‘খেলা হবে’ কোন রাজনীতির ভাষা, প্রশ্ন ফখরুলের

বিএনপি মহাসচিবের ভাষ্য, ‘খেলার রাজনীতিতে’ তারা বিশ্বাস করেন না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2022, 04:06 PM
Updated : 4 Dec 2022, 04:06 PM

ওবায়দুল কাদেরের ‍মুখের ‘খেলা হবে’ স্লোগান দেশের রাজনীতিতে আলোচনা জাগাতে পারলেও একে ‘রাজনৈতিক ভাষা’ বলে মনে করতে পারছেন না মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, সরকার ‘প্রতিশোধ স্পৃহায়’ মেতে উঠেছে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কথায় তিনি সেই আভাসই পাচ্ছেন।

রোববার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল বলেন, “১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে সরকার একটা প্রতিশোধ স্পৃহায় মেতে উঠেছে। অযথা কথাবার্তা বলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রীরা একেবারে উসকানিমূলক, প্রোভোকেটিভ এবং গণতন্ত্রকে বাধা প্রদান করবার জন্য যা যা করা দরকার তারা তা করতে শুরু করেছেন।

“তাদের কথাগুলো দেখেন- খেলা হবে। এটা কোনো রাজনৈতিক ভাষা হল? খেলা হওয়ার ভাষা তো রাজনৈতিক ভাষা নয়। ১০ ডিসেম্বর নিয়ে সরকার যে কথাগুলো বলছে, এগুলো সম্পূর্ণভাবে দেশবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী।”

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান প্রথম ‘খেলা হবে’ স্লোগানটি তুলেছিলেন। সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে তা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও জনপ্রিয় হয়।

২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ‘খেলা হবে’ স্লোগানটি অনানুষ্ঠানিক নির্বাচনী স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে। এ নিয়ে গানও হয় সেখানে।

এরপর সম্প্রতি আবার আওয়ামী লীগের এক সভায় স্লোগানটি ফিরিয়ে আনেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশিদ এ স্লোগানের বিরোধিতা করার পর তা নিয়ে ব্যাখাও দেন ওবায়দুল কাদের।

তখন তিনি বলেছিলেন, “এটা একটা পাবলিক হিউমার। রাস্তায় ফুল বিক্রি করে যে শিশু, সেও আমার গাড়ি দেখলে বলে ‘খেলা হবে’। এটা মানুষ একসেপ্ট (গ্রহণ) করে ফেলেছে।

“খেলা হবে কথাটা ভারতের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল। মমতা ব্যানার্জিও বলেছে, নরেন্দ্র মোদিও বলেছে। তারা বক্তৃতা শুরু করেছেন ‘খেলা হবে’। সেখানে পুরো নির্বাচনটিই ডমিনেট করেছে খেলা হবে।”

তবে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদও স্লোগানের বিরোধিতা করেছেন। শনিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ওই স্লোগান ‘শুনতেও কেমন শোনা যায়’।

রোববারের সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদেরের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, “কিসের খেলা? এখন তো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার বিষয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করার বিষয়, আমার মানুষকে জীবন রক্ষা করার বিষয়, তার তেল, চাল, ডাল, লবণ সমস্ত কিছুর দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তার জন্য জনগণ যে কথা বলছে সেটাকে রক্ষা করার বিষয়।

“তারা (আওয়ামী লীগ) মানুষের জীবনগুলোকে নিয়ে খেলা করেন। এই খেলার রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা বিশ্বাস করি বাস্তবতায়, আমরা বিশ্বাস করি, আমরা অধিকার ফিরে পাওয়ার রাজনীতিতে। আজকে সরকার ব্যর্থ হয়েছে ন্যূনতম জনগণের যে দাবি সেই দাবিগুলো মেটাতে।”

বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করেন, তাদের বিভাগীয় সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে ‘অসংখ্য’ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

