“জুলাই সনদ যেটাতে সবার স্বাক্ষর হওয়ার কথা সেটা নির্বাচনের আগে কার্যকর দেখতে চাই,” বলেন তিনি।
Published : 07 Mar 2025, 10:07 PM
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির অর্থের উৎস নিয়ে ওঠা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
দলকে নেতৃত্ব দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার পদ ছেড়ে আসা নাহিদ বলেন, এনসিপির অর্থের উৎস প্রকাশ করার ইচ্ছে থাকলেও দাতাদের ‘ক্ষতির আশঙ্কায়’ তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
শুক্রবার বাংলামোটরে রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারে অস্থায়ী কার্যালয়ে এনসিপির প্রথম সাধারণ সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশ করে আনুষ্ঠানিকভাবে এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করা হয়। সে সমাবেশে সারাদেশে থেকে কর্মী সমর্থকরা আসেন।
আন্দোলনের তরুণ এই নেতারা তাদের নতুন দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের খরচের টাকা কোথা থেকে পেয়েছেন, এমন প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক পরিসরে।
সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক বিষয়টি সামনে আনলে নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা চাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের সূত্র ধরে এই সংস্কৃতিটা আসুক যে আর্থিক সহায়তা কোত্থেকে আসছে এবং কোন খাতে ব্যয় করা হচ্ছে তা যেন তুলে ধরা যায়।
“এই সংস্কৃতিটা সব রাজনৈতিক দলে আসা উচিত। এককভাবে এই সংস্কৃতি আমাদের পক্ষে মেনে চলা সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, “আমরা যদি তাদের (দাতা) নাম প্রকাশ করি তারা যে কোনোভাবে ক্ষতির শিকার হবে না সেই নিশ্চয়তা তো সরকার থেকে দিতে হবে। আমরা চাই, এই সংস্কৃতিটা চালু হোক। সবাই সেই সংস্কৃতি গ্রহণ করুক।”
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দলের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তার যে বক্তব্য কিছু কিছু গণমাধ্যম তার ভুল অনুবাদ করেছে তুলে ধরে নাহিদ সেগুলো সংশোধনের অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, “রয়টার্সের ইন্টারভিউতে কিছু মিসকোট হয়েছে। ভুল অনুবাদ হয়েছে। আমি বলেছি- আমাদের আর্থিক বিষয়ে সমাজের স্বচ্ছল মানুষ ও শুভাকাঙ্খীরা সহযোগিতা করেন।
“অনলাইন অফলাইনে ক্লাউড ফান্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছি। এই বিষয়ক কিছু ভুল বার্তা গণমাধ্যমে এসেছে। মিডিয়াগুলোর প্রতি অনুরোধ থাকবে সেগুলো সংশোধন করার জন্য।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা।
এর পরের কয়েকদিনের নানা ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। তিনদিন সরকারবিহীন থাকার পর দেশের হাল ধরে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাভাবিক দায়িত্বে ফেরানোর কাজ শুরু হয়। আন্দোলনে দমন-পীড়ন চালানোর ঘটনায় সাবেক আইজিপি ও পুলিশের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচন নিয়ে নাহিদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমে ‘এই বছর নির্বাচন করা সম্ভব নয়’ শিরোনামে যে খবর প্রকাশ হয়েছে সেটাও ভুলভাবে এসেছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, “আমি কথাটা ঠিক এইভাবে বলি নাই। বলেছিলাম, এখন দেশে আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি, পুলিশ যেরকম নাজুক অবস্থায় আছে, সেই পরিস্থিতিতে নির্বাচন করাটা অনেক বেশি কঠিন হবে। এই পুলিশ প্রশাসনের কিন্তু একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিন ধরেই নেই। তাদের সক্ষমতা পরীক্ষা হয় নাই। সেজন্য আমাদেরকে অবশ্যই নির্বাচনের আগে পুলিশিং ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সেজন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে।”
সাধারণ সভা থেকে সম্প্রতি নারী নিপীড়নের বিভিন্ন ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি নাগরিক পার্টির নারী সদস্যদের নিয়ে সাইবার জগতে চলা বুলিং নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
নাহিদ ইসলাম বলেন, “নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, ইভটিজিং হচ্ছে। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, জনপরিসরে এই ধরনের নিপীড়নের দ্রুত বিচার যেন হয়।”
দলের নারী সদস্যেদের নিয়ে সাইবার জগতে বুলিং চলছে তুলে ধরে তিনি বলেন, “বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের কর্মীরা এই কাজে বেশি যুক্ত হচ্ছে। যাতে নারীরা রাজনীতিতে ও দেশ গঠনের কাজে যুক্ত হতে না পারে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।
“সরকারের জায়গা থেকে এটার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তার বক্তব্যের সূত্রে প্রকাশ হওয়া কিছু সংবাদের সংশোধনী দিয়ে নাহিদ বলেন, “নির্বাচনের জন্য নাগরিক পার্টির মানসিকতা ও প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা জাতীয় সংসদের পাশাপাশি গণপরিষদ নির্বাচন দেখতে চাই।”
নির্বাচনই এনসিপির একমাত্র দাবি নয় তুলে ধরে তিনি বলেন, “তার আগে বিচারকাজ দৃশ্যমান দেখতে চাই। জুলাই সনদ যেটাতে সবার স্বাক্ষর হওয়ার কথা সেটা নির্বাচনের আগে কার্যকর দেখতে চাই।”
গত ডিসেম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আসা জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবির দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাওয়ার কথা তুলে ধরে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের পরে মানুষের মাঝে পরিবর্তন ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। সেই দুইটা আকাঙ্খাতো পূরণ করতে হবে। তার আগে আমরা কীভাবে নির্বাচনের দিকে যাব? আমি সেই কথাটি বলেছি যে, এসব যেন আমরা ভুলে না যাই।”
নির্বাচনি জোট সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমরা নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বিস্তারে মনোযোগী। জোট নিয়ে ভাবার সময় এখনও আসেনি।”
দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা সাধারণ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় সামনের দিনের দুটি কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- চব্বিশের জুলাই-অগাস্ট অন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে ১০ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এনসিপির ইফতার মাহফিল। সারাদেশের শহীদ পরিবার ও আহতদের এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
পরের দিন ১১ মার্চ দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ এবং ব্যবসায়ী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানে ইফতার পার্টির কর্মসূচির কথা তুলে ধরেন এনসিপির সদস্য সচিব।
তিন নেতার পদত্যাগ প্রসঙ্গ
দল গঠনের সাত দিনের মধ্যেই জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে তিন নেতা পদত্যাগ করেছেন। তারা হলেন- যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবু হানিফ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তর অঞ্চল) হানিফ খান সজিব ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুজ জাহের।
বৃহস্পতিবার এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বরাবর তিনজনই পৃথক পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন বলে দলটির কয়েকজন জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি স্বীকার করে নেন এনসিপির প্রধান সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
তিনি বলেন, “জাতীয় নাগরিক পার্টিতে গণঅধিকার থেকে তিনজন জয়েন করেছিলেন। আমরা তাদের নাম প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু তাদের কোনো এক্টিভিটিজে নিইনি।
“তাদের বলেছিলাম, আপনারা যখন আগের পার্টিতে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন, তখনই কাজ শুরু করতে পারবেন। এরমধ্যেই তারা নিজেদের পলিটিক্যাল পার্টিতে ব্যাক করেন।”
সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্ত শারমিন, আরিফুল ইসলাম আদীব, মুখ্য সংগঠন সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন।