আগামী নির্বাচন ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে এক সেমিনারে অংশ নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করলেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, যিনি এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন।
Published : 24 Nov 2018, 06:38 PM
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আমীর বলছেন, “পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রশাসন রাজনৈতিক দলের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের এখানে আইনের শাসন অনুপস্থিত। এক্সিকিউটিভ পাওয়ার পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং এর কোনো একাউন্টিবিলিটি বা দায়বদ্ধতা নেই।”
নির্বাচনের এই সময়েও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আমীর-উল ইসলামের, যে অভিযোগ নিয়মিত করে আসছে বিএনপি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আমীর বলেন, “কোর্টে এখনও গেলে আপনারা পাবেন হাজারেরও বেশি লোক জামিন নিতে অপেক্ষায় আছে। এখন মানুষ নির্বাচন করবে, নাকি বেইল নেবে, নাকি জেলে যাবে? এখন মানুষকে ঘরছাড়া করে ফেলা হচ্ছে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে পাঁচ বছর আগে নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি এবার ভোটে গেলেও দলীয় সরকারের অধীনে এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তাদের। পুলিশ ও প্রশাসনে দলীয়করণের অভিযোগ তুলে শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি দাবি জানিয়েছে তারা। তবে তাদের এ দাবি খারিজ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
এখন দলীয় ব্যক্তিদের নির্বাচনের দায়িত্ব না দেওয়ার দাবির পাশাপাশি ভোটগ্রহণে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি করছে বিএনপি।
এই দুই প্রসঙ্গেও কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম: “পত্রিকায় দেখেছি সিইসি কালকে নাকি পুলিশকে বলেছে, আপনার সম্ভাব্য প্রিজাইডিং অফিসারদের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তাদের বাড়িতে বাড়িতে কেন যাচ্ছেন, যা করবেন চুপচাপ করবেন। তাহলে কারা প্রিজাইডিং অফিসার হবে এবং হবে না সেটাও ওখানে সিদ্ধান্ত হচ্ছে?
“ইভিএম কি জিনিস আমি তো বুঝি না। ইভিএম কোম্পানিটা কোথাকার সেটাও জানি না। এটা কি এমআরআই মেশিনের মতো কোনো মেশিন নাকি? আমি এর সম্পর্কে কিছুই জানি না। ইভিএমের ডেমো করা হচ্ছে, এটা বিরাট প্রমোশন, আমি কোম্পানিটার নাম জানতে চাই।”
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আমীর-উল ইসলাম কয়েক দশক আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলেও তিনি এই নির্বাচনকে দেখছেন ‘মুক্তির পথ’ হিসেবে।
সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনে সাধারণ মানুষ কোনো রকম পুলিশি হয়রানিতে পড়বে না, সেই ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি কি না? নিচে কেন তারা কোনো জামিন পাচ্ছে না, সুপ্রিম কোর্ট হাই কোর্টে বেইল নিতে আসছে। পরিস্থিতি এখন এ রকম। ইতিহাস বলে নির্বাচন হচ্ছে মুক্তির পথ। এই নির্বাচন জনগণকে উপভোগ করতে দিতে হবে।”
শনিবার রাজধানীর ইস্কাটনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্যাটেজিক স্ট্যাডিজ বা বিস মিলনায়তনে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভার্নেন্স স্ট্যাডিজ আয়োজিত ‘নির্বাচনের রাজনীতি এবং মানুষের ভোটাধিকার’ শীর্ষক এই সেমিনারে আগামী নির্বাচন নিয়ে তার মতোই অভিমত ও শঙ্কা প্রকাশ করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিপা নোরিসের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন যদি ত্রুটিপূর্ণ এবং ব্যর্থ হয় তবে গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়ে। এমন ব্যর্থ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে বলা হয় ‘হাইব্রিড ডেমোক্রেটিক’ সরকার।
প্রবন্ধে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের কিছু আলামত তুলে ধরে সাখাওয়াত বলেন, ১. আদালতের মাধ্যমে প্রধান বিরোধী শক্তিকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা, ২. সীমানা পুনর্নির্ধারণের সময় বিভিন্ন কূটকৌশল, ৩. স্বাধীন গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা, ৪. রাষ্ট্রীয় সম্পদের দাপ্তরিক অপব্যবহার ৫. লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার সমান সুযোগ না থাকা ৬. বিরোধী দলকে মিছিল মিটিং করতে না দেওয়া, ৭. প্রচারে সরকারি সুবিধা গ্রহণসহ অন্যান্য।
