ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু ও হল সংসদের নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ভোট দিচ্ছে ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী।
Published : 11 Mar 2019, 07:07 AM
সোমবার সকাল ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের কেন্দ্রে এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে, চলবে বেলা ২টা পর্যন্ত।
অনেক প্রতীক্ষার এই নির্বাচনে ভোট দিতে বিভিন্ন হল কেন্দ্রের বাইরে শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে সকাল ৭টা থেকেই।
এর মধ্যে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল এবং এসএম হলে সকাল ৭টার সময়ই কয়েকশ শিক্ষার্থীর দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হলে হলে গিয়ে ভোটার-শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে ডাকতে দেখা যায়।
সূর্যসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, দুপুর ২টার মধ্যে হল চত্বরে চলে আসা শিক্ষার্থীদের ভোট প্রয়োজনে ২টার পরও নেওয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য নির্বাচনগুলোর মত এ নির্বাচনও সুষ্ঠু হবে এবং বিতর্কহীন থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবগুলো বাঁকে ছাত্র সমাজের অগ্রণী ভূমিকার কেন্দ্রে থাকা ডাকসু ও হল সংসদের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরপর কয়েক দফায় নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
# এ নির্বাচনে মোট ভোটার ৪৩ হাজার ২৫৫ জন। তাদের মধ্যে ৫টি ছাত্রী হলের ভোট ১৬ হাজার ৩১২।
# ডাকসুতে ২৫ পদের বিপরীতে মোট প্রার্থী হয়েছেন ২২৯ জন; ১৮টি হল সংসদে ১৩টি করে ২৩৪টি পদে বিরপরীতে প্রার্থী ৫০৯ জন।
# ডাকসুতে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২১ জন; তাদের সঙ্গে এই নির্বাচনে ১৪ জন সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং ১৩ জন সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে লড়ছেন।
# ১২টি প্যানেলের বাইরে ভিপি পদে ৯ জন এবং জিএস পদে ২ জন স্বতন্ত্র হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন।
২৯বছর আগে সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবার কেন্দ্রীয় সংসদে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে পারলেও কোন হলেই তাদের পূর্ণ প্যানেল নেই। ছাত্রী হলগুলোর মধ্যে কেবল শামসুন্নাহার হলের ভিপি পদে তাদের একজন প্রার্থী লড়ছেন। আর কোনো ছাত্রী হলেই তারা প্র্রার্থী দিতে পারেনি।
তবে নির্বাচন উপলক্ষে প্রায় এক দশক পর ক্যাম্পাসে ফের তৎপরতা চালাতে পারছে বিএনপির এই সহযোগী সংগঠনটি।
ডাকসুতে বাম সংগঠনগুলোর জোট, কোটা আন্দোলনকারীদের বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পূর্ণ প্যানেল রয়েছে। তাদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন।
স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট নামে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দুটি জোট করেছে এবার। এর বাইরে জাসদ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ জাসদ (আম্বিয়া) সমর্থিত ছাত্রলীগ-বিসিএল, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইশা ছাত্র আন্দোলন, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও ছাত্র সমাজের পূর্ণ প্যানেল রয়েছে ডাকসুতে।
ছাত্রলীগ থেকে ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে সংগঠনের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
অন্যদিকে ভিপি পদে ছাত্রদলের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান, জিএস পদে জহুরুল হক হল শাখার যুগ্ম-আহবায়ক আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক এবং এজিএস পদে বঙ্গবন্ধু হল শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক খোরশেদ আলম সোহেল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন।
বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর দুই মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্যের ১১টি সংগঠন মিলে একটি প্যানেল দিয়েছে।
শুরুতে ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজীরকে জিএস প্রার্থী করা হলেও তার ছাত্রত্ব নিয়ে জটিলতায় ছাত্র ফেডারেশন (বদরুদ্দিন ওমর) ফয়সাল মাহমুদ সুমনকে বেছে নেয় বাম সংগঠনগুলো। তবে শেষ পর্যন্ত ছাত্রত্ব টিকে যাওয়ায় ছাত্র ফেডারেশন থেকেই জিএস পদে প্রার্থিতায় আছেন বেনজীর।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বামদের জোটবদ্ধ প্যানেলের একটি গুঞ্জন শোনা গেলেও তা ফলেনি।
বাংলাদেশ সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী এই প্ল্যাটফর্মের যুগ্ম-আহ্বায়ক নুরুল হক নূর। আরেক যুগ্ম-আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ রাশেদ খান জিএস এবং আরেক যুগ্ম-আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারুক হাসান এজিএস পদে লড়ছেন।
ছাত্র মৈত্রীর প্যানেলে সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রাসেল শেখকে ভিপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি সনম সিদ্দিকী শিতি জিএস এবং আরেক সহ-সভাপতি সানজীদা বারী এজিএস প্রার্থী হয়েছেন।
জাসদ ছাত্রলীগের প্যানেলে রাকিবুল ইসলাম তুষার ভিপি, শাফিকা রহমান শৈলীকে জিএস, জহুরুল ইসলাম এজিএস প্রার্থী হিসাবে লড়ছেন।
বাংলাদেশ জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশে ছাত্রলীগ-বিসিএলের প্যানেলে নাঈম হাসান ভিপি, শাহরিয়ার রহমান বিজয় জিএস এবং আশরাফুল আলম ফাহিমকে এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ভোট দিতে হবে যেভাবে
প্রার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে অপটিক্যাল মার্ক রিকগনিশন (ওএমআর) ফর্মে।
