দলীয় চেয়ারম্যানের ‘নির্দেশ অমান্য করে’ যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তাদের ‘আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার’ ভয় দেখিয়ে আনুগত্যে ‘ফিরতে’ বললেন জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
Published : 12 Feb 2014, 12:30 PM
‘নির্দেশ অমান্যকারীদের’ জন্য জাতীয় পার্টির মধ্যে ‘কৃত্রিম’ সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও, পাশে থাকা নেতা কর্মীদের তিনি আশ্বস্ত করেছেন- সংকট, হতাশার মেঘ কেটে যাবে।
নির্বাচনের পর প্রথমবার সাংবাদিকদের সামনে এসে বুধবার দলীয় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত বলেন, “বহুদিন রাজনীতির বাইরে ছিলাম। বিশেষ কারণে তোমাদের সামনে আসতে পারিনি। একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে পার্টিতে। জাতীয় পার্টিকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা চলছে। কিন্তু এটা কৃত্রিম সংকট।”
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে গুলশানের একটি কমিউনিটি সেন্টারে দলের সাংগঠনিক জেলার জেলা প্রতিনিধিদের সঙ্গে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের এই বর্ধিত সভা হয়।
বার বার সিদ্ধান্ত বদলানোর কারণে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হিসাবে পরিচিত পাওয়া এরশাদ বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলতে তিনি আগ্রহী নন।
“অনেক কথা বলার ছিল, বলতে পারছি না। নির্বাচন হয়ে গেল। এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। আমি কেন নির্বাচন করিনি, তাও আজ ব্যাখ্যা করব না, আরেক দিন করব।”
নিজে সাংসদ হিসাবে শপথ নিলেও যারা তার ‘কথা না শুনে’ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করেছেন, এরশাদ তাদের ভয় দেখিয়েছেন ‘ভবিষ্যতের’ কথা বলে। আর এজন্য বর্ধিত সভায় উপস্থিত নেতাকর্মীদের নিয়ে বেশ নাটকীয় এক পরিস্থিতিই তিনি তৈরি করেন।
সাবেক এই সেনা শাসক বলেন, “যারা বন্ধন ছিন্ন করতে চায়, আবার বলছি, ফিরে আস আমাদের কাছে। আগামীতে যারা সুদিন দেখতে চাও, আবার বলছি, ফিরে এসো আমার কাছে। তা না হলে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।আমার অবাধ্য সন্তানের প্রয়োজন নেই।”
আর উপস্থিত কর্মীদের তিনি আশা দেন, “জাতীয় পার্টি আরো শক্তিশালী হবে, আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে।”
এরশাদ গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও তার স্ত্রী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদের ‘নেতৃত্বে’ একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ৩৪টি আসন পাওয়া জাতীয় পার্টিই দশম সংসদের প্রধান বিরোধী দল, আর রওশন বিরোধীদলীয় নেতা।
এরশাদ নিজে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করলেও ‘আইনি মারপ্যাঁচে’ রংপুরের একটি আসন থেকে ভোটে জিতে যান এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পান।
বুধবারের অনুষ্ঠানে এরশাদ, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ও সালমা ইসলাম ছাড়া দলের অন্য কোনো সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন না।
লাঙ্গল নিয়ে নির্বাচন করেও বর্ধিত সভায় না আসায় বিস্ময় প্রকাশ করে অনুপস্থিত নেতাদের উদ্দেশ্যে এরশাদ বলেন, “তোমরা কি ভেবেছ? তোমাদের ছাড়া জাতীয় পার্টি থেমে থাকবে? অচল হয়ে যাবে?
“যারা আসনি, তাদের বলতে চাই, ২০-২২ বছর ধরে বুকের রক্ত দিয়ে এই পার্টিকে লালন করেছি। তোমাদের সবাইকে সন্তান হিসেবে কাছে টেনেছি। আমার নির্দেশ উপেক্ষা করলে তোমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। তোমাদের ছাড়াই জাতীয় পার্টি চলবে।”
এরশাদের নির্দেশ মেনে যারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি- তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আমি নির্বাচনটা করিনি, আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম তোমাদের না করার জন্য। কেন করিনি তা আমি আজ বলব না। তবে চেয়ারম্যান যা বলে তা নির্দেশ বলে মানতে হবে।
এ পর্যায়ে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এরশাদ বলেন, “চেয়ারম্যানের নির্দেশ উপেক্ষো করে যারা নির্বাচনে গিয়েছিল, তারা কি আমাদের প্রিয়পাত্র, তারা কি জাতীয় পার্টিতে থাকবে?”
