১৫ অগাস্ট নিয়ে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে পঁচাত্তরে ভূমিকার জন্য তোপের মুখে পড়তে হয়েছে ফোরামের আহ্বায়ক কে এম সফিউল্লাহকে।
Published : 14 Aug 2016, 06:23 PM
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় সেনা প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক সফিউল্লাহ।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের আনুগত্য প্রকাশকারী সফিউল্লাহ কয়েক দিন পর সেনাপ্রধানের চাকরি হারান। তার দুই দশক পর আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য হন তিনি।
শোক দিবসের আগের দিন রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এই ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন ফোরামের আহ্বায়ক সফিউল্লাহ।
তিনি যখন পঁচাত্তরের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করছিলেন, তখন শ্রোতাদের মধ্য থেকে প্রশ্ন তোলেন কৃষক লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আব্দুল হাই কানু।
সফিউল্লাহ বলছিলেন, তিনিসহ ওই সময়কার বিমানবাহিনী প্রধান ও নৌবাহিনী প্রধানকে ‘বাধ্য হয়ে’ মোশতাক সরকারের প্রতি সমর্থন দিতে হয়েছিল।
তখন আব্দুল হাই কানু দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করেন, “স্যার যখন আপনার কাছ থেকে সিগনেচার নিচ্ছিল, তখন আপনি মৃত্যুবরণ করেননি কেন?”
বসে থাকা সফিউল্লাহ এসময় দাঁড়িয়ে বলেন, “আমাদেরকে আনুগত্যে বাধ্য করা হয়েছে। আপনি (কানু) সে সময় কী করেছেন?”
এই পর্যায়ে অনুষ্ঠানস্থল প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে একটু হৈ-চৈ হয়। অনেকেই কানুকে বসানোর চেষ্টা করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তখন বলেন, “এই কানু ভাই বসেন। আমাদের প্রত্যেকেরই এই জিনিসটা নিয়ে মনে দুঃখ আছে। আমরা সবাই ব্যথিত।”
কানু দাঁড়িয়ে বলেন, “আমি কর্মী ছিলাম। প্রতিবাদ করেছি, জেল খেটেছি।”
সফিউল্লাহ বরাবর অসহায়ত্ব প্রকাশ করে এলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তার সমালোচনা করেন।
দুদিন আগেই এক আলোচনা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “উনাকে (সফিউল্লাহ) সবাই ঘৃণা করে। কাপুরুষ, বিশ্বাসঘাতক।”
১৫ অগাস্ট নিহত শেখ ফজলুল হক মনির ভাই শেখ সেলিম সেদিন হামলার মধ্যে পড়েও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানে বক্তব্যে আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল নিজেও ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর নিজে প্রতিবাদী না হওয়ার কথা স্বীকার করেন।
“আমিও তো কিছু করতে পারিনি, আমি তখন কর্মী ছিলাম, এই গ্লানি-কষ্ট এখনও বয়ে চলছি।”
এই আলোচনা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান, বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার সাক্ষী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান আব্দুল হান্নান খানও বক্তব্য রাখেন।
মোজাম্মেল হক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোশতাকসহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভূমিকা তদন্তের জন্য কমিশন গঠনের দাব জানান।
মোশতাক একাত্তরে গঠিত মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। পরেও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ‘জেড ফোর্সের’ অধিনায়ক বীর উত্তম জিয়া মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পান।
মোজাম্মেল বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জিয়া, খন্দকার মোশতাক ও অন্যান্যদের কী ভূমিকা ছিল, সেটা জানার জন্য… জাতির কাছে তুলে ধরার জন্য আমাদের মনে হয় সময় এসেছে একটা তদন্ত কমিশন করে সেই সমস্ত সত্য তুলে আনার।”
জিয়ার মরণোত্তর বিচার জাতির দাবি করে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যান্য সেক্টর কমান্ডাররা কী করেছিল, আর তিনি কী করেছিল, তা সবার জানা।”
জিয়ার স্ত্রী ও বিএনপির বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ১৫ অগাস্ট জন্মদিন উদযাপনের প্রসঙ্গ তুলে কামরুল বলেন, “খালেদা জিয়া জন্মদিন তো পালন করবেই। এটাই স্বাভাবিক। কারণ ১৫ অগাস্ট তার রাজনীতির জন্ম। এর কারণেই জিয়া ক্ষমতায় এসেছিল। ওই তিনি দানবীয় রূপ ধারণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক।”
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হলেও এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা এখনও চিহ্নিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের নেতা মোজাম্মেল।
“সেই দিন (১৫ অগাস্ট) সারা রাত পাকিস্তানের দূতাবাস খোলা ছিল, তেমনি আমেরিকার দূতাবাসও খোলা ছিল। কেবল এই খুনিদের নয়, পর্দার অন্তরালে যে খুনি আছে, তাদের চরিত্র উন্মোচন হওয়া উচিৎ।”