আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়ে দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে ২৯ ডিসেম্বর সারাদেশে থেকে সবাইকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া।
Published : 24 Dec 2013, 04:57 PM
সমঝোতা করলে কেউ ছোট হয় না: খালেদা
‘হত্যা’ বন্ধ হলে দশম সংসদ ভেঙে নির্বাচন: হাসিনা
টানা অবরোধের পর মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি দেয়ার পাশাপাশি সরকারকে আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, সমঝোতার পথ এখনো খোলা আছে।
নির্বাচন স্থগিত এবং নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে পাঁচ দফা অবরোধের পর নতুন করে একই কর্মসূচি দেননি বিরোধী নেত্রী। তবে দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
“নির্যাতন, গ্রেপ্তার, হয়রানির চেষ্টা করবেন না। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা এলে জনগণ তা মোকাবেলা করবে। পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচি দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।”
দশম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে লাগাতার হরতাল-অবরোধের পর ভোটের ১২ দিন আগে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
‘প্রহসনের’ নির্বাচন প্রতিহত করতে নতুন কর্মসূচিতে সবাইকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “২৯ ডিসেম্বর সারাদেশ থেকে সক্ষম নাগরিকদের ঢাকা অভিমুখে পদযাত্রা করার আহ্বান জানাচ্ছি।
“এই অভিযাত্রা হবে প্রহসনকে ‘না’ বলতে, গণতন্ত্রকে ‘হ্যাঁ’ বলতে। এই অভিযাত্রা হবে নির্দলীয়- নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অর্থবহ নির্বাচনের দাবিতে।”
ঢাকা অভিমুখে এই যাত্রাকে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্রের অভিযাত্রা)’ বলে অভিহিত করেন ১৮ দলীয় নেত্রী। জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে সবাইকে এসে নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে সামনে অবস্থান নিতে বলেন তিনি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের আহ্বান জানিয়ে খালেদা বলেন, “ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটিগুলোর পাশাপাশি দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনরত সব পক্ষকে নিয়ে অবিলম্বে জেলা, উপজেলা ও শহরে ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী তামাশা প্রতিহত করুন।”
৫২ মিনিট ধরে পড়া বক্তব্যে আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনাও করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনকে ‘নির্লজ্জ সিলেকশন’ আখ্যায়িত করেন তিনি।
চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের অবসানে সমঝোতা না হওয়ার জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, “তিন দফা আলোচনা সত্ত্বেও সরকারের অনড় মনোভাবের কারণে কোনো সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তারা সকল দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়নি।”
দেশজুড়ে বিরোধী মতের সবার ওপর দমন-পীড়ন চলছে অভিযোগ করার পাশাপাশি বিরোধী নেত্রী বলেন, সেনাবাহিনীকে প্রতিবাদী জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে।
বিরোধী দলের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে সরকারের মদদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন চলছে অভিযোগ করে তা প্রতিরোধে ‘গণপ্রহরা’ দেয়া কথা বলেন খালেদা।
যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে নিরবতার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রতিক্রিয়ায় তিনি মর্মাহত।
তবে এই বিষয়টিকে কূটনীতিকভাবে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ নোংরা রাজনীতি করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন বিরোধী নেত্রী।
নোবেলবিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের পক্ষে দাঁড়িয়ে তার আন্দোলনের প্রতি সমর্থনও জানান তিনি।
চলমান আন্দোলনে চারদফা করণীয় ও ১৮ দলীয় জোটের নীতি-কৌশল তুলে ধরেন খালেদা। এর মধ্যে আছে- প্রহসনের নির্বাচনে বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যস্থাপন, বিভক্তি-বিভাজনের রাজনীতির অবসানে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যবস্থা গ্রহণ, ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা সংগ্রাম কমিটি গঠন এবং সংখ্যালঘু ধর্মালম্বীদের বিরুদ্ধে সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ থাকা।
নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সর্বশেষ গত ২১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
এরপর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে তার প্রতিবাদে ১৮ দলীয় জোট ৫ দফায় মোট ২২ দিন অবরোধ ডাকে, যাতে সহিংসতায় নিহত হন প্রায় একশ’ জন।
পঞ্চম দফায় চার দিন অবরোধের শেষ দিন সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি লিখিত বক্তব্য পড়ে যান, কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি।
সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আর এ গনি, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মাহবুবুর রহমান, জমিরউদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, শমসের মবিন চৌধুরী, ওসমান ফারুক, রিয়াজ রহমান, সাবিহউদ্দিন আহমেদ, মিজানুর রহমান মিনু, ফজলুল হক মিলন, শিরিন সুলতানা, মারুফ কামাল খান প্রমুখ।
১৮ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে এলডিপি চেয়ারম্যান অলি আহমদ, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতে ইসলামীর নেতা রেদোয়ান উল্লাহ শাহেদী, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, ইসলামিক পার্টির সভাপতি আবদুল মোবিন উপস্থিত ছিলেন।
‘ইলেকশন নয়, সিলেকশন’
‘একতরফা’ নির্বাচন থেকে সরে এসে তফসিল স্থগিত করে আলোচনার উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন।
