সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা থেকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সাত দফার ঘোষণা দিয়ে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দুই দিন জেলা ও বিভাগীয় শহরে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি।
Published : 30 Sep 2018, 06:37 PM
রোববার বিকালে ঢাকার এই জনসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবিনামা, লক্ষ্য ও কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, “আমরা ৭ দফা যে দাবি দিলাম, এ দাবিতে এই কর্মসূচি দিচ্ছি। এরপরে পর্যায়ক্রমে আমরা আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাব।”
কর্মসূচি হচ্ছে আগামী ৩ অক্টোবর জেলা শহরে সমাবেশ ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি এবং পরদিন ৪ অক্টোবর বিভাগীয় শহরে সমাবেশ ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান।
ফখরুল বলেন, “আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা এই সরকারকে বাধ্য করব দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে এবং তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনতে এবং আমাদের যেসমস্ত নেতা-কর্মী বন্দি রয়েছে তাদের মুক্তি দিতে।”
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকারের দাবি মানায় আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে কামাল হোসেন ও বি চৌধুরীর সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের তোড়জোড়ের মধ্যে বিএনপির উত্থাপিত ৭ দফা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ৫ দফারই অনুরূপ। শুধু বিএনপির প্রথম দফায় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি যোগ করেছে বিএনপি। সেইসঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মুক্তভাবে কাজ করতে দেওয়ার একটি দফা যোগ করেছে বিএনপি।
বিএনপির ৭ দফা
>> একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই খালেদা জিয়াকে মুক্তি ও তার বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ সব বন্দির মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
>> জাতীয় সংসদ বাতিল করতে হবে (ভোটের সময়)।
>> সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
>> সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
>> নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার বিধান নিশ্চিত করা।
>> নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার পর্যবেক্ষণে তাদের উপর কোনো প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ না করা।
>> নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মুক্তি, সাজা বাতিল ও মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন কোনো মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা, পুরনো মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার না করার নিশ্চয়তা এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সাংবাদিকদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমের স্বাধীন মত প্রকাশের অভিযোগে ছাত্র-ছাত্রী ও সাংবাদিকসহ সকলের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এক যুগ ধরে ক্ষমতাহীন বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় গেলে কী কী করবে, তার একটি ঘোষণাও দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল।
ঘোষিত ১২ দফা লক্ষ্যে প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসানে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের কথাও বলেছে খালেদা জিয়ার দল।
ফখরুল বলেন, “আমরা যদি জনগণের ভোটে সরকার গঠন করতে পারি, তাহলে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।”
এক বছর পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করল বিএনপি। এর আগের ২০১৭ সালের নভেম্বরের জনসভাটিতে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বক্তৃতা রেখেছিলেন।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ড নিয়ে বন্দি খালেদা জনসভায় না থাকলেও তার চেয়ারটি খালি রাখার পাশাপাশি সমাবেশের ব্যানারে প্রধান অতিথি হিসেবে তার নামই রাখে বিএনপি।
জনসভা থেকে প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, “প্রতীক হিসেবে দেশনেত্রীর নাম প্রধান অতিথি হিসেবে লেখা হয়েছে। তিনি এখন কারাবন্দি। আমরা তার মুক্তি চাই।”
মঞ্চের টানানো ব্যানারে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবির পাশেই বড় অক্ষরে লেখা ছিল- ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’।
জনসভায় আসা নেতা-কর্মীদের মুখেও স্লোগান ছিল- ‘মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই’, ‘খালেদা জিয়া এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে’।
দুপুর ২টায় শুরু হয়ে বিকাল সাড়ে ৫টায় শেষ হওয়া এই সমাবেশে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতিকৃতি সম্বলিত পোস্টার হাতে অংশ নেন। যুব দল এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের অনেকের মাথায় ছিল লাল-সবুজ টুপি।
জনসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আজকে দেশনেত্রীর দেওয়া দাবিতে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক ও ব্যক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে যে এই সরকারের পতন ঘটাতে হবে। সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে।
“আর এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে ছাড়া কেনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে পারে না, জনগণ তা হতে দেবে না।”
সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দলীয় মনোভাবাপন্ন মানসিকতা পরিহার করে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের অনুরোধ জানান সাবেক এই মন্ত্রী।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, “আজকের পত্রিকায় দেখলাম, এরা (সরকার) মাঠ দখলের কথা বলেন। আমরা বলতে চাই, আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি যদি প্রতিহত করেন, আমরাও আপনাদের প্রতিহত করব। এবার ছেড়ে দেব না।”
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “সরকারের মধ্যে ভীতি কাজ করছে, ভয় কাজ করছে। এখন একটা আওয়াজ উঠেছে, জাতীয় ঐক্য হবে। হবে কি, না হবে, আল্লাহই জানেন। সরকার বহু চেষ্টা করছে, যাতে ঐক্য না হয়।
“হলে ভালো, না হলে ক্ষতি নাই। ঐক্য হোক না হোক, বিএনপিকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।”
জনসভায় অংশ নেওয়া পথে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাধা দিয়েছে এবং গ্রেপ্তার করেছে অভিযোগ তুলে তার নিন্দা জানান ফখরুল।
ফখরুলের সভাপতিত্বে জনসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, বরকতউল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, জয়নাল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, শওকত মাহমুদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান, জয়নুল আবদিন ফারুক, ফজলুর রহমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকন, মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু, মাহবুবুর রহমান শামীম, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, বিলকিস জাহান শিরিন, শামা ওবায়েদ, বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া বক্তব্য দেন ঢাকা মহানগরের নেতা কাজী আবুল বাশার, মুন্সি বজলুল বাসিত আনজু, যুব দলের সাইফুল আলম নিরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের শফিউল বারী বাবু, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসেইন, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, ছাত্রদলের রাজীব আহসান।
অনুষ্ঠানে বিএনপির চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আহমেদ আজম খান, মাহমুদুল হাসান, জয়নাল আবেদীন (ভিপি), অধ্যাপক সাহিদা রফিক, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, লুৎফুর রহমান খান আজাদ, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, নাজিমউদ্দিন আলম উপস্থিত ছিলেন।
এই জনসভা উপলক্ষে সকাল থেকে পুলিশ, র্যাবসহ ব্যাপক সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন প্রাঙ্গণে জলকামানের গাড়ি, প্রিজন ভ্যানও রাখা ছিল।