‘তৃণমূল বিএনপি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা বলেছেন, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একটি ‘ব্যর্থ দলে’ পরিণত হয়েছে।
Published : 20 Nov 2015, 02:07 PM
শুক্রবার ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন দল গঠনের এই ঘোষণা দেন বিএনপির সাবেক নেতা হুদা। তিনি জানান, প্রতীক হিসেবে তিনি ‘ধানের ছড়া’ চাইবেন। পল্টনের মেহেরবা প্লাজায় হবে দলের কার্যালয়।
তিনি বলেন, “বিএনপির নেতৃত্বে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব, সিদ্ধান্তহীনতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচিত কমিটি গঠনে ব্যর্থতার কারণে দলটি আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন এই দলটি ব্যর্থ হয়েছে এবং এর জন্য আমি সরাসরি শীর্ষ নেতৃত্বকে দায়ী করছি।”
নেতৃত্বে ‘পরিবর্তন না এলে’ বিএনপির আর ঘুরে দাঁড়ানোর ‘উপায় নেই’ বলে মন্তব্য করেন দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন এই সদস্য।
বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (বিএনএ) এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি (বিএমপি) নামে তিনটি দল গড়েছিলেন নাজমুল হুদা। এই হিসেবে ‘তৃণমূল বিএনপি’ তার ‘তৈরি’ চতুর্থ দল।
সংবাদ সম্মেলনে হুদা বলেন, “আমি মনে করছি, নেতা-নেত্রীর কারণে কোটি কোটি মানুষের সমর্থনপুষ্ট বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন হতে দেয়া যাবে না। বিএনপির যাত্রা নতুন করে শুরু করতে হবে নতুন নামে। এই লক্ষ্যে তৃণমূল বিএনপির যাত্রা শুরু করলাম।”
হোটেল ওয়েস্টিনে তার এই সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের জনা চল্লিশেক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। তারা আগে কোন দল বা সংগঠনে ছিলেন, তা জানানো হয়নি।
মঞ্চে নাজমুল হুদার পাশে ছিলেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) একাংশের চেয়ারম্যান এম নাজিমউদ্দিন আল আজাদ, যিনি এইচ এম এরশাদের সরকারে ধর্মমন্ত্রী ছিলেন।
এছাড়া লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান সেকান্দর আলী মনি, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান এ আর এম জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিনও মঞ্চে ছিলেন।
এর মধ্যে এলডিপি ও লেবার পার্টির আরেক অংশ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে রয়েছে।
রাশিয়া দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব ক্রিস্টিনা বয়কোকেও সংবাদ সম্মেলনে দেখা যায়। মঞ্চের পেছনে ব্যানারে দেখা যায় ‘তৃনমূল বিএনপি’র লাল সবুজ পতাকা।
লিখিত বক্তব্যে নাজমুল হুদা বলেন, “মাঠ পর্যায়ে বিএনপির ত্রাহি অবস্থা। দলটি পরিচালিত হচ্ছে উত্তারাধিকার সূত্রে লন্ডন থেকে নির্দেশিত পথে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান যে রাজনীতি করে গেছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি ঠিক তার বিপরীত। দলীয় স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়ে বিএনপি নিবেদিত ব্যক্তিস্বার্থে।”
‘ব্যর্থতার জন্য’ খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতৃবৃন্দের আর দলীয় পদে থাকার ‘নৈতিক অধিকার নেই’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“পকেট থেকে, উপর থেকে, মাঝে মাঝে টাকার বিনিময়ে, দলের মাঠকর্মীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন কমিটি। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবি থেকে উৎসরিত দেশব্যাপী আন্দোলন ধরে রাখতে বিএনপি এ কারণেই ব্যর্থ হয়েছে।”
হুদা বলেন, বিএনপি থেকে যারা ‘ছিটকে’ পড়েছেন, ‘বঞ্চিত’ হয়েছেন, বিভিন্ন কারণে বিএনপির রাজনীতি ‘করতে পারছেন না’, তাদের জন্য তৃণমূল বিএনপি একটি ‘প্ল্যাটফরম’ হবে।
“অনেকে নতুনভাবে বিএনপি করতে চান। কিন্তু বর্তমান বিএনপির বেহাল দশা দেখে তাদের অনেকে এগিয়ে আসছেন না। আমি একটা অপুরচুনিটি ওপেন করেছি মাত্র।
“এটা কী রূপ নেবে সেটা আল্লাহই জানে। এটা নিয়ে আমার তাড়াহুড়া নেই। আমি প্রসেসটা শুরু করেছি।”
কেমন হবে ‘তৃণমূল বিএনপি’
