জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে ১৫ অগাস্টের মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন সেনা প্রধান কেএম সফিউল্লাহর কঠোর সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
Published : 11 Aug 2016, 11:55 PM
শফিউল্লাহ পঁচাত্তরের ওই রাতে কিছু সংখ্যক সেনা সদস্যের ট্যাঙ্ক নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে যাওয়ার খবর পেয়ে নিশ্চুপ ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে আলোচনায় সেলিম বলেছেন, “বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে কেউ ভাল থাকতে পারে নাই। ওই জিয়াউর রহমানেরও ভালো যায় নাই, খালেদ মোশাররফেরও ভালো যায় নাই।
“আর সফিউল্লাহ তো জীবন্ত মৃত। উনাকে সবাই ঘৃণা করে। কাপুরুষ, বিশ্বাস ঘাতক। উনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ঘৃণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।”
বৃহস্পতিবার বিকালে মতিঝিলে এফবিসিসিআইয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত আলোচনায় অংশ নিয়ে এসব বলেন তিনি।
শেখ সেলিম বলেন, “১৫ অগাস্ট বাঙালি জাতির জন্য কলঙ্কময় একটি দিন। জীবনের সব সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু ১৪ বছর কারাভোগ করেছেন, দুই দুই বার ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন।
“তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু সেই পদকে পদদলিত করে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের জন্য ফাঁসির মঞ্চকেও বেছে নিয়েছিলেন। বাঙালিকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
কেএম শফিউল্লাহ
১৫ অগাস্ট রাতের ঘটনা বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর এই ভাগ্নে বলেন, “কয়েকজন আর্মি আমাদের বাড়িতে ঢুকে মণি ভাই কোথায়? মণি ভাই কোথায়? বলছিল। মণি ভাই বলেন, আমি মণি। কী হইসে? ওরা বলে ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। কী অপরাধ করেছি আমি বলে প্রশ্ন করেন মণি ভাই।
“সঙ্গে সঙ্গে তার চুল ধরে ফেলে ওরা। আমি শব্দ শুনে সেখানে গেলাম। ওরা বলল- ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। মণি ভাই বলেন, ঠিক আছে। এরপর একটু পেছনে ঘোরার চেষ্টা করতেই ওরা ব্রাশফায়ার করল। ভাবিকেও গুলি করল।
“আমিও পড়ে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেনিং ছিল যে গুলি করলে শুয়ে পড়তে হবে। মা সবাইকে পড়ে থাকতে দেখে ছুটে এসে চিৎকার শুরু করল।
“এরপর বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করলাম। কেউ ধরে না। পরে জামাল ফোন ধরল। আমার ভাই জামালকে বলল- মণি ভাইকে মেরে ফেলেছে। ওই পাশ থেকে বঙ্গবন্ধুর গলা আসলো যে, ‘আমার মণিকে মেরে ফেলছে?’
“ভাবি পড়ে ছিলেন। বললেন আমাকে বাঁচান। আমার বাচ্চা আছে।”
এরপর গাড়ি করে আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা শেখ মণি ও তার স্ত্রীকে মৃত ঘোষণা করেন।
যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণির ছোট ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মামা।
“হাসপাতাল থেকে নিচে নেমে আসার পর জানলাম, বঙ্গবন্ধু মারা গেছেন,” বলেন সেলিম।
শেখ সেলিম বলেন, “বাড়িতে অ্যাটাক হওয়ার পর কিন্তু বঙ্গবন্ধু কয়েক জায়গায় ফোন করেছেন এবং আর্মি চিফ শফিউল্লাহকে ফোন করেছেন। এইখানে আরেকটা ঘটনা আছে অনেকেই জানে না। ট্যাঙ্ক যখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয় তখন রাত সাড়ে ৪টা। কর্নেল সালাউদ্দিন নামের এক অফিসার (চট্টগ্রাম বাড়ি) ট্যাঙ্ক বের হবার সময় আর্মি চিফের কাছে ছুটে যায় আর জানায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বের হচ্ছে। শফিউল্লাহকে বলে, স্যার ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বের হচ্ছে বোধ হয় প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দিকে যাচ্ছে। স্যার আপনাকে এটা ইনফর্ম করতে আসলাম।
“আমাদের বাড়িতে গেছে ৫টায়, বঙ্গবন্ধু মারা গেছে সাড়ে ৫টায়। সাড়ে ৪টায় যখন খবর পেল আর্মি চিফ... শফিউল্লাহ তখন কী করছিল? আরে মেজর থেকে মেজর জেনারেল বানাইসে, আর্মি চিফ বানাইসে। আরে কোথায় থাকতি? পাকিস্তানের গোলাম হিসেবে থাকতি।
“সেই সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা সময়টায় শফিউল্লাহ কী করসে? গাড়ি নিয়ে তখন ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে যাবে না? ডেপুটি চিফের কাছে যাবে না? ধরে নিলাম জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত। তখন সিজিএস খালেদ মোশাররফের কাছে যাবে না? দশটা ট্রাক যদি রওনা দিতো ওরা পালাবারও জায়গা পেত না।
“এছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজে ওই রাতে শফিউল্লাহকে ফোন করে বলেছিল, তোমার আর্মি আমার বাসায় আক্রমণ করেছে। শফিউল্লাহ বলেছিল, ‘স্যার আমি দেখছি’। দ্বিতীয়বার যখন বঙ্গবন্ধু ফোন করে শফিউল্লাহ বলে, ‘স্যার আপনি একটু বাসা থেকে সরে যেতে পারেন না?’ তখন বঙ্গবন্ধু রাগ করে ফোন রেখে দেন।
“তাহলে কি আমরা মনে করতে পারি না, এই আর্মি চিফ শফিউল্লাহ বলেন, খালেদ মোশাররফ বলেন, জিয়াউর রহমান বলেন; তারা এই ঘটনায় বিন্দুমাত্র রিঅ্যাক্ট করে নাই। তার মানে কি তারা জানতো বিষয়টা? ওই সময় যদি তারা মুভ করত তাহলে বঙ্গবন্ধু কি মারা যায়? এইটা কি কেউ চিন্তা করে দেখছেন?
“যারা ওই ঘটনা ঘটালো, সেনা অর্ডারের বাইরে যারা গেল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না? কেন ব্যবস্থা নিল না। মেজর ডালিম, রশীদ কীভাবে এরপর ক্যান্টনমেন্টে ঢুকল? সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল রহস্য এখনো বের হয়নি।”
আলোচনা সভায় দেশের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান ও সাবেক নেতারা।
এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ বলেন, “বঙ্গবন্ধুর আত্নত্যাগের কারণে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক।
“মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। ওই সময়ে তিনি দেশের উন্নয়নের ছক করেছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই উন্নয়নের ছকে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুর একটা স্ট্রং ইকোনমি গড়ার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আসুন, ব্যবসায়ী বন্ধুরা প্রধানমন্ত্রীর হাতে হাত ধরি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তর করি।”
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সালমান এফ রহমান বলেন, “আজকে দেশ স্বাধীন না হলে কোনো কিছুই অর্জন হত না। বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর অবদান জানতে হবে সবাইকে।
“অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সেটা ধরে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দেশের মানুষ যেন সুখী থাকে, ভাল থাকে। এটা নিশ্চিতে সবাইকে কাজ করতে হবে।
“বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন। ব্যবসায়ীরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। সেটি আরও ভালোভাবে পালন করতে হবে। এই সরকার ব্যবসায়ী বান্ধব। প্রধানমন্ত্রী অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেবেন।”
সভায় অন্যদের মধ্যে সংগঠনের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, মীর নাসির উদ্দিন ও একে আজাদ বক্তব্য দেন।
অন্যদের মধ্যে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।