দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দর্শানোর নোটিসের জবাব দিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমদ; সেই সঙ্গে নেতা-কর্মীদের ‘তোষামোদ’ ছেড়ে মুখ খোলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
Published : 19 Dec 2020, 02:13 PM
হাফিজ বলেছেন, চিঠি পেয়ে অপমানিত বোধ করে পদত্যাগের কথাও ভাবছিলেন তিনি। তবে জবাব দেওয়ার পর শীর্ষ নেতৃত্ব কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন।
সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে দুই ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন ও শওকত মাহমুদকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দর্শাতে বলা হয়।
শওকত মাহমুদ জবাব দেওয়ার দুদিন পর শনিবার নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজের জবাব পাঠিয়ে দেওয়ার পর বনানীতে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের সামনে আসেন হাফিজ।
ভোলার লালমোহন-তমজুদ্দিন আসনে ছয় বারের সংসদ সদস্য হাফিজ ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে মন্ত্রী ছিলেন।
বীর বিক্রম খেতাব প্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর। ফুটবলার হিসেবেও দেশে খ্যাতিমান ছিলেন তিনি।
হাফিজ বলেন, “একজন যুদ্ধাহত, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি বিজয়ের মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অসৌজন্যমূলক ভাষায় অসত্য অভিযোগ সম্বলিত কারণ দর্শানোর নোটিস পেয়ে হতবাক হয়েছি।
“আমার বিনীত অনুরোধ আমার বক্তব্য স্থায়ী কমিটির সদস্যের সামনে উপস্থাপন করা হোক। বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমাকে যদি দোষী সাব্যস্ত করা হয়, আমি যে কোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছি। আমি দলীয় নেতৃত্বের প্রতি সর্বদাই শ্রদ্ধা পোষণ করি।”
‘রিজভীর চিঠিতে সৌজন্যের ব্যত্যয়’
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে, তাতে ‘অনেক ভুল’ পাওয়ার কথা বলেন ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ।
তিনি বলেন, “আমি বিগত ২৯ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট, আমার যোগদানের তারিখ, ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাবার তারিখ, আমার নামের বানানসহ অনেক ভুলই রিজভীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে দৃশ্যমান।
“আমি ২২ বছর ধরে দলের অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছি। দলের ভাইস চেয়ারম্যানকে একজন যুগ্ম মহাসচিব (আদিষ্ট না হয়েও) এমন কঠিন, আক্রমণাত্মক ভাষায় কৈফিয়ত তলব করায় অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছি। এখানে প্রটোকল ও সৌজন্যতার ব্যত্যয় ঘটেছে। ব্যক্তি রুহুল কবির রিজভী একজন ভদ্র, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী নেতা, তা সাথে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। তার কাছ থেকে এধরনের চিঠি আশা করিনি।”
পদত্যাগের ইঙ্গিত
হাফিজ বলেন, “আমার সামরিক বাহিনীর বন্ধুরা যাদের সাথে চাকুরি-বাকরি করেছি, তারা সবাই এবং আমার ব্যক্তিগত বন্ধুরা যারা রাজনীতি করে না, তারাই সবাই বলে যে, আপনি আজকেই পদত্যাগ করেন। আমি চিন্তাও করেছিলাম।
“আমার প্রিয় নেতা-কর্মীরা সেই এখান থেকে আড়াইশ মাইল দূরে নদী পার হয়ে লঞ্চে, নৌকায়, মেঘনা নদীর পার থেকে এখানে এসে অনুরোধ করেছে- আপনি পদত্যাগ করবেন না, অবসর নেবেন না।
“তাদের অনুরোধে আজকে আমি পদত্যাগ করলাম না। আমি দেখতে চাই্, এই আমার ব্যাখ্যা তাদের (নেতাদের) কাছে সন্তোষজনক হয় কি না। তারপরে আমি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।”
হাফিজের সঙ্গে ভোলার লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলার জাকির হোসেন, শাহাদাত হোসেন, বাবুল পাঞ্চায়েত, কবির হাওলাদার, ওমর ফারুক রিন্টু শতাধিক বিএনপি নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
কাউন্সিল দাবি
দলের কাউন্সিল দাবি করে হাফিজ বলেন, “বিএনপির একজন নগন্য কর্মী হিসেবে কয়েকটি সুপারিশ পেশ করতে চাই। ২০২১ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই দলের জাতীয় কাউন্সিল আহবান করা হোক।”
দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি বাণিজ্য এবং মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে আসায় তার তদন্তও দাবি করেন তিনি।
হাফিজ বলেন, “সম্প্রতি আমার নির্বাচনী এলাকায় ছাত্রদলের কমিটি কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকায় বসে গঠন করেছেন। আহ্বায়ককেই আমি চিনি না। ছাত্রলীগের কর্মীরাও এ কমিটিতে স্থান পেয়েছে। আমার সুপারিশ বিবেচনা করা হয়নি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে কোনো উত্তর পাইনি।”
‘তোষামোদ ছাড়ুন’
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে হাফিজ বলেন, “বিএনপি নেতা-কর্মীদের চিন্তা করতে বলি, দেশের জনপ্রিয় দল বিএনপি কেন আজকে ক্ষমতার বাইরে? কারা এর জন্য দায়ী?