নেতাকর্মীরা এ সময় শ্লোগান তোলেন- ‘জাতীয় পার্টির দালালেরা হুঁশিয়ার, সাবধান’; ‘অবিলম্বে বেঈমানদের বহিষ্কার করতে হবে’।
এরপর এরশাদ বলেন, “এটাই দেখতে চেয়েছিলাম। নির্দেশ উপেক্ষাকারীরা দেখবে, পার্টি কীভাবে এগিয়ে চলে।”
বহিষ্কারের দাবি তোলা কর্মীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “শোনো, শোনো... উত্তেজিত হয়ো না। সবাইকে একবার ফিরে আসার সুযোগ দেব। তারাও আমার সন্তান, তোমাদের ভাই।”
নিজেকে জাতীয় পার্টির ‘স্রষ্টা’ দাবি করে এরশাদ বলেন, “তোমরা আমার সন্তানের মতো। এই পার্টির স্রষ্টা আমি। বুকের রক্ত দিয়ে লালন করেছি। তারাও (যারা নির্বাচন করেছেন) আমার সন্তানের মতো। তারা ফিরে আসলে সব ভুল ক্ষমা করে বুকে টেনে নেব।”
কর্মীদের তিনি আশ্বস্ত করেন- “মেঘ কেটে যাবে, আমরা রাস্তায় নামব, ভোটারদের কাছে যাব। ইনশাল্লাহ আগামী নির্বাচনে আমরা জিতব।”
চেয়ারম্যানের নির্দেশে যে ২০০ প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছিল, তাদের দায়ও নিজের কাঁধে তুলে নেন এরশাদ।
তিনি বলেন, “তোমরা হতাশ হয়ো না। হতাশার কোনো কারণ নেই। জাতীয় পার্টি ছাড়া এই দেশে কোনো নির্বাচন সম্ভব নয়। যে কোনো জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রয়োজন হবেই। আমি যে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছি, তা সুদৃঢ় আছে। হতাশার কি আছে?”
উনিশশ নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পরের দিনগুলোও অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি।
“আমি ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর থেকে সংকট পিছু ছাড়েনি। নব্বই-এ ক্ষমতা ছাড়ার পর ছয়টি বছর জেলে ছিলাম। তখনো জাতীয় পার্টি অনেক সংকট অতিক্রম করেছে। আমরা ভয় পাইনি। নব্বই থেকে আজ পর্যন্ত মুক্ত রাজনীতি করতে পারিনি, কিন্তু জাতীয় পার্টির অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি।
জাতীয় পার্টির অবস্থান বোঝাতে নির্বাচনে না আসা বিএনপি ও শরিকদের দিকেও ইংগিতের আঙুল তোলেন এরশাদ।
“রাজনীতিতে কোন দলের কি অবস্থান তা তোমরা দেখছ। কারা মাঠে আছে আর কারা নেই তাও দেখছ। মনে রেখ, আমাদের পথ যতো নিষ্কণ্টক, অন্যদের তা নয়।”
আর জাতীয় পার্টির মধ্যে যারা সরকারের মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন, তাদের উদ্দেশ্য করে এরশাদ বলেন, “গর্ব করে বলি না, আমি যেখানে আছি, সেখানে জাতীয় পার্টি থাকবে। আমি না থাকলে থাকার কোনো প্রশ্ন নেই। সামান্য মোহ বা পদের কারণে এই বন্ধন ছিন্ন করা যাবে না।”
উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে তিনি কর্মীদের ভোটারদের কোছে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তাদের আস্থা অর্জন করতে বলেন। উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষে নিজে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সফরে যাবেন বলে জানান।
অন্যদের মধ্যে প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদের, গোলাম হাবিব দুলাল, সাঈদুর রহমান টেপা ও এম এ সাত্তার বর্ধিত সভায় উপস্থিত ছিলেন।