ্ধে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে’
বিএনপি মহাসচিবের অভিযোগ, কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলি চালানোর প্রমাণ থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার না করে অপরাধীকে খুঁজে বেড়ানো এবং ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান উপহাসমাত্র। সরকারের নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা নির্বিচারে গুলি করে শত শত ছাত্র-জনতার প্রাণ কেড়ে নিয়ে ‘গণহত্যা’ চালিয়েছে, এটা প্রমাণিত সত্য।”
“সরকার জনগণের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সরকার নিজেদের রক্ষার জন্য প্রকৃত হত্যাকারীদের না ধরে বিরোধী দলের ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ছাত্র-গণআন্দোলন বন্ধ করতে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বন্ধ, সান্ধ্য আইন জারি ও সেনাবাহিনী নামিয়ে ‘গণগ্রেপ্তার’ করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকার প্রতিদিনই সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিএনপি ও বিরোধী অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার করে রিমান্ডে রেখে নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে,” অভিযোগ করে বলেন ফখরুল।
বিএনপি মহাসচিবের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনই ‘মিথ্যা’ মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব মিথ্যা মামলায় আসামি কারা, অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদীই তা জানেন না। মৃত ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থান করছেন এমন অনেককেই এসব মামলার আসামি করা হচ্ছ।
এমন মামলায় সাভারের মৃত আজগর আলী, বিদেশে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সাবেক প্রধান হুইপ জয়নুল আবেদীন ফারুকসহ অনেককে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ফখরুল।
“এমনকি অন্য একটি মামলায় সাত মাস আগে মৃত্যুবরণকারী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। গতকাল (মঙ্গলবার) পুলিশ প্রয়াত আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করতে তার বাসায় হানা দেয়।”
আন্দোলনের আগে থেকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ক্যান্সারে আক্রান্ত, তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করলেও এবং বিএনপির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মোরশেদ হাসান খান ক্যান্সারে আক্রান্ত তার স্ত্রীর চিকিৎসায় ব্যস্ত থাকলেও তাদের বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হানা দিচ্ছ বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।
একজন বিচারপতির শিক্ষার্থী ছেলেকেও মিথ্যা মামলায় আটক করে রিমান্ডে নিয়ে হয়রানি নির্যাতন করা হয়েছে অভিযোগ করে ফখরুল বলেন, “এ ধরনের হয়রানি, নির্যাতনের শত শত ঘটনা আছে, যার বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। এসব ঘটনা শুধু নির্দয়, অমানবিকই নয়, সরকারের ‘নির্লজ্জ’ প্রতিহিংসা ও ‘ফ্যাসিবাদী’ চরিত্রের বর্হিপ্রকাশ।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকার ৫০টি থানায় ৫৩টি হত্যা মামলাসহ ২৬৪টি মামলা হয়। এসব মামলায় ২ হাজার ৮৫০ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা ও প্রাণহানির জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে সরকার বলছে, এর মাধ্যমে তারা সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করেছিল। তাদের বিচার করা হবে।
আন্দোলনে সহিংসতা ও খুনের জন্য সন্দেহভাজন বিএনপি-জামায়াতের সন্দেহভাজন নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তবে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে দল দুটি। এর মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দলটি নিষিদ্ধ করা হবে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে তাতে সর্বাত্মক সমর্থন দেয় বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো।