বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতা হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন সিপিবির একজন উপদেষ্টা।
Published : 13 May 2024, 11:30 AM
মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ‘কমরেড’ হায়দার আকবর খান রনোকে শেষ বিদায় জানিয়েছে তার দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি।
সোমবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে রনোর মরদেহ পুরানা পল্টনে সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ‘মুক্তিভবনে’ নেওয়া হয়। প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ ছিলেন সিপিবির উপদেষ্টা।
দলের সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান, সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নারী নেত্রী মাহফুজা খানমসহ পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তাদের দীর্ঘদিনের ‘কমরেড’কে শেষ বিদায় জানান।
শুক্রবার রাতে ঢাকার পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হায়দার আকবর খান রনো। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
শনি ও রোববার তার মরদেহ রাখা হয়েছিল হাসপাতালের হিমঘরে। সোমবার সকালে কফিন নিয়ে যাওয়া হয় মুক্তিভবনে।
অ্যাম্বুলেন্স থেকে তার মরদেহ বহন করে কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত নির্ধারিত স্থানে রাখেন পার্টির শীর্ষ নেতারা। তারপর কফিন ঢেকে দেওয়া হয় সিপিবর পতাকা দিয়ে। পুষ্পমাল্য দিয়ে চলে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব।
প্রয়াত নেতার স্মরণে দলীয় কার্যালয়ে সিপিবির পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়, তোলা হয় শোকের কালো পতাকা। নেতা-কর্মীদের বুকেও ছিলো কালো ব্যাজ।
সিপিবির সভাপতি শাহ আলম বলেন, “একে একে ষাটের দশকের প্রজন্ম চলে যাচ্ছেন। যে দশকটি ছিল বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দশক, এই প্রজন্মে্র ওপর ভর করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই দশকের প্রজন্ম চলে যাচ্ছেন, কিন্তু এদেশের স্বপ্ন পূর্ণ হচ্ছে না, এটাই হল জাতির জন্য বিপদজনক অবস্থা।
“হায়দার আকবর খান যেটা দিয়ে গেছেন, যে আদর্শ ধারণ করেছেন, সেই আদর্শ অবিনাশী। তার আদর্শের পথ, সেটাই হল মানবমুক্তির পথ; এটাই আমরা বিশ্বাস করি। এই পতাকা আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব।”
শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে নেতা-কর্মীরা কফিন নিয়ে যান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতা হায়দার আকবর খান রনোর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩১ অগাস্ট, কলকাতায়। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল এবং নটর ডেম কলেজের পাঠ শেষ করে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন।
তবে আন্দোলন আর কারাবাসের কারণে পদার্থবিদ্যার লেখাপড়া তিনি আর শেষ করতে পারেননি। পরে জেলখানায় বসে পরীক্ষা দিয়ে আইনের ডিগ্রি পান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরের বছর, ১৯৬১ সালে তদানীন্তন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন রনো। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রজীবন শেষে তিনি যোগ দেন শ্রমিক আন্দোলনে। ১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে একজন সংগঠকের ভূমিকা রাখেন।
একাত্তরের রণাঙ্গনে কমরেড রনো এবং তার সহযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে ১৪টি ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। রনো এসব ঘাঁটি অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং রাজনৈতিক নির্দেশনা দিতেন।
১৯৬৯ সাল থেকে টানা ১৫ বছর ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রনো। পরে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে ২০১০ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে সিপিবিতে যোগ দেন। ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য, পরে পার্টির উপদেষ্টা হন।
রাজনীতিকের পরিচয়ের বাইরে তিনি ছিলেন একজন তাত্ত্বিক ও লেখক। শতাব্দী পেরিয়ে, ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা, মার্কসবাদের প্রথম পাঠ, মার্কসীয় অর্থনীতি, মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম, কোয়ান্টাম জগৎ: কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্নসহ ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। ২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা
বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত হায়দার আকবর খান রনোর কফিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তার জানাজা হবে। সেখান থেকে বনানীতে মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে বলে পরিবারের সদস্যরা জানান।
হায়দার আকবর খান রনো এক মেয়ে রানা সুলতানাকে রেখে গেছেন।