সূর্যসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থী চারটি করে ব্যালট পাবে। তিনটি কেন্দ্রীয় সংসদের এবং একটি হল সংসদের।
ডাকসুতে প্রার্থী বেশি হওয়ার কারণেই ২৫টি পদের জন্য মোট তিনটি ব্যালট তৈরি করতে হয়েছে।
ভোটার নিজের আইডি কার্ড দেখিয়ে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে প্রার্থীর নামের ডানপাশে নির্ধারিত ঘরে ‘ক্রস’ চিহ্ন দিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
>> পরিচয়পত্র নিয়ে ভোট প্রদানের নির্ধারিত লাইনে দাঁড়াতে হবে। >> মোবাইল ফোনের সুইচ অফ রাখতে হবে। >> নিরাপত্তা আর্চওয়ে বা মেটাল ডিটেক্টরে যথাযথভাবে পরিচয় পত্র প্রদর্শন করতে হবে। >> ভোটকেন্দ্রের ভেতরে নির্ধারিত টেবিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাছে পরিচয়পত্র হস্তান্তর করতে হবে। >> ভোটার তালিকার নামের পাশে স্বাক্ষর করে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করতে হবে। >> পাঞ্চ করা পরিচয়পত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাছ থেকে ফেরত নিতে হবে। >> ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে সুশৃঙ্খলভাবে বুথে ঢুকে ভোট দিতে হবে। >> বুথে সরবরাহ করা বলপেন দিয়ে নির্ধারিত স্থানে ক্রস চিহ্ন দিতে হবে। >> ব্যালট পেপার ভাঁজ করা যাবে না। >> ভোট দেওয়ার পর ভোট পেপার ডাকসু ও হল সংসদ এর জন্য নির্ধারিত আলাদা ব্যালট বাক্সে ফেলতে হবে। >> সবশেষে নির্ধারিত গেইট দিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের হতে হবে। |
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বুথ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
ভোট কেন্দ্র থেকে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা যাবে না। গণমাধ্যম কর্মীরা চিফ রিটার্নিং অফিসারের ইস্যু করা পরিচয়পত্র দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট হলের রিটার্নিং অফিসারের অনুমতি নিয়ে ভোট কেন্দ্রের গেস্টরুম বা নির্ধারিত স্থান পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারবেন।
অভিযোগ
ভোট ঘিরে উৎসবমুখর প্রচারের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করে ছাত্রলীগ বাদে অন্য সব ছাত্র সংগঠন।
ভোটকেন্দ্র হলে স্থাপন নিয়ে ছাত্রদলসহ অধিকাংশ সংগঠন আপত্তি তুললেও তা উপেক্ষা করেই গত ২ ফেব্রুয়ারি তফসিল ঘোষণা করেন এই নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. এস এম মাহফুজুর রহমান।
নির্বাচনের আগের দিন রোববারও ভোটের সময় বাড়ানো, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট নেওয়া এবং পোলিং এজেন্ট রাখাসহ সাত দফা দাবিতে উপাচার্য বরাবর একযোগে স্মারকলিপি দেন ছাত্রলীগ বাদে প্রায় সবগুলো প্যানেলের প্রার্থীরা।
তবে সেসব দাবির অভিযোগের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ভোটের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভোটগ্রহণকে ঘিরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয় ক্যাম্পাসে।
রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথগুলোতে ব্যারিকেড দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবংনির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিক ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
ভোটের দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বহিরাগতদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে বলে এর আগে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী সাংবাদিকদের বলেন, “সব ধরনের প্রস্তুতি আমরা সম্পন্ন করেছি। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে চারটি স্থানে মোতায়েন থাকবে পুলিশ।”
অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনের দাবি উপেক্ষা করে রোববার স্টিলের তৈরি ব্যালট বাক্স হলে হলে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ; যদি সংগঠনগুলো ভোটের দিন সকালে ব্যালট বাক্স পাঠানোর দাবি জানিয়েছিল।
ওই অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রশাসন যেভাবে ভালো মনে করবে সেভাবেই ভোট গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কিছু বলার নেই।
বরং ছাত্রদলের ’বহিরাগতদের উপস্থিতি’ নির্বাচনে বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম।
পাল্টা অভিযোগ করে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান রোববার বলেন, তাদের প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় শেষ মুহূর্তেও বাধা দেওয়া হয়েছে।
তবে ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবির বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।
নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক আবদুল বাছির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওএমআর ফর্মে ভোট নেওয়া, ব্যালট ভাঁজ না করা এবং স্টিলের বাক্সে ভোট নেওয়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি। সকালে প্রার্থীদের সামনে ব্যালট বাক্স খুলে দেখানো হবে এবং তারপর সিলগালা করা হবে।”
ভোট গণনার সময়েও প্রার্থীরা থাকতে পারবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ডাকসুতে ২২৯ জন প্রার্থীর জন্য যদি একজন করেও এজেন্ট দেওয়া হয়, তাহলে ভোটকেন্দ্রের অবস্থা ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। সে কারণে প্রার্থীরা ভোটিং শুরু ও গণনার সময় থাকার সুযোগ পাবে।”
অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের পরিবহনের ব্যবস্থা যথাযথ থাকবে বলে আশ্বাস দিয়ে এই রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, “শিক্ষার্থীদের আনার জন্য সকালে সবগুলো বাসই নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে যাবে, অন্যান্য দিন যেসব জায়গায় যায়। এভাবে ট্রিপ চলতে থাকবে।”
ভোটগ্রহণ শেষে আবাসিক হলগুলোতেই ভোট গণনা করা হবে বলে জানান অধ্যাপক বাছির।