খুলনার ভোট: চ্যালেঞ্জ সবার জন্যই

সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে, খুলনায় ভোটে তা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ বিএনপির সামনে; জনগণের সমর্থন অটুট আছে বলে দাবি করে আসা আওয়ামী লীগের সামনেও তা দেখানোর চ্যালেঞ্জ; আর জাতীয় নির্বাচনের বছরে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জের সামনে নির্বাচন কমিশন।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 May 2018, 07:20 PM
Updated : 15 May 2018, 03:44 AM

খুলনায় ভোটার মাত্র ৫ লাখ; কিন্তু সব মিলিয়ে তাদের রায় দেখতেই এখন কৌতূহলী গোটা দেশবাসী; ১৬ কোটি মানুষের দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত এখন মঙ্গলবারের এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উপর।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। পাল্টাপাল্টি প্রচার আর অভিযোগে স্থানীয় নির্বাচনের রেশ ছাড়িয়ে জাতীয় নির্বাচনের আবহ ফুটে উঠেছে নৌকা-ধানের শীষের লড়াইয়ে। দুই প্রধান দলের মেয়র প্রার্থীও বিভিন্ন বিবেচনায় শক্তিশালী; যা জমজমাট ভোটের লড়াই আভাসই দিচ্ছে।

কী হতে পারে ফলাফল- জানতে চাইলে খুলনার খালিশপুর এলাকার ভোটার সাব্বির মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বলা মুশকিল।

“নির্দলীয় নির্বাচনের সময় মেয়র পদে ভোট এক রকম ছিল। এবার দলীয় প্রতীকে হওয়ায় পরিস্থিতি ভিন্ন। খুলনায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোট কাছাকাছি এবং তালুকদার খালেক ও মঞ্জু দুজনেরই জনপ্রিয়তা আছে।”

“উন্নয়নের দিক থেকে তালুকদার খালেক চ্যাম্পিয়ন। মেয়র থাকাবস্থায় তিনি সেটা দেখালেও আগের নির্বাচনে হেরেছেন। এবার দেখা যাক কী হয়,” সিদ্ধান্ত টানতে পারেননি এই ভোটার।

ভোটের আগের দিন সোমবার খুলনার বিভিন্ন স্থানে টহলে বিজিবি সদস্যরা

মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ২৮৯টি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সেরেছে নির্বাচন কমিশন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে টহলে নেমেছে বিজিবি। সোনাডাঙ্গা বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এখন প্রচণ্ড ব্যস্ততা।

এক নজরে খুলনা সিটি নির্বাচন

>> ওয়ার্ড: সাধারণ ওয়ার্ড ৩১টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১০টি।

>> প্রতিদ্বন্দ্বী: মেয়র পদে ৫ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন।

>> কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ: ২৮৯টি ভোট কেন্দ্র, তাতে ভোট কক্ষ ১৫৬১টি।

>> ভোটার: ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৬ জন ও মহিলা ২ লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন।

>> ইভিএমে ভোট হবে দুই কেন্দ্রে। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ২০৬ নম্বর কেন্দ্র ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২৩৯ নম্বর কেন্দ্রে ১০টি ইভিএম থাকবে।

নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে দাবি করে ভোটার, প্রার্থী ও সমর্থকদের নিঃশঙ্কচিত্তে ভোট দিতে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যবহার করা হচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)

তবে প্রকাশ্যে দৃশ্যপট ও পরিবেশ সুন্দর হলেও ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের চাপা আতঙ্ক এখনও দেখছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের খুলনা জেলা সম্পাদক কুদরত-ই খুদা।

এই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের পর থেকেই দুই প্রধান প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ও নজরুল ইসলাম মঞ্জুর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুরু হয়, যা প্রচারের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাদের সঙ্গে ‍দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও যোগ দেন পাল্টাপাল্টি বাক্যবাণে।

খুলনায় বিএনপি এবার গতবার তাদের বিজয়ী প্রার্থীকে বদল করে ধানের শীষ তুলে দেয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মঞ্জুকে। অন্যদিকে গতবার হারলেও তার আগের বার জিতে আসা সাবেক মন্ত্রী বর্ষীয়ান তালুকদার খালেককেই রেখে দেয় নৌকার মাঝি হিসেবে।

সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি তালুকদার খালেক মেয়র থাকাকালে খুলনার উন্নয়নকেই প্রচারে সামনে এনেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা, যদিও তার আচরণ নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ।   

অন্যদিকে বিএনপি সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাব এই ভোটের মাধ্যমে দিতে খুলনাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তবে বর্তমান মেয়র বিএনপি নেতা মনিরুজ্জামান মনির সেভাবে কাজ না করার সমালোচনা নিতে হয়েছে তাদের।

এই নির্বাচনে বিএনপি শুরু থেকেই সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছিল; কিন্তু তাতে সাড়া পায়নি ইসির। পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ তুলে শেষ দিনেও সেনা মোতায়েনের দাবি তুলে যান মঞ্জু। জাতীয় নির্বাচনেও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েনের দাবি রয়েছে তার দলের।

ইসির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে মঞ্জু সোমবারও সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পুলিশের গণগ্রেপ্তার ও হয়রানির কারণে আমি সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছি।”

পুলিশ ব্যাপকহারে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় করে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ করে আসছেন তিনি। ভোটের আগের রাতে যুবদলের এক নেতাকে গ্রেপ্তারের পর তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে নালিশও দিয়ে আসেন।।

ইসি, প্রশাসন, পুলিশের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ জানিয়ে আসার পর শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকবেন কি না- সেই প্রশ্ন মঞ্জুর কাছে রেখেছিলেন সাংবাদিকরা।