“চিন্তা করেন, মুক ও বধির না হয়ে চিন্তা করেন। দলকে ভালোর জন্য কনট্রিবিউট করেন। দলকে সাজেশন দেন, কী করা উচিত। কেবলমাত্র তোষামোদ করে দায়িত্ব শেষ করবেন না।”
তিনি বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা । আমার নেতা জিয়াউর রহমান বলে গিয়েছেন, দলের চেয়ে দেশ বড়। আমার কাছেও আমার দেশ সবচাইতে বড়।”
‘মুক্তিযোদ্ধারা দলে কোনঠাসা’
কারণ দর্শাও নোটিসের জবাবে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, “অতীতে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত স্মরণীয় দিবসে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হত। গত দেড় বছরে এই ধরনের অনুষ্ঠানেও দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আমাকে ডাকার প্রয়োজন বোধ করেননি। বোঝা যাচ্ছে বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কোনঠাসা করে রাখতে একটি মহল সক্রিয় রয়েছে।
“বিগত এক বছরে আমি প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত ছয়টি সভায় অংশগ্রহণ করেছি, আয়োজক জাতীয়তাবাদী দল দুটি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির দুটি, বিএনপিভুক্ত সংগঠন একটি। দেশের খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধারা এই সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।”
আন্দোলনের জন্য ‘প্রস্তুত’
হাফিজ বলেন, “এদেশে গণতন্ত্র আসুক আমি চাই। গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য, মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্যে, জনগনের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবার জন্যে, বাক স্বাধীনতা ফিরে পাবার জন্যে এবং এই অবৈধ সরকারকে বিদায় করার জন্যে যে কোনো সংগ্রামে আমি সব সময় প্রস্তুত থাকব।
“আমি একজন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মী। যদি বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিশেষ করে ছাত্র যুবকেরা রাজপথে নামে, কালকে এদলের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল।”
তিনি বলেন, “তারা রাজপথে নামে না কেন? অনেক চিন্তা করেছি। দলীয় নেতৃবৃন্দের উচিত এটা পর্যালোচনা করা যে, এত জনপ্রিয় দল বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শতকরা ৮০টা ভোট পায়, কিন্তু রাস্তায় কেন ১০০ লোক নামে না। এটা চিন্তা করা উচিৎ।
“অনেক কর্মীকে আমিও জিজ্ঞাসা করেছি। তারা বলে যে, আমি যদি নামি, গুলিটা খাই আমার পরিবারকে কে দেখবে? আমরা লাভটা কী? আমি জীবন দেব, অন্যরা সুবিধা হবে- এসব কারণে হয়ত নামে না। তবুও আমি বিএনপির সকল নেতা-কর্মীকে আহ্বান জানাব, আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ডাক দিলে, যেই ডাক দেয়, আপনারা এসে এই সরকারকে উৎখাত করবেন।”
৫ পৃষ্ঠার জবাবে হাফিজ লিখেছেন, “বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে কোনো অসম্মানজনক, অসৌজন্যমূলক বক্তব্য রাখিনি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সততা ও দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। আমি মুক্তিযুদ্ধে তার অধীনস্থ সেনা কর্মকর্তারূপে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করেছি, সম্মুখ সমরে আহত হয়েছি। ১৪ ডিসেম্বর তারিখে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সারাদিনব্যাপী মরণপণ যুদ্ধের পর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিলেট শহর দখল করেছিলাম।
“২০২০ সলের এদিনেই আমার দল আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আমাকে নোটিস পাঠানোর আগে চিঠির বিষয়বস্তু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে আমার কর্মীরা মর্মাহত হয়েছে।”
অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন দাবি করে হাফিজ লিখেছেন, “দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অসম্মান করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। জিয়া পরিবারের কোনো সদস্যের প্রতি কখনোই কটূক্তি করিনি, ভবিষ্যতেও করব না। রাজনীতি ছেড়ে দিলেও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শ হৃদয়ে লালন করব।”