নির্বাচনকালীন সরকারে থাকতে ‘কোনো আগ্রহ নেই বিএনপির’

২০১৮ সালে সংলাপের পরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, “ওবায়দুল কাদের সাহেবের কথায় আস্থা রাখা, বিশ্বাস করা– এটার প্রশ্নই উঠতে পারে না।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 May 2023, 11:54 AM
Updated : 9 May 2023, 11:54 AM

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি অভিযোগ করেছেন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে দেওয়া কথা ‘রাখা হয়নি’। এখন ওবায়দুল কাদেরের কথায় ‘আস্থা রাখার মানে হয় না।’

সরকার নির্বাচন নিয়ে ‘পুরনো খেলা শুরু করেছে’ মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, তারা সিটি নির্বাচনে না গেলেও নগরে নেতা-কর্মীদের ‘গ্রেপ্তার অভিযান’ শুরু হয়েছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে দ্রুত রায় দিতে একটি তালিকা করার কথাও জানতে পেরেছেন তারা।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা তুলে ধরতে মঙ্গলবার গুলশানের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন ফখরুল। এ সময় এসব কথা বলা হয়।

নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে কি না, এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি যে বক্তব্য রাখেন, তার জবাব দেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, ‘‘আপনারা কি বিশ্বাস করেন? ২০১৮ সালে শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে আমরা তার সঙ্গে সংলাপে বসেছিলাম। সেই সংলাপে যে সমস্ত কথা তিনি দিয়েছিলেন সেগুলোর একটাও তারা রক্ষা করেননি।

“সুতরাং ওবায়দুল কাদের সাহেবের কথায় আস্থা রাখা, বিশ্বাস করা– এটার প্রশ্নই উঠতে পারে না। এগুলোকে আমি মনে করি, এটা আরেকটি চক্রান্ত জনগণকে বিভ্রান্ত করবার। তারা বলবে যে এই তো আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, ওরা শুনছে না, যাচ্ছে না…।”

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কী বলেছিলেন কাদের?

দুই দিন আগে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইতিবাচক সাড়া দেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা।

সেদিন তিনি বলেন, “কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত যদি নিতে হয়, তাহলে সংবিধানের মধ্যেই থাকতে হবে। সংবিধানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকলে আপনি যেটা বললেন, এটাতে কোনো অসুবিধা নেই।

“বিএনপি যদি বলে আমরা নির্বাচনে আসব। নির্বাচনে আসলে তখন এক কথা। তারা নির্বাচন করবেই না তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া। তারা এই সংসদকে চায় না। মন্ত্রিসভা, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চায়। এসব শর্তারোপের মধ্যে আমরা কীভাবে বলব যে, আপনারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিতে আসুন বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় আপনাদের দিচ্ছি? তাদের তো সম্পূর্ণ উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর অবস্থান।”

‘কারচুপির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে’

২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ‘কারচুপির’ অভিযোগ এনে ফখরুল দাবি করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য ‘সেই প্রক্রিয়া’ এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল।

তিনি বলেন, “তারা যেভাবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফলাফলটাকে তাদের পক্ষে নিয়েছিল, ঠিকই কায়দায় বিরোধী দলকে সম্পূর্ণভাবে মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা… নির্বাচনে যেটা আমরা বলি ‘রিগিং প্রসেস’, সেটা তারা শুরু করে দিয়েছে।”

২০১৮ সালের নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার সময় থেকে ‘এসব শুরু হয়েছিল’ মন্তব্য করে ফখরুল বলেন, “মিথ্যা মামলা ও গায়েবি মামলা করে আবার নেতা-কর্মীদেরকে মাঠ থেকে পুরোপুরিভাবে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি তারা শুরু করে দিয়েছে।

“তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, একটা ‘নীলনকশার নির্বাচন করা। বিরোধী দলকে পুরো মাঠ থেকে বের করে দেওয়া এবং এরপর সেই ‘নীলনকশার’ নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসা-এটাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই তারা কাজ করছে।”

‘পুরনো মামলার চূড়ান্ত রায় দিতে তালিকা’