উত্তরে তিনি বলেন, “এত কিছুর পরও আমার নেতাকর্মীরা এবং আমি মাঠে থাকব, নির্বাচনের ময়দানে। আমরা বিশ্ববাসীকে, দেশবাসীকে, খুলনাবাসীকে দেখাতে চাই আওয়ামী রাজনীতির হিংস্র রূপ।”

ভোটের প্রচারে নজরুল ইসলাম মঞ্জু

বিএনপি নেতাদের দাবি, জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে থাকায় খুলনায় ধানের শীষের জয় হবে দেখে তা ঠেকাতে মরিয়া ক্ষমতাসীনরা। 

ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন দাবি করেছেন, খুলনায় ভোট ডাকাতির পাঁয়তারা চলছে। তার ভাষায় সরকারি কর্মকর্তা, প্রশাসন, পুলিশ সকলে মিলে ধানের শীষের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছে।

তার কথার প্রতিক্রিয়া আসে ঢাকায় আরেক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়।

তিনি বলেন, “বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না বলে তারা সব সময় জোয়ারে থাকতে চায়। ভাটা তারা মেনে নিতে চায় না। রেজাল্ট পর্যন্ত এই দলটি বলেই যাবে। নালিশের অভিযোগের ভাঙা রেকর্ড বাজাবে।”

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে জেতার পরও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য মনে করিয়ে দেন ওবায়দুল কাদের।

তার মতোই বলছেন খুলনায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার খালেক। ২০১৩ সালের নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী মনির প্রধান নির্বাচন সমন্বয়ক থাকাকালে মঞ্জু একই ধরনের অভিযোগ করার কথা বলেন তিনি।

ভোট চাইছেন তালুকদার আব্দুল খালেক

তালুকদার খালেক বলেন, “ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়া পর্যন্ত এসব কথা বলেছেন। ভোটে তো আপনারা দেখেছেন, আমি হাজার কোটি টাকা এনে কাজ করানোর পরেও আমি হেরেছি; অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কারণে। তখনও আমার দল ক্ষমতায় ছিল। তখন কারচুপি হয় নাই।”

বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের হোতা’ আখ্যায়িত করে তালুকদার খালেক বলছেন, খুলনার রায় আওয়ামী লীগের পক্ষেই যাবে।

মেয়র পদে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির এস এম শফিকুর রহমান মুশফিক, কাস্তে প্রতীকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মিজানুর রহমান বাবু ও হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুজ্জাম্মিল হক প্রার্থী থাকলেও দৃশ্যপটে সেই নৌকা ও ধানের শীষই।

ভোটের অপেক্ষায় খুলনাবাসী

খুলনা-২ (সদর-সোনাডাঙ্গা) ও খুলনা-৩ (খালিশপুর-দৌলতপুর-খান জাহান আলী) সংসদীয় আসনের এলাকা নিয়ে গঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন।

ভোটাররা জানান, মুসলিম লীগের ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যগতভাবে খুলনা-২ আসনে বিএনপির সংখ্যাগরিষ্ঠ আর শ্রমজীবী মানুষ অধ্যুষিত খুলনা-৩ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ।

এবারের নির্বাচনে ৫৩ হাজার নতুন ভোটার এবং মোট ভোটারের প্রায় ২০ শতাংশ বস্তিবাসীদের ভোট ফলাফলের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব রাখতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।

সুজনের নেতা কুদরত-ই খুদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তরুণরা সেভাবে রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট না, তাই তারা উন্নয়নকে প্রাধান্য দেবে। নগরীর উন্নয়নে যার কথায় আশ্বস্ত হবে তাকেই তারা ভোট দিবে।

“আর বস্তিবাসীদের ভোট আগে টাকা দিয়ে কেনা যেত, এখন তারা অনেক সচেতন হয়েছে। এখন আর তাদেরকে টাকা দিয়ে ভোট কেনা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না।”

স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যাগুলো প্রভাব রাখলেও জাতীয় রাজনীতির প্রভাবই এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মানছেন ভোটারদের অনেকে।

আর তাই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার উপর তীক্ষ্ন নজর রাখবে পর্যবেক্ষক মহল।

বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামনে জাতীয় নির্বাচন রয়েছে। ইসির সদিচ্ছা ও ক্ষমতার প্রয়োগ মানুষ দেখতে চায়।

“ভোটের পরিবেশ ভালো রাখতে পারলে সামনে ভোটার, দল ও প্রার্থীর কাছে ইসির পজিটিভ ইমেজ আরও বাড়বে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ইসির খুব সিরিয়াসলি দেখা উচিত।”

ভোটের প্রচারে সরগরম খুলনা, ভোটার এখানে প্রায় ৫ লাখ

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর একটি মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীমেরও একই মত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির অধীনে কুমিল্লা ও রংপুর সিটির ভোটের চেয়ে খুলনা সিটি নির্বাচনের গুরুত্ব এখন অনেক।

“এখন আরও চারটি সিটি ভোট বাকি; তারপর সংসদ নির্বাচন। দলীয় প্রতীকে হওয়ায় খুলনার ভোট দেখেই মানুষের কাছে মেসেজ যাবে পরের ভোট কেমন হবে। কমিশনের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ এটি।”

সবার নজর যে রয়েছে ইসি, তা বুঝতে পারছে ইসিও; ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ তাই বললেন চ্যালেঞ্জ গ্রহণের কথাই।  

“খুলনার মাধ্যমে আমরা সবাইকে বার্তা দিতে চাই- সুষ্ঠু নির্বাচনে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছি। সব সময় সুষ্ঠু নির্বাচন করব আমরা,” বলেন তিনি।

[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন মাসুম বিল্লাহ, সুবীর রায়, কাজী মোবারক হোসেন]

খুলনার নির্বাচন সংক্রান্ত আরও খবর