নাজমুল হুদা বলেন, তৃণমূল বিএনপি কাজ করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক নীতি নিয়ে। প্রতি ওয়ার্ড থেকে কোনো চাঁদা ছাড়াই প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ করা হবে। আপাতত তিনিই এ দলের আহ্বায়ক।
“আগামী বছর ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচিত করা হবে। এই নির্বাহী কমিটি আগামী বছর ১ অক্টোবর ২১ সদস্যের জাতীয় স্থায়ী কমিটি নির্বাচন করবে।”
নাজমুল হুদা জানান, নির্বাচনের সময়ে প্রতীক হিসেবে তিনি ধানের ছড়া চাইবেন, যা এখন বিএনপির প্রতীক।
“এ নিয়ে আইনি জটিলতার সম্ভাবনা আছে। তবে যেহেতু আমি আইনজীবী, সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত আমি লড়াই করব।”
ধানের শীষ ও ধানের ছড়ার মধ্যে পার্থক্য কী- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে হুদা বলেন, “একটা শীষ, আরেকটা ছড়া- এটাই পার্থক্য। বিএনপি যদি আপত্তি করে সেক্ষেত্রে সোনালী আঁশ পাট তো আছে।”
তিনি জানান, ‘সুস্থ রাজনীতির ধারা’ বজায় রেখে, রাজপথের উত্তপ্ত রাজনীতি থেকে জনগণকে ‘রেহাই দিয়ে’ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ‘জনগণের সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা বলে তার দলের লক্ষ্য।
সরকারের প্ররোচনায় বিএনপি ভাঙার জন্য এই দল গঠন হচ্ছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নাজমুল হুদা বলেন, “আমি কেন ভাঙার চেষ্টা করব? বিএনপি এই অভিযোগ করছে… বিএনপি কার মদদে এসেছিল? সরকারের মদদে আসেনি? একই তো কথা।”
“আমি সরকারের মদদে আসছি কিনা, তা বলতে চাই না। যারাই মদদ করবে, আমার এই দলকে প্রসার করতে আমি সাধুবাদ জানাব।”
সরকার মদদ দিলে গ্রহণ করবেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “হোয়াই নট? অফকোর্স নেব। দেশপ্রেমিক শক্তিকে গড়ে তুলতে যারাই উদ্যোগ নেবে, তা গ্রহণ করতে আমি প্রস্তুত। আই ডোন্ট কেয়ার- অমুকে দালাল, তমুকে দালাল… কার দালাল কে হয়!”
তৃণমূল বিএনপির আহ্বায়ক বলেন, তিনি ‘র’ বা ‘আইএআই’ এর দালাল না। দেশপ্রেমিক যে শক্তিই তাকে ‘কাজে লাগাতে’ চাইবে, তিনি ‘সার্ভ’ করবেন।
হুদা নিজে দুর্নীতিমুক্ত কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত। দুর্নীতিবাজ যারা আছে, ভবিষ্যতে আমি সুন্দরভাবে শনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব।”
বিএনপি থেকে তৃণমূল বিএনপি
১৯৭৮ সালে তখনকার সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর গঠিত প্রথম স্থায়ী কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন নাজমুল হুদা। খালেদা জিয়ার দুই সরকারের আমলে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
নানা ঘটনায় আলোচিত হুদা ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়ার কারণে মন্ত্রিত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।
দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ২০১০ সালের ২৩ জুন তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। হুদা তখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান।
ভুল স্বীকার করে খালেদা জিয়ার কাছে আবেদন করার পর ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আবার বিএনপির সদস্যপদ ফিরে পান তিনি। কিন্তু ২০১৪ সালের ৬ জুন সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অভিমানের কথা তুলে ধরে বিএনপি ত্যাগের ঘোষণা দেন।
ঢাকার দোহারের এই সাবেক সাংসদ বিগত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলাও হয়েছিল।
২০১০ সালে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর হুদা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) নামে নতুন দল খোলেন। অবশ্য ওই দল থেকেও তিনি বহিষ্কৃত হন।
দ্বিতীয় দফা বিএনপি ছড়ার পর গতবছর মে মাসে হুদা গঠন করেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স- বিএনএ। কিন্তু ওই দলের তেমন কোনো কার্যক্রম না থাকায় এক পর্যায়ে তার বিএনপিতে ফেরার গুঞ্জন ওঠে।
এরপর গতবছর ২৯ নভেম্বর নাজমুল হুদা ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি’ গঠনের ঘোষণা দেন। আর চলতি বছর জানুয়ারিতে ৩০টি দল নিয়ে ‘বাংলাদেশ জাতীয় জোট’ নামে নতুন একটি মোর্চা গঠনের ঘোষণা দেন তিনি।