নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে থেকেই তা আদায়ের ঘোষণা দিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
Published : 13 Dec 2014, 01:43 PM
শনিবার নারায়ণগঞ্জের কাচপুরের জনসভায় তিনি বলেছেন, “১২ মাস সময় দিয়েছি, আলোচনা করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করার। কিন্ত আপনারা আমাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি। এই অবস্থায় আমদের আর বসে থাকার সময় নেই।
“দেশবাসী, মা-বোনদের বলব, আমি যখন আহ্বান জানাব, তখন সবাইকে এবার রাস্তায় নেমে আসতে হবে। যেখানে যে অবস্খায় থাকেন, যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। যতদিন প্রয়োজন রাস্তায় থেকে দাবি আদায় করে ছাড়ব।”
বিভিন্ন জেলায় জনসভার পর আগামী জানুয়ারিতে কর্মসূচি ঘোষণার ইঙ্গিত দিয়ে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী খালেদা জিয়া ইতোপূর্বে বলেছেন, তিনি নিজেই এবার রাজপথে থাকবেন।
সরকারকে হুঁশিয়ার করে কাচপুরে ২০ দলের জনসভায় তিনি বলেন, “আবার বলছি. এখনও সময় আছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে সরে পড়ুন। নইলে আপনাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ ও খারাপ।”
জনসভায় বক্তব্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচনা করে তাদের হটাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন।
গ্যাস-বিদ্যুৎসহ জ্বালানির দাম বাড়ানো হলে তার পরদিন থেকেই আন্দোলন শুরু হবে বলে আগাম ঘোষণা দিয়ে রাখেন তিনি।
“আমি সরকারকে স্পষ্টভাষায় হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, বিদ্যুৎ-গ্যাস-জ্বালানি তেলের দাম কোনোভাবেই বাড়ানো যাবে না। যেদিন থেকে বাড়ানো হবে, তার পরদিন থেকেই শুরু হবে আন্দোলন।”
বিদ্যুত খাতে সরকারের দুর্নীতি রয়েছে অভিযোগ করে খালেদা বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও এক্ষেত্রে বাংলাদেশে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। গ্যাসের দামও কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে।”
৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর ঢাকার বাইরে এটা ছিল খালেদা জিয়ার দশম জনসভা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন বালুর মাঠে এই জনসভার কারণে মহাসড়কে দুপুর থেকে ছিল যানজট।
নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা ও নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে আসা মিছিলে বালুর মাঠ ভরে যাওয়ায় জনসমাগম ছড়িয়ে ছিল মহাসড়কের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায়।
নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষের সঙ্গে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বড় বড় ছবি হাতে আসা অনেক মিছিলে বাদক দলের উপস্থিতিও দেখা যায়।
জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি খচিত কয়েকটি বেলুনও ওড়ানো হয় জনসভাস্থলে। ২০ দলের শরিক জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত তাদের নেতা মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, এম কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলীর ছবি সম্বলিত বেলুনও ওড়ায়।
জনসভার পূর্ব পাশে মঞ্চের পাশেই টানানো ছিল বিশাল ব্যানার, যাতে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত খুনের ঘটনায় নিহত সাতজনের ছবির ওপর বড় অক্ষরে লেখা- ‘এই জুলুমের দৃশ্য দেখার জন্য কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। মানবতার কি নিষ্ঠুর আঘাত হায়েনারদের’।
ওই ব্যানারে এক পাশে পুরান ঢাকায় ছাত্রলীগের হামলায় নিহত বিশ্বজিত দাস এবং সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত কিশোরী ফেলানীর কাঁটাতারে ঝুলে থাকা লাশের ছবিও ছিল।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই জনসভায় খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পর খেলাফত মজলিশের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইসহাক বিশেষ মোনাজাত করেন।
খুনিরা ‘জামাই আদরে’
নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামিরা সরকারি মদদ পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপাসন। র্যাবের কর্নেল জিয়াউল আহসানকে গুম-হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে তার গ্রেপ্তার দাবিও করেন তিনি।
খালেদা বলেন, “নারায়ণগঞ্জে ১১ জনকে খুন করা হয়েছে। এখনও খুনিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। এই খুনের বিচার হয়নি। লোকদেখানো কয়েকজকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। র্যাবের যে ক’জনকে ধরা হয়েছে, তাদের কারাগারে জামাই আদরে রাখা হয়েছে।”
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালককে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জের খুনের সঙ্গে যার নাম এসেছে, র্যাবের জিয়াকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি।
“তাকে গ্রেপ্তার করলে কেবল নারায়ণগঞ্জের ১১ খুনই নয়, দেশের সব খুন-গুমের ঘটনা বেরিয়ে আসবে। সেজন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। আমি অবিলম্বে তাকে চাকরিচ্যুত করে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।”
গত নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের ৩১০ নেতা-কর্মীকে হত্যা এবং ৬৫ জনকে গুম করা হয়েছে বলে দাবি করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনাকে দায়ী করে তিনি বলেন, এর বিচার একদিন হতেই হবে।
সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি ও গণবাহিনী সৃষ্টিকারী দল জাসদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মিত্রতার সমালোচনাও করেন খালেদা।
বিএনপিকে স্বাধীনতার সপক্ষের দল দাবি করে তিনি আবার বলেন, “আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তারা সীমান্ত পাড়ি দেওয়া দল। স্বাধীনতার সপক্ষের দল তারা নয়। এখন তারা বড় বড় কথা বলে।”
জয় প্রসঙ্গে
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম উল্লেখ না করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “পত্রিকায় এসেছে, তার ছেলে ২ লাখ ডলার বেতন নিচ্ছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। কী অ্যাডভাইজারি করে যে তাকে এত বেতন দিতে হয়? বাংলাদেশের কোনো অ্যাডভাইজরের এত বেতন আছে কি?