“জনগণের অর্থের অপচয় করে ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একটা অর্থহীন প্রহসনের নির্বাচন করার প্রয়োজন নেই। এতে শুধু আপনারাই কলঙ্কিত হবেন না, গণতন্ত্রও ধ্বংস হবে।”
ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও কমনওয়েলথের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত তুলে ধরে চলমান নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মকর্তাসহ কাউকে সম্পৃক্ত না হওয়ার আহ্বান জানান বিরোধী নেত্রী।
ইসির উদ্দেশে তিনি বলেন, “এই গণবিরোধী প্রক্রিয়া বন্ধ করার সাধ্য না থাকলে ইলেকশন কমিশনের অন্তত পদত্যাগ করা উচিত।”
নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি ১৫৪ আসনের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে একে ভোটাধিকার হরণের সঙ্গে তুলনা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
“তিনি (শেখ হাসিনা) আজ নির্বাচনের নামে যে প্রহসন পরিচালনা করছেন, তাতে জনগণের ভোট ছাড়াই ১৫৪ জন এমপি হয়ে যাচ্ছেন। দেশের মোট ভোটারের শতকরা প্রায় ৫৩ জনের ভোটের অধিকার এই প্রক্রিয়ায় কেড়ে নেয়া হয়েছে।”
“শুধু বিএনপি নয়, দেশের উল্লেখযোগ্য সব বিরোধী দলই এই নির্বাচনী প্রহসন বর্জন করেছে। শুধু আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের একাংশ এই একতরফা প্রহসনে শামিল হয়েছে। এই নির্বাচনী তামাশা কোনো ইলেকশন নয়, এটা নির্লজ্জ সিলেকশন।”
খালেদা বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর কথা প্রায়ই বলেন। এবার দেশের মানুষ তার ন্যক্কারজনক প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে।
“এই নির্বাচন ও এর মাধ্যমে গঠিত সরকার ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল’ হবে না। এটা হবে ‘বাই দ্য ইলেকশন কমিশন, ফর দ্য আওয়ামী লীগ, অফ দ্য আওয়ামী লীগ’।”
খালেদা বলেন, “ভোট ও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া ১৫৪ জন এবং কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া বাকি যাদেরকেই আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করবে, তারা কেউই বৈধ জনপ্রতিনিধি হবে না।”
“তেমন একটি অবৈধ সরকারের আদেশ-নির্দেশ মান্য করতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং জনগণের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না।”
‘আসন ভাগাভাগির আপনি কেউ নন’
নির্বাচনে প্রার্থী কম হওয়ার জন্য সমঝোতার মাধ্যমে মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনার বক্তব্যের সমালোচনাও করেন খালেদা জিয়া।
“দুই. বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। জনগণকে আর বিরোধী দলকে ভোট দিতে হল না। এতে জাতি অভিশাপমুক্ত হয়েছে।”
“তার কথাতেই পরিষ্কার হয়েছে, নির্বাচন নয়, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে আসন ভাগাভাগির প্রহসনই তিনি চেয়েছেন এবং এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, যদি বিরোধী দল এতে অংশ নিত, তবুও তিনি একই রকম প্রহসনের চেষ্টাই করতেন।”
“দ্বিতীয়ত বিরোধীদলহীন নির্বাচনই তার কাম্য। একদলীয় ব্যবস্থাতেই তিনি বিশ্বাসী। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি এমন ব্যবস্থা করেছেন, যাতে জনগণ বিরোধী দলকে ভোট দেয়ার কোনো সুযোগ না পায়। এতে তিনি পরিতৃপ্তিবোধ করছেন।”
বিরোধী নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, “আসন ভাগাভাগি করার আপনি কেউ নন। এটা জনগণের অধিকার। তারাই ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। সেই অধিকার আপনি কেড়ে নিয়েছেন।”
‘প্রহসনে জড়িত করা হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীকে’
নির্বাচনের সেনা মোতায়েনের দাবি বিভিন্ন সময়ে বিএনপি জানিয়ে এলেও এবার তা মোতায়েনের বিরোধিতা করে খালেদা বলেন, সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে সরকার।
তিনি বলেন, “বেআইনি ও নৃশংস অভিযানে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত করার অপচেষ্টাও শুরু হয়েছে। পিলখানা হত্যাযজ্ঞ ও শাপলা চত্ব¡রে রক্তপাতের খলনায়কেরা দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দেশবাসীর মুখোমুখি দাঁড় করাবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
“জনগণের সম্পদ দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে প্রহসনের নির্বাচনে জড়িত করে বিতর্কিত না করার জন্য আমি সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
‘ঘরে ঘরে কান্নার রোল’
বিরোধী মতের ওপর রাষ্ট্রীয় ‘সন্ত্রাস’ চলছে দাবি করে খালেদা বলেন, “প্রতিদিন রক্ত ঝরছে। বিনাবিচারে নাগরিকদের জীবন কেড়ে নেয়া হচ্ছে। ঘরে ঘরে কান্নার রোল। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে নিভৃত পল্লীতেও ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। নির্বিকার শুধু সরকার।”
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেও সরকার বলপ্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
“দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ও বিরোধী দলের রাজপথে নেমে শান্তিপূর্ণ পন্থায় তাদের দাবি তুলে ধরার অধিকার থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। এখানে কেবল সরকারের সমর্থকরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় রাজপথে সশস্ত্র মহড়া দিতে পারে।”
“আমাদের সদর দপ্তর ও শাখা কার্যালয়গুলো অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নির্বিচারে চলছে হত্যা, গুম, নির্যাতন, গুলি, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার ও অপহরণ।”
লক্ষ্মীপুর, মেহেরপুর, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, বগুড়া, জয়পুরহাট, সীতাকুণ্ড, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে সরকারি বাহিনীর তাণ্ডব চলছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।