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোর ‘রায় দিতে তালিকা করেছে’ বলে অভিযোগ করেন ফখরুল। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ওই তালিকা করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

বিএনপি নেতা বলেন, “গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে তারা (সরকার) ব্যবহার করতে শুরু করেছে, ইনক্লুডিং জুডিশিয়ারি অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। কীভাবে বিরোধী দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, নেতৃবৃন্দ এবং যারা এই চলমান আন্দোলনে নেতৃত্বে দায়িত্ব পালন করছেন, তাদেরকে কীভাবে মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, সেজন্য তারা কাজ করছে।”

সারাদেশে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নামে ১ লাখ ১১ হাজার ৫৪৩টির বেশি মামলা করার অভিযোগ আনেন ফখরুল। বলেন, এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৮১ জনের বেশি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২ হাজার ৮৩০ টির বেশি মামলা রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।

‘সিটি নির্বাচনে না থাকলেও নগরে নগরে অভিযান’

বিএনপি পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিলেও নির্বাচনী এলাকায় নেতা-কর্মীদের ‘গণহারে’ গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ফখরুল।

তিনি বলেন, ‘‘একতরফা বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন করছে। সিলেটে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার ও বাসায় বাসায় তল্লাশি করছে। এ বিষয়টি সিলেটের নেতৃবৃন্দ সেখানকার পুলিশ কমিশনারকে অবহিত করেছে।”

জাতীয় নির্বাচনের আগে যে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হচ্ছে, তাতে প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণা আছে বিএনপির। তবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বিএনপির গতবারের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহ নূর ইসলাম রনি স্বতন্ত্র পরিচয়ে প্রার্থী হয়েছেন। জানিয়েছেন, বিএনপির তৃণমূল তার পাশেই আছে।

সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী টানা দুটি নির্বাচনে জিতে এবার হ্যাটট্রিকের স্বপ্ন দেখছেন। বিএনপি ভোটে না এলেও তিনি প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

রাজশাহীতে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফার ভাই সাঈদ হাসান প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বরিশালেও বিএনপির প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রূপন স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। খুলনায় আগ্রহ দেখিয়েছেন বিএনপির গতবারের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু।

মির্জা ফখরুল বলেন, “এই ‘অবৈধ সরকারের’ অধীনের কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না।”

সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এখন ‘গণদাবিতে’ পরিণত হয়েছে বলেও দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, “অন্যথায় রাজপথে এই দাবির ফয়সালা হবে”।

‘এবার পারবে না সরকার’

ফখরুল বলেন, “জনগণ ইতোমধ্যে রাস্তায় নেমেছে, আন্দোলন শুরু করেছে। আমাদের ১৭ জন মানুষ এই আন্দোলনে রাজপথে প্রাণ হারিয়েছে, আমাদের অসংখ্য নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে।

“এই আন্দোলন আরও বেগবান হবে, আরও তীব্র হবে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সরকার বাধ্য হবে জনগণের দাবি মেনে নিতে।”

নতুন কর্মসূচি কবে

বিএনপির আন্দোলন নিয়ে ফখরুল বলেন, ‘‘আন্দোলন একটা ঢেউয়ের মত। এটা কখনও উঠে, কখনও নামে। জনগণের পরিপ্রেক্ষিত বুঝে আমাদেরকে আন্দোলনটা করতে হয়। রোজার মাসে তো স্বাভাবিকভাবে তো যারা রোজা রাখেন… সেটাতে খেয়াল রাখতে হয়।

“যারা আন্দোলনের অংশীদার আছেন, শরিক দলগুলো আছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা চূড়ান্ত আলোচনার পর্যায় এসেছি। শিগগিরই নতুন করে কর্মসূচি জানতে পারবেন।” 

‘আমরাও কাউকে নালিশ করি না’

জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে এক প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘‘আমরা কাউকে কোনো নালিশ করি না, আমরা কাউকে কিছু বলতে যাই না… এটা মনে রাখতে হবে।

“দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এখানে বিদেশি যেসব মিশন আছে অথবা যারা কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে রুটিন আলোচনা হয়, সেই আলোচনা হয়েছে।”