“ঢাকা মহানগরে নেতারা কেউ বাসাতেই থাকতে পারছেন না। ব্লক রেইড হচ্ছে ওয়ার্ড অনুযায়ী। এরমধ্যে কোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আমাদের মহানগরের চার জন যুগ্ম আহ্বায়ক- ইউনুস মৃধা, মোশাররফ হোসেন খোকন, হারুনুর রশীদ ও আবদুস সাত্তারসহ ২ শতাধিক নেতা-কর্মীকে।  ৩০ নভেম্বর থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

গত ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনতাই হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিজয় দিবস, বড়দিন ও থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন নিরাপদ নির্বিঘ্ন করতে সারা দেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ বিভাগ। এই অভিযানে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে এক হাজার ৩৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন বলছেন, ঢাকায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, ভাঙচুর, মাদকসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে।

সরকারের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, “দয়া করে গ্রেপ্তার বন্ধ করুন, সবাইকে মুক্তি দিন। সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করেন। কোনো রকমের অস্থিরতা সৃষ্টি করবেন না। অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন, এর দায় আপনাদেরকে বহন করতে হবে।

“আমি আজকে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে চাই, সরকার নাশকতা করছে, সরকার জঙ্গিবাদ করছে, সরকার এখন জঙ্গিদের লালন করার নিয়েছে। এটা আমি স্পষ্ট করে বললাম। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশকে বানচাল করার জন্য সরকারের নানামুখী দমননীতি এখন জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারা ভয়-ভীতি দিয়ে আবারো দমন করতে চায়।”

যুব দলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে আটকের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সরকারের প্রতি বিএনপি মহাসচিব প্রশ্ন করেন, “কী কারণে তাকে আটক করলেন? তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা আছে? তার বিরুদ্ধে কোনো ‘পেন্ডিং কেইস’ আছে যে জামিন নেই? কিচ্ছু না। সব কিছু ‘ক্লিয়ার’ আছে তার।

“কোনো ওয়ারেন্ট না দিয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তুলে দিয়ে চলে গেলেন। এখন পর্যন্ত গাড়ি ও ড্রাইভারের কোনো খবর আমরা পাইনি। এটা সরকারের দমনপীড়নের এক জলন্ত দৃষ্টান্ত। শুধু জনগণের এই আন্দোলনকে দমিয়ে ফেলবার জন্য, গণতান্ত্রিক নেতা-কর্মীদের দমন করবার জন্য, ত্রাস সৃষ্টি করে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য এভাবে বেআইনিভাবে... ।”

Also Read: ‘শুনতেও কেমন শোনা যায়’, খেলা হবে স্লোগান নিয়ে তোফায়েল

Also Read: ‘খেলা হবে’ এবার ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠে

ফখরুল বলেন, শনিবার নয়াপল্টনে তাদের কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ হয়। তারপর পুলিশ আকস্মিকভাবে নেতা-কর্মীদেরকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়।

“দেশের মানুষ বোঝে না এসব? অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এখানে অবস্থা সৃষ্টি করা এবং সেটা আমি বলি যে, নাশকতা সরকার সৃষ্টি করছে। গোটা ঢাকা শহরে তারা একই কাজ শুরু করেছে।

“আপনারা জানেন, মিথ্যা এই সমস্ত ককটেল-মকটেল ফুটিয়ে অন্যদের নামে দিচ্ছে। নাটোরে গুরুদাসপুরে তারা বলেছে যে, একটা দোকান থেকে নয়টি ককটেল উদ্ধার করেছে। ছবিটা আপনারা দেখবেন, ওই ঘরের ছাদ পর্যন্ত নেই। ওখানে নাশকতা করার সুযোগ আছে বলে তো আমার মনে হয় না।

“যারা নাশকতা করে, তারা কি ওইভাবে করে? যাকে বাদী করা হয়েছে সে স্পষ্ট করে বলছেন, ‘আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমি কিচ্ছু দেখিনি, আমি কিচ্ছু জানি না’।”

বিএনপির গণসমাবেশ নিয়ে জনমনে ‘বিভ্রান্ত তৈরি করার জন্য’ মাসখানেক আগে ঢাকা জেলা আদালতে ‘জঙ্গি নাটকের অবতারণা’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।