“এরা খুনি, লুটপাটকারী। এদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বিদেশে থাকার বিষয়টি তুলে ধরে খালেদা বলেন, “হাসিনার পরিবার বিদেশে থাকে। তাদের দেশের প্রতি কোনো দরদ নেই।”
ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সতর্ক করে তিনি বলেন, “সামনে আওয়ামী লীগের বড় দুর্দিন আসছে। বড় বড় নেতারা নিজেদের পকেটে পাসপোর্ট ও টিকিট নিয়ে রেখেছেন। কর্মীদের বলব, বড় নেতারা দুর্দিনে উডে যাবে, আপনারা পড়ে থাকবেন।”
‘এভাবে চলতে পারে না’
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দলীয়করণের অভিযোগ তুলে সাম্প্রতিক কথিত বৈঠক নিয়ে প্রশাসনের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদও জানান খালেদা।
“কিছুদিন আগে আমার সাথে বৈঠকের মিথ্যা অভিযোগে এনে একজন যুগ্ম সচিবকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, ভালো ও দক্ষ কর্মকর্তাদের যাদের ওএসডি করে রাখা হয়েছে, তাদের আমার সঙ্গে বৈঠকের মিথ্যা অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা।”
পুলিশ বাহিনীতেও গোপালগঞ্জ জেলার বাসিন্দা ও ছাত্রলীগের নেতাদেরই শুধু নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে বিএনপি চেয়ারপারসনের দাবি।
বিচার বিভাগের উদ্দেশে তিনি বলেন, “জজ সাহেবদের বলতে চাই, কিভাবে প্রধানমন্ত্রীর ১৫টি মামলা আপনারা প্রত্যাহার করে দিলেন।
“বিচারপতিদের বলব, আপনারা ভাববেন না, এটা শেষ দুনিয়া। এই দুনিয়ার পর আরেকটি দুনিয়া আছে। আল্লাহকে ভয় করুন। আপনারা যে অন্যায় করেছেন, অবিচার করেছেন, এর জন্য অনেকে বেশি কঠিন শাস্তি আল্লাহর কাছ থেকে পাবেন।”
আওয়ামী লীগ এ দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “জনগণের প্রতিনিধি না হলে ভাগ-বাটোয়ারার কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে তারা ক্ষমতায় বসে আছে। একের পর এক অবৈধ সংসদে আইন করছে। এভাবে আর চলতে পারে না।”
আন্দোলনের ডাক দেওয়া হলে নামার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান খালেদা।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই জনসভায় খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পর খেলাফত মজলিশের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইসহাক বিশেষ মোনাজাত করেন।
জনসভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আমানউল্লাহ আমান, ফজলুল হক মিলন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মীর সরফত আলী সপু, শিরিন সুলতানা, রাজিব আহসান।
জেলা নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রেজাউল করীম, আতাউর রহমান আঙ্গুর, গিয়া্স উদ্দিন আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, বদরুজ্জামান খসরু, কাজী মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার আবু জাফর, আজহারুল ইসলাম মান্নান, আবুল কালাম আজাদ বিশ্বাস, জাহাঙ্গীর আলম, এটিএম কামাল, শাহ আলম প্রমুখ।
জামায়াতে ইসলামীর মজিবুর রহমান, রিদওয়ান উল্লাহ শাহিদী, বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ন্যাপের জেবেল রহমান গানি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহিউদ্দিন ইকরাম, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক ইয়াছির আরাফাতও বক্তব্য রাখেন জনসভায়।
এলডিপি সভাপতি অলি আহমদ, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, বিএনপির চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, সেলিমা রহমান, আহমেদ আজম খান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, সাইফুল আলম নিরব, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, হেলেন জেরিন খান, শাম্মী আখতার, আমিরুল ইসলাম আলিম, আকরামুল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান ভুঁইয়া দিপু সভায় ছিলেন।