বিএনপি মহাসচিব বলছেন, “সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি ও হরিলুটের খেসারত আজকে জনগণকে দিতে হচ্ছে।”
Published : 21 Oct 2022, 09:56 PM
সরকার বিদ্যুৎখাতকে ‘বিলিয়নেয়ার তৈরির কারখানায়’ পরিণত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শুক্রবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “গত এক যুগে বিদ্যুৎকেন্দ্র যেন লুটপাটের মাধ্যমে বিলিয়নেয়ার বানানোর শিল্পে পরিণত হয়েছে। লোডশোডিং বেড়েই চলেছে। জাতীয় গ্রিডেও বিপর্যয় ঘটছে।”
দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে ফখরুল বলেন, “প্রশ্ন হচ্ছে এক যুগের বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎখাতে এত বিপুল অর্থ ব্যয় করেও কেন আজ বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার নসিহত দেওয়া হচ্ছে? কেন বিদ্যুৎখাত আজ অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে?”
“উত্তর একটাই, এই সরকার একটা লুটেরা। তাদের (সরকার) লাগামহীন দুর্নীতি ও হরিলুটের খেসারত আজকে জনগণকে দিতে হচ্ছে।”
সরকারের ‘অসৎ নীতির কারণেই’ বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সাদা হাতিতে পরিণত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশে আগেও ছিলে। কিন্তু গত এক যুগে বিদ্যুৎকেন্দ্র যেন লুটপাটের মাধ্যমে বিলিয়নিয়ার বানানোর শিল্পে পরিণত হয়েছে।”
“বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এক দিকে চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুত উতপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ আমদানিও করা হচ্ছে। তাই শেয়ারবাজার পতনের মত বিদ্যুৎ খাতে সংকট অনিবার্য ছিল; প্রহর গুনছিলো কখন বিস্ফোরণ হবে, এখন সেই বিস্ফোরণ শুরু হল।”
জাতীয় গ্রিডে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে ফখরুল বলেন, “প্রায় দুই সাপ্তাহ পার হলেও এখনও বিদ্যুত বিপর্যয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি। এই অদক্ষ সরকারের পরিকল্পনাহীনতা, অপরিণামদর্শিতা ও জবাবদিহিতাহীনতার কারণেই তারা এমন উদাসীনতা দেখাতে পারছে।
“পিজিসিবির কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই তো মুখ্য নয়। লোক দেখানো গল্প-কথার প্রতিবেদন নয়; জাতি জানতে চায় কেন এই বিপর্য্য় ঘটল এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের বিপর্য্য় এড়াবার রোডম্যাপ কী?’’
বিদ্যুতের অভাবে শিল্প-কলকারখানার চরম দুরাবস্থা হয়েছে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, “নজিরবিহীন লোড শেডিংয়ের কারণে উচ্চমূল্যের ডিজেল জেনারেটর চালিয়ে কারখানা সচল রাখতে গড়ে প্রতিদিন ১০-১৫ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে।
“ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ায় মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। গ্যাস নির্ভর বড় শিল্প যেমন সিরামিক্স, টেক্সটাইলগুলো ধুকছে। জেনারেটর চালিয়ে স্পিনিং মিলগুলো সচল রাখা যাচ্ছে না।”
সরকার সবকিছুর জন্য রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ আর মহামারীর ওপর দায় চাপিয়ে ‘পার পেতে চাচ্ছে’ অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “অথচ করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের অনেক আগ থেকেই সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতি খাদের কিনারায় চলে এসেছিল।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসুর মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “এখন যেটা চলছে সেটা লুটপাটের অর্থনীতি। এটাকে বলে আওয়ামী অর্থনৈতিক মডেল। বাংলাদেশে এখন আপনারা এই আওয়ামী অর্থনৈতিক মডেলের রিফলেকশন দেখতে পারছেন। ভবিষ্যতে আরও দেখতে পারবেন।”
‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “আমাদের দেশে একটা কথা আছে না- উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দেওয়া আরকি! চাকরি গেলে তো পিজিসিবির এমডির যাওয়ার কথা, তারই তো সব খেয়াল করার কথা।”
“ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার-এনএলডিসি স্থাপন হয়েছে অনেকদিন আগে; যেটা ডিজিটালাইজড করার কথা, যেটা দিয়ে সারা বাংলাদেশে বিদ্যুতের অবস্থা দেখবে- কোথায় কী হচ্ছে। সেটাকে অ্যানালগ করে রাখছে তারা। সুতরাং ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার জন্য সুবিধা হচ্ছে। এই ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য ডিজিটাল করে নাই। মোট কথা হচ্ছে পুরোটা চুরি আর জনগণকে সেটা বহন করতে হবে।”
জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়সহ সার্বিক পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের পদত্যাগ করা উচিত মন্তব্য করে সাবেক প্রতিমন্ত্রী টুকু বলেন, “টেলিভিশনে দেখলাম- উনি উল্টো প্রশ্ন করছেন, ফখরুল ও টুকু কী বোঝে এই টেকনিক্যাল বিষয়ে।
“আরে আমি সাড়ে চার বছর এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলাম। তাতে বিদ্যুতের প্রত্যেকটা জিনিস বুঝি। ও তো ১৫ বছর আছেন মন্ত্রী, ওর তো বোঝা উচিত আরও বেশি।”
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুতের এই অবস্থার পরিবর্তন আসবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এটা তো চাঁদের চেরাগ না যে- আসলেই বিদ্যুৎ দেব, তবে আমরা মেজার্স (ব্যবস্থা) নেব। আমাদের যে মাস্টারপ্ল্যান ছিল, ওটাকে অনুসরণ করব- যাতে মানুষের উপরে ট্যাক্সেশন বেশি না হয়।”
আইএমএফ ঋণ প্রসঙ্গে
মির্জা ফখরুল বলেন, “জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি, বাজেট সহায়তার কথা বলে সরকার আইএমএফ ও এডিবির কাছে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। এই স্বল্প পরিমাণ ঋণ দেশের দুই মাসের খরচ যোগান দেওয়ার জন্য আসলে যথেষ্ট নয়।
“বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা বর্তমান জ্বালানি সংকটের অন্যতম কারণ। সরকার বাপেক্সকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। স্থলভাগে ও সমুদ্রে গ্যাস খোঁজার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই জাতির দুর্ভাগ্য যে ভাগ-বাটোয়ারার সুবিধার জন্য দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, “ওপেক কিংবা ওপেক প্লাস দেশগুলো থেকে তেল ও গ্যাস কেনার জন্য বড় ও স্থায়ী সরবারহ চুক্তি করেনি সরকার। অথচ কমিশন খাওয়ার জন্য তেল উৎপাদনকারী নয়- এমন বড় দেশ যেমন চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে।
“অপরদিকে মোট আমদানির ৫০% স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনছে সরকার। কাতার ও ওমানের মতো দেশের বড় গ্যাস সরবারহের চুক্তির অফার উপেক্ষা করে কমিশন খাওয়ার জন্য লোভে উচ্চদামে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস থেকে কিনছে সরকার।”