“উনি আমার কথার জবাব দেন, আবার আমি তার কথার জবাব দিই। এটা তো এক ধরনের... এটা একটা ইন্টার্যাকশন এক্সচেঞ্জ। এটা একটা ফাইন এক্সচেঞ্জ।”
Published : 13 Dec 2023, 03:00 PM
প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জেলখানায় বন্দি, তার সঙ্গে নিয়মিত বাগযুদ্ধ হয় না দেড় মাস হল; সেই অভাব ভালোই অনুভব করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
ফখরুলের জামিন না হওয়ায় বিএনপি নেতারা সরকারকে দায়ী করলেও কাদের দোহাই দিচ্ছে আইনের। তার ভাষায়, আইন ‘বাধা হয়ে দাঁড়ালে’ করার কিছু থাকে না।
বুধবার দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ওবায়দুল কাদের। সেখানে নানা কথার ফাঁকে মির্জা ফখরুলের প্রসঙ্গ আসে। একজন সাংবাদিক জানতে চান, বিএনপি মহাসচিব দীর্ঘদিন ধরে জেলে থাকায় তাকে কাদের ‘মিস করছেন’ কি না।
জবাব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘মিস করা’ শব্দটা তিনি বলতে চান না, তবে অভাবটা তিনি অনুভব করেন।
“থাকলে ভালো হত। এই যে.... মানে এটা... এমন একটা বিষয়, যে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে এটা একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা। এতে গণতন্ত্রই লাভবান হয়।
“তো, এখন এখানে আইনের ব্যাপার যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তো করণীয় কিছু নেই… থাকলে ভালো হত।”
নির্বাচন সামনে রেখে এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বিএনপির এক দফা আন্দোলনে জমে উঠেছিল রাজনীতির মাঠ। দেশেল দুই বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একই দিনে একই সময়ে কর্মসূচি দিচ্ছিল, যা নিয়ে জনমনে উদ্বেগও বাড়ছিল।
বিএনপি মহাসচিব নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সরকারকে নিশানা করে যেসব বাক্যবাণ ছুড়তেন, তার ঝাঁঝালো জবাব আসত ওবায়দুল কাদেরের ব্রিফিং থেকে। কাদেরের পাল্টা তীরের উত্তরে ফখরুল ফের কোনো বাক্য বোমা ছুড়ে দিতেন। পাল্টাপাল্টি গুরুতর অভিযোগ বর্ষণের পাশাপাশি তাদের কথায় থাকত নির্মম সব রসিকতা। এটাই হয়ে উঠেছিল প্রতিপক্ষ দুই নেতার নিত্যদিনের বাচিক রাজনীতির চর্চা।
বিএনপির আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই সময় গত ২৮ অক্টোবর দলটির সমাবেশ ঘিরে ঢাকার কাকরাইলে সংঘর্ষ বাঁধে। পণ্ড হয়ে যাওয়া সমাবেশ থেকে বহু দিন পর হরতাল ডেকে বসেন মির্জা ফখরুল।
পরদিন সকালে গুলশানের বাসা থেকে বিএনপি মহাসচিবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন থেকেই তিনি কারাগারে। তার আইনজীবীরা হাকিম আদালত থেকে জজ কোর্ট, সেখান থেকে হাই কোর্টে গেলেও জামিন করাতে পারেননি।
তখন থেকেই দফায় দফায় হরতাল অবরোধ দিয়ে আসছে বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতির পরিচিত অনুসঙ্গ কাদের-ফখরুল বাগযুদ্ধও তখন থেকে বন্ধ।
‘মিস করি না’ বললেও কাদের কতটা ‘মিস’ করছেন, তা তার কথাতেই স্পষ্ট।
“উনি (ফখরুল) আমার কথার জবাব দেন, আবার আমি তার কথার জবাব দিই। এটা তো এক ধরনের... এটা একটা ইন্টার্যাকশন এক্সচেঞ্জ। এটা একটা ফাইন এক্সচেঞ্জ।
"আমি অভ্যাসগতভাবে মিস করা বলি, ওইভাবে বলতে চাই না। আমি বলছি, উনার সাথে প্রতিদিন যে কথাবার্তা, যে কাউন্টার হয়। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনিও আক্রমণ শাণিত করেন। তো সেটার জবাব দিতে ভাললাগে।
“আক্রমণ শাণিত করলে তার সঠিক উত্তরটাও আমাদের দিতে হয়। সেদিকটা অবশ্যই এখন অনুপস্থিত। এটা ঠিকই। মিস-টিস এইগুলা বলতে চাই না।"
ফখরুল না থাকায় বিএনপির মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। অন্য অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার মত আত্মগোপনে থাকলেও প্রতিদিনই তিনি হাজির হচ্ছেন ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে। আবার হরতাল-অবরোধের সমর্থনে কয়েক ডজন নেতাকর্মী নিয়ে একেক দিন সকালে একেক জায়গায় ঝটিকা মিছিল করে আবার গায়েব হয়ে যাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ অফিসের ব্রিফিংয়ে ফখরুলের অভাব কিছুটা রিজভীকে দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করেন কাদের।
তিনি বলেন, “এই যে বিএনপির বর্তমান অনাবাসিক প্রতিনিধি রিজভী আহমেদ, দশ বারোজন লোক নিয়ে বের হয়। কী করে, অসুস্থ একটা লোক। রিজভীকে দেখেও আমরা না দেখার ভান করি।"
ফখরুলের প্রসঙ্গের পর বরাবরের মতই বিএনপির সমালোচনায় মুখর হন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
