সংবিধান সংশোধনের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, এর মাধ্যমে দেশে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠলো।
Published : 30 Jun 2011, 10:47 AM
বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সব সম্ভাবনা তিরোহিত হলো। এই অপচেষ্টায় দেশে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠলো।
"গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।"
বিকেলে গুলশানে তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সংবিধান সংশোধন নিয়ে দলটির অবস্থান জানাতে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটে তিনি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিতে শুরু করেন।
সকাল ১১টার দিকে সব সংশোধনী প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়। বিভক্তি ভোটে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন বিল পাস হয় দুপুরে। এ সময় বিরোধী দল সংসদে ছিলো না।
গত বছরের ২১ জুলাই সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ মতবিনিময়ের পর গত ৮ জুন কমিটি প্রতিবেদন আকারে সুপারিশগুলো সংসদে উপস্থাপন করে। এ সময় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদে ছিলো না।
২০ জুন তা বিল আকারে উপস্থাপনের জন্য অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলোপ করে ২৫ জুন সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ বিল সংসদে উত্থাপন করা হয়। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন পেশের জন্য স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সোমবার ও মঙ্গলবার দুই দিন বৈঠক করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে বুধবার তা সংসদে পেশ করা হয়।
বিএনপি সংবিধান সংশোধনের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। বুধবারও দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করছে।
'সংবিধান এখন আ. লীগের ইশতেহার'
খালেদা জিয়া বলেছেন, সংশোধনের পর সংবিধান আওয়ামী লীগের দলীয় ইশতেহারে পরিণত হয়েছে।
সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে খালেদা বলেন, দেশবাসী ও বিএনপির প্রতিবাদের মূল্য না দিয়ে তারা সেই [সংবিধান সংশোধন] ঘৃণ্য কাজটি করলেন।
"তারা ১৯৭৪ সালে মাত্র ১৩ মিনিটে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে বাকশাল কায়েম করে।"
"তারা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার মূল্য দিলেন না।'
সরকারের প্রতি সর্তকবাণী
খালেদা বলেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন ক্ষমতায় থেকে করার অসদুদ্দেশ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হলো।
"এর মাধ্যমে তথাকথিত অন্তবর্তী সরকার নামে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা ও সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার যে হীন উদ্যোগ নেওয়া হলো তাতে দেশবাসী গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।"
"আপনারা '৭৪ সালের বাকশালী স্বৈরশাসন জারির মতো ক্ষমতার জোরে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করলেন। এর দায়-দায়িত্ব আপনাদের বহন করতে হবে।"
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দাবি করেন, "এই বিল পাস হওয়ার ফলে সংবিধানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে মারাত্মকভাবে আঘাত করা হয়েছে।"
সংশোধনীর ফলে রাজনৈতিক দল গঠন ও সংগঠন গড়ার অবাধ অধিকার আবারো সীমিত হয়ে পড়লো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
"আদিবাসীদের পরিচিতি ও সংহতি বিপন্ন হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্র ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার গোছামিল আমাদের দিক নিদের্শনাহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করলো।''
এছাড়া এই বিল পাসের ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরব উজ্জ্বল অধ্যায়কে অস্বীকার করা হয়েছে বলে দাবি করেন খালেদা।
তিনি বলেন, "জাতীয় ইতিহাসকে খণ্ডিত করা ও বিকৃতকরণকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ ও বীরদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে।"
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ হাসিল করছে।
"দলবাজ বিচারকের তালিকায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক একটি ধিকৃত নাম। সেই খায়রুল হকের দেওয়া একটি রায়ের অজুহাতে সরকার আজ সংবিধান তছনছ করলো।''
"আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকার পাখি শিকার করেছে," মন্তব্য করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, "তাদের দুরভিসন্ধি জনগণের সামনে দিবালোকে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে।"
'পঞ্চদশ সংশোধনী ক্রুটিপূর্ণ'
সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা সন্নিবেশিত করা হয়েছে- এ বিষয়টি উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, অথচ সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়েছে। এটা এক ধরণের প্রতারণা।
এছাড়া বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।
"১২ অনুচ্ছেদে পঞ্চম সংশোধনী বলে বিলুপ্ত ধর্মনিরপেক্ষতা পুনর্বহাল করে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দান করা যাবে না। এটি অনুচ্ছেদ ২ক-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।"
খালেদা অভিযোগ করেন, ক্রমাগত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের আশঙ্কায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে দলীয় সরকারের অধীনে কারচুপির নির্বাচনে জিতে আসার আশায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগ বলতে থাকে, আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনে তারা বাধ্য- এ কথা উল্লেখ করে খালেদা বলেন, "যদি তাদের এই কথাই সত্য হয়ে থাকে, আদালতের রায়ের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগই যদি তাদের না থাকে, তাহলে এতো লোকজন ডেকে আলোচনার মহড়া করার কী প্রয়োজন ছিল? বিরোধী দলকে আলোচনার জন্য ডাকাও কি তাহলে ছিল লোক দেখানো এবং জনমতকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য?"
"প্রকৃত পক্ষে সংবিধান সংশোধনের পূর্ণ এখতিয়ার পার্লামেন্টের, আদালতের নয়।"
খালেদা জিয়া সংশোধনীর বিভিন্ন ক্রটি তুলে ধরে বলেন, '' পঞ্চদশ সংশোধনীর ভেতরেই যে কেবল নানা অসঙ্গতি রয়েছে। শুধু তাই নয়। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতেও নানা ক্রটি ও অনিয়ম করা হয়েছে।''
তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী একটি বিল উত্থাপনের সাত দিনের নোটিস দেওয়ার কথা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি।
"বিধি অনুযায়ী উত্থাপনের তিনদিন আগে বিলের কপি [সাংসদদের] পৌঁছানোর কথা থাকলেও তা করা হয়নি।"
রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের চতুর্থ সংশোধনীর বিধান পুনরুজ্জীবিত করার সংশোধনীকে নজিববিহীন বলে অভিহিত করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, "এর ফলে রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়াবেন স্পিকার। এটা উদ্দেশ্যমূলক।''
"বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে জনগণের যে অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো, পঞ্চম সংশোধনী যেসব অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দলিল। এই পঞ্চম সংশোধনী যারা বাতিল করতে চায় তারা বাকশালের প্রেতাত্মা।"
গণভোটের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে প্রাক-অনুমোদনপ্রাপ্ত এবং পার্লামেন্টে পাস হওয়ায় পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের ক্ষমতা কোনো আদালতের নেই- এ দাবি করে খালেদা বলেন, "জাতীয় সংসদ এই পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমতি অবশ্যই নিতে হবে।"
খালেদা 'দেশপ্রেমিক' সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও সমাজশক্তির প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশবাসীর প্রতি আমার আহ্বান, রাজপথের কঠিন সংগ্রামে ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার মোকাবিলা করে আমরা আরেকবার চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনি।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আর এ গনি, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মাহবুবুর রহমান, জমির উদ্দিন সরকার, আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সহসভাপতি এম মোরশেদ খান, আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, রাজিয়া ফয়েজ, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক, আব্দুল কাইয়ূম ও প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান উপস্থিত ছিলেন।