সরকারি চিঠি বলছে, এই বরাদ্দ অস্থায়ী; তবে কাদের সিদ্দিকীর দাবি, বাড়িটি তাকে দলিল করে লিখে দেওয়া হয়েছে।
Published : 17 Aug 2023, 11:29 PM
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে কয়েক যুগ ধরে বাস করছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। কিন্তু তার নামে ওই বাড়ি বরাদ্দের কোনো কাগজপত্র ছিল না। বাড়িটি দখলে রাখা নিয়ে বিভিন্ন সময় কথাও শুনতে হয়েছে তাকে।
৫ দশক পর আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িটি তার নামে বরাদ্দ হল। তিনতলা বাড়িসহ ২০/৩০ বাবর রোডের পাঁচ কাঠার ওই জমি বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়ে কাদের সিদ্দিকীকে অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দিয়েছে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড।
তবে কাদের সিদ্দিকী দাবি করছেন, ১ হাজার এক টাকায় তাকে ওই বাড়িটি লিখে দেওয়া হয়েছে। তিনি দলিলে সই করেছেন। এখন থেকে বাড়িটি তার।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন কাদের সিদ্দিকী স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে বাড়িটিতে থাকছেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানান।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে নামার পর দেশ ছাড়তে হয়েছিল তাকে। নির্বাসন থেকে ১৯৯০ সালে দেশে ফেরার পর সপরিবারে আবার সেই বাড়িতেই থাকা শুরু করেন তিনি।
এর মধ্যে ২০১২ সালে সংসদ সদস্য গাজী গোলাম দস্তগীরের এক প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান সংসদে বলেছিলেন, ২০/৩০ বাবর রোডের বাড়ি ‘অবৈধ দখলে’ রেখেছেন কাদের সিদ্দিকী।
তার ১১ বছর পর ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার সাগুফতা হকের স্বাক্ষরে ওই বাড়িটি কাদের সিদ্দিকীকে বরাদ্দ দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রশিক্ষণে থাকায় এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারেননি তিনি।
কোন প্রক্রিয়ায় কাদের সিদ্দিকীর নামে পরিত্যক্ত বাড়িটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা জানতে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ডের সভাপতি মো. সাবিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বরাদ্দের ফাইলপত্র না দেখে এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
“নথিতে কী আছে, সেটি আগে দেখতে হবে। এরপর সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যাবে,” বলেন তিনি।
ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, কাদের সিদ্দিকীর হাতে অস্থায়ী বরাদ্দপত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তার সঙ্গে একটি চুক্তিপত্রও হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বাবর রোডের ওই বাড়িতে গেলে নওয়ার মিয়া নামে এক ব্যক্তি দরজা খুলে দেন। নিজেকে কাদের সিদ্দিকীর সহকারী দাবি করে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু কাদের সিদ্দিকীকে এই বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিলেন।
“হয়ত রাজনৈতিক কোনো কারণে এতদিন কাজগপাতি হয়নি। আগে হয়ত তার নামে ওইভাবে বাড়ির বরাদ্দ ছিল না, এখন হয়ত তার নামে বরাদ্দ হয়েছে।”
বাড়টি দেখভাল করার জন্য কয়েকজন লোক আছে জানিয়ে নওয়ার মিয়া বলেন, সময় ভাগ করে একেকজন একেক সময় দায়িত্বে থাকেন।
ওই বাড়ির সামনের বাড়ির তত্ত্ববধায়ক হামিদ উল্লাহ বলেন, “আমি গত আট বছর ধরে এই বাড়িতে আছি। আট বছর ধরে কাদের সিদ্দিকীকে এই বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে দেখি। এই বাড়িতে যে কাদের সিদ্দিকী থাকেন, তা এলাকার সবাই জানে।”
বাড়িটির সামনে বড় একটি আম গাছ এবং দুটি নারিকেল গাছ রয়েছে। ফটকে লাল-সবুজ রঙ করা। এই বাড়ির আশপাশের ভবনগুলো বহুতল হলেও পরিত্যক্ত ঘোষিত বাড়িটি আগের মতোই তিন তলা রয়েছে।
যে যে শর্তে বরাদ্দ
গত ৫ জুলাই বাড়িটি বরাদ্দ দিয়ে কাদের সিদ্দিকীকে চিঠি দেয় পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড।
তাতে বলা হয়েছে,
গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কর্তৃক ধার্যকৃত হারে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। তবে শহীদ পরিবার বা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র প্রাপ্ত হইলে ধার্যকৃত ভাড়ার পরিমাণ অর্ধেক হবে।
ধার্যকৃত ভাড়া গণপূর্ত রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কর্তৃক ট্রেজারি চালান পাস করে নির্ধারিত কোড নম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়মিতভাবে পরিশোধ করতে হবে।
কনজারভেন্সি, পানির বিল, পৌরকর, তিতাস গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি যথাযথভাবে বরাদ্দ প্রাপককেই পরিশোধ করতে হবে।