তিনি বলেন, "সারা দেশে আগুন সস্ত্রাস করে বিএনপি কোন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় এটা আমাদের প্রশ্ন।এটা নির্বাচন বিরোধী ষড়যন্ত্র। তাদের নাশকতার লক্ষ্য হচ্ছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে নাশকতার মাধ্যমে বানচাল করা।
"আজকে তারা গভীর ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে, তারা কিছু প্ল্যান তৈরি করে রেখেছে, তারা চায় গুপ্ত হামলা, গুপ্ত হত্যা, আজকে বাসে আগুন দিয়ে নাশকতা সৃষ্টি... এসব অপকর্ম বিএনপির দোসররা করতে চায়। এর জন্য আমরা সতর্ক পাহারা আরও জেরদার করেছি।"
নাশকতা প্রতিরোধে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাও তৎপর আছে জানিয়ে সরকারের সেতুমন্ত্রী কাদের বলেন, "আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবে। এই নির্বাচন আমাদের সফল করতে হবে, শান্তিপূর্ণ করতে হবে। ব্যাপক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চত করতে হবে।
"এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য সমমনা সবার সঙ্গে আমরা বসছি, আলাপ আলোচনা করে যাচ্ছি। দেশের মানুষকে ভয়-ভীতির মধ্যে রাখার চক্রান্ত করছে বিএনপি। এর মধ্যেই ব্যাপক ভোটার উপস্থিত করতে হবে।
“তারা যতই নাশকতা করুক, মানুষ নির্বাচনমুখী, মানুষ ভোট দিতে উন্মুখ। উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অন্যরা ভেবেছিল বড় দল নেই, নির্বাচনের পরিবেশ ম্লান হয়ে যাবে, ভোটে জাগরণের ঢেউ থাকবে না। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক উৎসবমুখর পরিবেশ অব্যাহত রয়েছে। ৭ জানুয়ারি ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতিতে ভালো নির্বাচন হবে।"
কাদের বলেন, "আমরা এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও পার্ফেক্ট করব, আমাদের গণতন্ত্র বিকাশমান। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র পার্ফেক্ট নয়। আমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি যাই আছে, এই সব বিষয়গুলো দূর করে আমরা গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে আরও মসৃণ করব।"
জামায়ত ও বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী করতে পারে, সে বিষয়ে ওবায়দুল কাদেরের মতামত জানতে চেয়েছিলেন একজন সাংবাদিক।
জবাবে তিনি বলেন, "শেষ মুহূর্তে তারা এক মোহনায় একাকার হবে। বিএনপি মানে জামায়াত, আর জামায়াত মানে বিএনপি। দুঃখ হয়, বিএনপির বি টিম জামায়েত থেকে কদিন পরে জামায়েতের বি টিম হয়ে যাবে বিএনপি।"
ভোটে জোটের কী হবে
গত দুইবারের মত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও জোটগতভাবে করার কথা আওয়ামী লীগ আগেই জানিয়ে রেখেছে। তবে ১৪ দলের শরীকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি কীভাবে হবে, সেই ফয়সালা এখনও হয়নি।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেন, “জোট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের শঙ্কা, গুজব আছে। আমরা সতর্ক আছি। গুজব, গুঞ্জন, সন্ত্রাস, সহিংসতা আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না।আমরা বিচলিত হব না, আমরা সব জেনেশুনেই নির্বাচনে।
"নির্বাচন যথা সময়ে হবে, আমাদের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির মাধ্যমে নির্বাচনবিরোধী অপতৎপরতার জবাব দেব।"
জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকবে কি না, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব সংশয়ে আছে বলে খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। সে বিষয়েও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় কাদেরকে।
জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের তো তারা বলেছে, তারা নির্বাচনে আছে, জোটে থাকতে চায়। তারা তো সরে যাবে বলেনি। সরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে, এটা নিয়ে আমরা আরও নিশ্চত হতে চাই। ১৭/১৮ তারিখ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। অস্বস্তির কিছু নেই।
আওয়ামী লীগের যারা মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদেরও অভয় দেন দলের সাধারণ সম্পাদক।
তিনি বলেন, "স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উঠিয়ে দিতে পারব না। এখন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের আন্ডারে। আমরা তো জোর করে বসিয়ে দিতে পানি না। এখানে আপস করার সুযোগ নেই।"
অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা, শিক্ষা ও মানব সম্পদ সম্পাদক সামসুন্নাহার চাঁপা, উপ প্রচার সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল আওয়াল শামীম, উপ দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।