নির্বাচন নিয়ে দেশ ‘ভয়াবহ সঙ্কটে’ আছে বলে মনে করছেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
ভোটকে ছোট করে না দেখার আহ্বান জানিয়ে ব্যবসায়ী আব্দুল হক বলেন, “১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান ভোটকে অপমান করেছে বিধায় রাষ্ট্রটিই ভেঙে গেছে। সেটা এখন আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাই নির্বাচনটা সঠিকভাবে করতে হবে।”
দেশে আইনের শাসন এবং দুর্নীতি ও অপরাধের বিচার নেই অভিযোগ করে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র না থাকলেও যারা শাসন করেন তারা যদি এই ব্যাপারগুলোর নিশ্চয়তা দেন, তবে দেশের মানুষ উপকৃত হবে।”
এই নির্বাচন কমিশন সঠিক নির্বাচন করতে পারবে কি না তা সংশয় প্রকাশ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান।
তিনি বলেন, “এক ইভিএম ইস্যুতে ইসির প্রতি মানুষের সন্দেহ বেড়ে গেছে। কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে অনড়। তাছাড়া বিরোধী পক্ষ ঐক্যফ্রন্টের দিক থেকে প্রশাসনে রদবদল করতে বলা হয়েছে, আর ১৪ দল নিষেধ করেছে। এই রদবদল করলে দেশের কোনো ক্ষতি হবে বলে আমার তো মনে হয় না।”
বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মঈনুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন পরিচালনার জন্য কমিশনকে সব ধরনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
“তারা যদি ক্ষমতার পূর্ণ প্রয়োগ ঘটনায় নির্বাচনের পর যারা সরকারে আসবে তাদের রোষের মুখে পড়তে পারে- এই ভয় থেকেই সব ক্ষমতার চর্চা করছে না। কিন্তু কমিশন নিজের ভয় তাড়াতে না পারলে জনগণ এবং ভোটাররা কীভাবে ভয়মুক্ত হবে? তারা তো আরও ক্ষুদ্র।”
“এই পরিস্থিতিতে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশন হবে না। ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী সরকার তৈরি হয় এবং তারা স্বৈরাচারের মতো জনগণকে অত্যাচার করে।”
রাজনীতিতে যেভাবে দলবাজীর চর্চা হয়, দেশের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা সেভাবে হয় না বলে মন্তব্য করেন বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন।
“কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সংস্কৃতি যদি দাঁড় করানো যায়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে,” বলেন তিনি।
“কারণ তারা বেশ প্রবীণ লোক। আমরা জানি না কোনো খেলা কেউ খেলছে কি না।”
হানিফ বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা কলুষিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে মাগুরা নির্বচনের মধ্য দিয়ে। আর ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তাকে স্বস্তিদায়ক আওয়ামী লীগ কখনোই বলেনি। কিন্তু সেটা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কারণে নয়, সেটা কী কারণে এমন হয়েছে তা সবার জানা।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন ‘অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে’ গঠিত হয়েছে উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা বলেন, “নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করুক, তা আমরা চাই। সংবিধান অনুযায়ী তাদের সব ধরনের ক্ষমতা দেওয়া আছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যেগুলো যৌক্তিক তারা সেগুলো করতে পারে।”
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আইনজীবী শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, “আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে ইলেকশন কমিশনকে সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এখন তারা যদি আজ্ঞাবহ হয়, বিএনপি বা আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করে সেটা তাদের ব্যাপার।”
“আমি আশাবাদী মানুষ, তাই এই ঘোষণাকে ইতিবাচকই দেখছি।”
সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংগঠন ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স-ফেমা’র সভাপতি মনিরা খানসহ অন্যরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন ও সিজিএসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আতাউর রহমান সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক জিল্লুর রহমান।