ভোটে হেরে প্রাথমিকভাবে হতাশায় ডুবলেও সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এখন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আলোচিত কাউন্সিলর প্রার্থী ডেইজী সারওয়ার।
Published : 07 Feb 2020, 02:25 PM
৩১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থনে নির্বাচন করে হেরে যাওয়া এই প্রার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যখন যেখানে যাই, বাবার কথা মনে করি এবং ভাবি- আই অ্যাম দ্য কুইন অফ মাই ওন ওয়ার্ল্ড।”
অন্যজন কী ভাবল, কী করল- তা নিয়ে অতোটা ভাবেন না বলে দাবি করেন লাটিম প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী র্যাপ সংগীত বানিয়ে খবরের শিরোনাম হওয়া ডেইজী। টিকে থাকার স্বার্থে প্রতিটি মেয়েকে তিনি ‘নিজের জগতের রানি’ হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ডেইজী বলেন, “আমার মতে- যার সেল্ফ রেসপেক্ট থাকবে না, তার পৃথিবীতে থাকার অধিকার নেই। আত্মসম্মানটাকে আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই।”
ডেইজী সারওয়ার নামে বেশি পরিচিত যুব মহিলা লীগের এই সহ-সভাপতির প্রকৃত নাম আলেয়া সারওয়ার ডেইজী। এর আগে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, মোহাম্মদপুর থানার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের রাজনীতিতে আসা, আলোচনা-সমালোচনা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা কথা বললেন ডেইজী।
জানালেন, ‘ডানপিটে’ স্বভাবের কারণে ছোটবেলা থেকে অনেক সমালোচনার পরও বাবার অনুপ্রেরণাকে আশ্রয় করে ‘এতোদূর’ এসেছেন তিনি।
“আমার বাবা সারাজীবন আমাদের শিখিয়েছেন যে, তুমি যেখানেই যাবা, যেখানে বসবা- পাশের লোককে দেখে নিজেকে ছোট ভাববা না। তোমাকে মনে মনে ভাব রাখতে হবে, আই এম দ্য বেস্ট। মনে মনে ভাবলে হবে না, ‘আই এম দ্য বেস্ট হওয়ার’ জন্য কাজগুলো তোমাকে করতে হবে।”
সংরক্ষিত আসনে কাউন্সিলর থাকা অবস্থায় বিমানবন্দর এলাকায় ফগার মেশিন বসিয়ে ’যুদ্ধেংদেহী’ কায়দায় মশা মারতে গিয়ে ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছিলেন ডেইজী। সাক্ষাৎকারে সেই ভাইরাল ভিডিওর বিষয়েও তিনি প্রশ্নের উত্তর দেন।
সেই ভিডিও নিয়ে সমালোচনার জবাবে ডেইজী বলেন, “অনেকে না জেনে (সমালোচনা) করে থাকে। তখন মশার জন্য আমাদের ফ্লাইট ডিলে হচ্ছিল। এয়ারপোর্টের ভেতরে সিভিল এভিয়েশন (মশা মারার) কাজ করার কথা, কিন্তু তারা করে নাই।
“আর (অন্যদের) ভেতরে ঢোকাতো নিষেধ। সে কারণে ভেতরের দিকে (মশা) মারার জন্য একটা ফগার মেশিন উপরে এবং নিচে মারার জন্য আরেকটা ফগার মেশিন বসিয়েছিলাম। সেটা দেখতে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল, অনেকে ট্রল করেছে। তবে, আমার সাহসিকতার জন্য অনেকে প্রশংসাও করেছে।”
কীভাবে এলো নির্বাচনী গান
এবার ভোটের প্রচারে ‘ডেইজী আপার সালাম নিন, লাটিম মার্কায় ভোট দিন’ শিরোনামের র্যাপ সংগীত এবং নিজে মিউজিক ভিডিওতে উপস্থিত হয়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে আসেন ডেইজী সারওয়ার। সাক্ষাৎকারে তিনি শুনিয়েছেন সেই গানের গল্প।
তিনি বলেন, “নির্বাচনী প্রচারে আসলে একটা গান রাখতে হয়। আগেরবারও করেছিলাম। হঠাৎ করে আমার মাথার মধ্যে এল- আমি যদি একটা র্যাপ সং করি, তাহলে কেমন হয়? আমার একটা কাজিন আছে। তার সঙ্গে আমি আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডুয়েট গান করেছি, সে গানটি লিখল।”
গানের কথায় কিছু পরিবর্তন এনে প্রথমে নিজেই গানটি গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানান ডেইজী সারওয়ার। কিন্তু প্রার্থী নিজে গাইলে লোকে কীভাবে নেবে- সেই চিন্তা থেকে পরে অন্য শিল্পীকে দিয়ে গাওয়ান।
আলোচনা-সমালোচনা স্বাগত জানালেও ‘অশ্লীল’ মন্তব্য দেখলে কষ্ট পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “তরুণ প্রজন্ম যখন বুঝে, বা না বুঝে অশ্লীল কোনো কিছু লেখে, তখন এটা আমাদের জন্য কষ্টকর। সবার পছন্দ হবে, এটা তেমন না। পক্ষে-বিপক্ষে, ভালো লাগা খারাপ লাগা লিখবে।”
পরাজয় নিয়ে...
সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে বিজয়ী হয়ে পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকার পর এবার সাধারণ কাউন্সিলর পথে নির্বাচন করে হারেন ডেইজী। মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর কিছুদিন প্যানেল মেয়রের দায়িত্বেও ছিলেন।
এবারের নির্বাচনে পরাজয়ের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “অনেক বলেন আমি জয়ী হইনি। আসলে আমি জয়ী হয়েছি, জনগণের কাছে। জনগণের ভোটে, জনগণের মনে জয়ী হয়েছি। আমি এর জন্য প্রাউড ফিল করতেছি, ইমোশন কাজ করতেছে। আসলে আমি জনগণের মাঝে, কীভাবে ঢুকতে পারলাম।”
তিনি বলেন, “মানুষের আন্তরিকতা আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। পদ-পদবীর প্রতি আমার লোভ নাই। তবে কাজ করার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার, সেটা চেয়েছিলাম। সেটা পাইনি। তবুও আমি কাজ করে যাব।”
এবার কি মেয়র পদে লড়বেন?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচিত ডেইজী সারওয়ারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, পরের নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না। অনেকটা ঘুরিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি।
“আমি কাজে বিশ্বাসী। কাজ করতে থাকি। কাজ আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে, তখনই আমি কাজটা করব। এমন আমি এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য, মেয়র হওয়ার জন্য কাজগুলো করছি না। যদি কোনো ধরনের কোনো টার্গেট ধরে নিই এমপি হওয়ার জন্য, মন্ত্রী হওয়ার জন্য- তাহলে সেটা আমার ভেতরে কাজ করবে। যদি আপনাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলি, আমি এমপি হতে পারব না। যদি আমি ডান থেকে বামে চলা শুরু করি, আমি এমপি হতে পারব না। এই ভয়গুলো ভেতরে কাজ করবে।
“আমার কোনো চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই। আমি আমার মত কাজ করে যাব। কাজের মাধ্যমে আমার জনগণ, আমার নেত্রী, আমার দল, সবাই যদি মনে করে, শি ইজ পারফেক্ট ফর দিস পোস্ট, তারা যদি আমাকে সেখানে দেয়, আমি থাকতে রাজি।”
ডেইজী বলেন, “পাওয়ার বলি, চেয়ার বলি, পোস্ট বলি- আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নাই। আমি সবার কাছে আগেই জানতে চাইব- আমি এই চেয়ারের যোগ্য কি-না। আমি এই কাজটা করতে পারব কি-না।
“আমি এখন যেটা বুঝি- আমি যদি একজন মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হই, তাহলে কাজ করতে পারব। আমি এমপি হলে সেই কাজটি করতে পারব। কারণ আমি তৃণমূল থেকে কাজটা করে আসছি।”
ডেইজী সারওয়ার জানালেন, ছোটবেলা থেকে সিলেটে গান-নাচের পাশাপাশি খেলাধুলায় সক্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৮৫-৮৬ সালে সিলেট বিভাগে অ্যাথলেটিক্স এবং ভলিবল ‘চ্যাম্পিয়ন’ ছিলেন।
‘গোঁড়া’ সমাজে অন্যরা সমালোচনা করলেও ব্যবসায়ী বাবার উৎসাহে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাবা সবসময় উৎসাহ দিত। কীভাবে নিজে চলব, কীভাবে নিজের আত্মসম্মান ধরে রাখব। নিজেকে একটা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করব।”
অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় গাড়ি চালানো শেখার কথা জানান ডেইজী। দ্বাদশ শ্রেণিতে থাকাবস্থায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আ ক ম গোলাম রাসুল ভূঞার সঙ্গে বিয়ে হলেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। সিলেট এমসি কলেজ থেকে মাস্টার্স করা ডেইজী সারওয়ারের বয়স এখন ৫২ বছর।
স্বামী সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গিয়ে এখন ব্যবসা করছেন। এই দম্পতির মেয়ে রাডি জুম্মি ও ছেলে রাতুল বিন রাসুল যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করছেন।