“বেশ কিছুদিন চুপ থেকে এখন সেই জঙ্গি ধরার নামে মেস-আবাসিক হোটেল-বাসা-বাড়িতে পুলিশ ‘ব্লক রেইড’ দিচ্ছে। পুলিশের এই হানা মূলত বিএনপির নেতা-কর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেপ্তার ও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য। আমি এই ঘৃণ্য চক্রান্তের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। ২০১৩-১৫ সালের পুরনো নাটকের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে এই গণগ্রেপ্তার ও নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে।”

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, মীর সরাফত আলী সপু, আমিনুল হক, আবদুল বারী ড্যানী, আমিরুজ্জামান শিমুল, আকম মোজাম্মেল, আমিনুল ইসলাম, ওমর ফারুক শাফিন, এসএম জাহাঙ্গীর, হায়দার আলী লেলিন, অঙ্গসংগঠনের উলামা দলের শাহ নেছারুল হক, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, শহিদুল ইসলাম বাবুল, জাসাসের সালাহউদ্দিন ভুঁইয়া শিশির ছাত্র দলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

আওয়ামী লীগের ‘রাজনীতিটা কোথায়?’

সংবাদ সম্মেলন শেষে রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দেন বিএনপির মহাসচিব। এবারের কাউন্সিলের প্রতিপাদ্য- ‘স্বৈরাচারী সরকারের পতন, রাষ্ট্র সংস্কার ও রূপান্তরে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ডাক’।

ওই কাউন্সিলে তিনি বলেন, “ভয়ঙ্করভাবে একটা ফ্যাসিবাদ কায়দায় আবারো মনে করছে তারা আগের মতোই জনগণকে নির্যাতন করে, নিপীড়ন করে দাবিয়ে দেবে, জনগণের আন্দোলনকে দমন করবে।

“কিন্তু না, এবার সেটা হবে না। এবার বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে যেভাবে জেগে উঠেছিল আজকে আবার তারা তাদের রাষ্ট্রকে রক্ষা করবার জন্য, তারা তাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করবার জন্য, তাদের অধিকারকে রক্ষা করবার জন্য, তারা তাদের গণতন্ত্রকে রক্ষা করবার জন্য তারা একজোট হয়েছে এবং রাস্তায় নেমে এসেছে। রাস্তায় নেমে আসা-এটা আমাদের ধরে রাখতে হবে, আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে দেশের অবস্থা কি আপনারা সবাই জানেন। ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার করে দিয়েছে একটা ব্যাংক থেকে। এভাবে প্রত্যেকটি ব্যাংককে তারা সাফ করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে তারা ফোকলা করে দিয়েছে, ব্যাংকরাপ্ট করে দিয়েছে। ঠিক আওয়ামী লীগ যেভাবে রাজনীতিতে ব্যাংকরাপ্ট হয়েছে, আজকে ঠিক একই ভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ব্যাংকরাপ্ট করে দিয়েছে।”

আওয়ামী লীগের ‘রাজনীতিটা কোথায়’– এমন প্রশ্ন রেখে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আজকে এখানে যারা বসে আছেন, তারা এক সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই আওয়ামী লীগ কি আছে এখন? এই আওয়ামী লীগ পুরোপুরি আমলা এবং গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। জনগণের ওপর নির্ভরশীলতা এখন নেই। এজন্য জনগণের কথা বললে তারা প্রমাদ গুণতে থাকে, ভয় পেতে থাকে, জনসমাগম দেখলে আরও বেশি ভয় পায়।”

জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রবের সভাপতিত্বে ও জেএসডির নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপনের পরিচালনায় আলোচনা সভায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, গণফোরামের মোস্তফা মোহসিন মন্টু, জাসদের নুরুল আম্বিয়া, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নূর, রাষ্ট্র চিন্তার হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডির ছানোয়ার হোসেন তালুকদার, সিরাজ মিয়া, তানিয়া রব অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।