সরকারের পূর্ব অনুমতি ছাড়া বাড়িটির কোনো প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা মেরামত করা যাবে না। বাড়ির কোনো কিছু ক্ষতি বা বিনষ্ট হলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর ধার্যকৃত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে হবে।
বাড়িটি কোনো অবস্থাতেই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। তা করলে বরাদ্দপত্র বাতিল বলে গণ্য হবে।
বরাদ্দ প্রাপক নিজে না থেকে অথবা আংশিকভাবে থেকে যদি অন্য কাউকে ভাড়া দিয়ে থাকেন, তবে তার বরাদ্দপত্র তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করে সাত দিনের মধ্যে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
সরকার যদি জনস্বার্থে নিজ দরকার বলে মনে করে বা এটিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে অবমুক্ত করে দেয়, তবে যথারীতি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাড়িটি খালি করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার বরাদ্দ দেওয়া বাড়িটির পরিবর্তে অন্য কোনো বাড়ি বরাদ্দ দিতে বাধ্য থাকবে না।
বাড়িটি এখন আমার মালিকানায়: কাদের সিদ্দিকী
পরিত্যক্ত বাড়িটি অস্থায়ীভাবে বরাদ্দের বিষয়টি সরকারি নথিতে দেখা গেলেও কাদের সিদ্দিকী বলছেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, বাড়িটি ১ হাজার ১ টাকায় তাকে দলিল করে দেওয়া হয়েছে।
শর্তের বিষয়ে তিনি বলেন, “এক হাজার এক টাকায় বাড়িটির দলিল করে দিয়েছে। পাঁচ কাঠা জমি। শর্ত দেওয়ার বিষয়টি বোগাস। দলিলে ওরকম কিছু নেই। দলিলে ওগুলোর কিচ্ছু নেই। বাড়িটি সম্পূর্ণ আমার মালিকানায়।”
এই বাড়িটির বরাদ্দ পেতে গত ৩০ বছর ধরে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াকে (তারা যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) চিঠি দিয়েছিলেন জানিয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেন, “১৯৯০ সালে দেশে ফেরার পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার, এরপর খালেদা জিয়ার সরকার, তারপর আবার শেখ হাসিনার সরকারের কাছে আমি একই চিঠি দিয়েছিলাম।
“৬/৭ মাস আগে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলাম। উনি উনাদেরকে (পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড) দিতে বলেছেন, দিয়ে দিয়েছে।”
কাদের সিদ্দিকী বলেন, “আমি ১৯৯০ সালে দেশে আসার পর দেখি আমার বাড়িসহ আশেপাশে আরও ৮৪টি বাড়ির কোনো কাগজপত্র পূর্ত মন্ত্রণালয়ে নেই। সেইজন্য এইরকম অসুবিধা, মাঝেসাজেই বলতেন- ‘অবৈধ দখল করা’।”
আগেও তার নামে বাড়িটির বরাদ্দপত্র ছিল বলে দাবি করেন তিনি। তবে কবে, কীভাবে, কে সেই বরাদ্দপত্র দিয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি।
এ বিষয়ে কয়েকবার প্রশ্ন করলে বিরক্তি প্রকাশ করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, “এখন সব জিনিসই ওলটপালট। বন্ধবন্ধুর কথা ভাবা এখন একটা অন্যরকম বিষয়।”
একাত্তরে কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কাদের সিদ্দিকীকে বঙ্গবন্ধু অন্তঃপ্রাণ হিসেবেই চেনেন সবাই। ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগে সক্রিয় হয়ে সংসদ সদস্য প্রার্থীও হয়েছিলেন নিজের পৈত্রিক এলাকা টাঙ্গাইলে। সেবার হারলেও ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তবে কয়েক বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ ছেড়ে নতুন দল কৃষক, শ্রমিক, জনতা লীগ গঠন করেন তিনি। ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরতে থাকেন তিনি।
কাদের সিদ্দিকীরা সব ভাই আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তাদের বড় ভাই আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। তবে হজ নিয়ে এক মন্তব্যের জন্য মন্ত্রিত্ব, দলীয় পদ সবই হারিয়ে তিনি এখন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। অন্য ভাইরাও আওয়ামী লীগে নেই।
এদিকে রাজনৈতিক মেরুকরণে বিএনপির সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ২০১৮ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেন তিনি। নিজে ভোট করতে না পারলেও তার মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী টাঙ্গাইলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে লড়েন, তবে পরাজিত হন।
ভোটের পর বিএনপি জোট ছেড়ে আসা কাদের সিদ্দিকীর এবারের অবস্থান কী হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
গত বছরের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সপরিবারে দেখা করে এসেছিলেন তিনি।
তবে বুধবারই টাঙ্গাইলে এক জনসভায় তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, “জাতীয় নির্বাচনের আগে বলে দিতে চাই আমার বোনকে, ভালো হয়ে যান। মানুষ এখন আপনাদেরকে চায় না, বিএনপিকেও চায় না।”