“আর এখন তারা বলছে আমরা আওয়ামী লীগের দোসর। এটা খুবই দুঃখজনক”, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন।
Published : 21 Oct 2024, 09:23 PM
সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আসা ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ বক্তব্য মানতে পারছেন না জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
সোমবার জাতীয় পার্টির বনানীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি দাবি করেছেন, এই আন্দোলনে তার দলের নেতাকর্মীদেরও অংশগ্রহণ ছিল। তাদের কর্মীরাও মারা গেছেন।
আওয়ামী লীগের পতনের পর ভেঙে দেওয়া সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনরত ছাত্রদের আমরা ‘বীর মুক্তিসেনা’ উপাধি দিয়েছি। আন্দোলনের সময় আমি বলেছি, ‘শিক্ষার্থীরা আমার সন্তানের মত’, আর এখন তারা বলছে আমরা আওয়ামী লীগের দোসর’। এটা খুবই দুঃখজনক।”
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও পরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় পার্টিও ছিল।
এই দলটি ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে যোগ দেয়। ২০১৪ থেকে তিনটি নির্বাচনে জোট অথবা সমঝোতা করেই অংশ নেয়, টানা তিনটি সংসদে তারা ছিল বিরোধী দল।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম দফার সংলাপেও জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর বিরোধিতা করতে থাকলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে রংপুরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে জাতীয় পার্টি এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনসমর্থন ধরে রাখতে পেরেছে।
এই অবাঞ্ছিত ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় আবার ছাত্র আন্দোলন থেকে পাল্টা বক্তব্য এসেছে।
আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের দাবি
জাতীয় পার্টি সরকার পতন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে, এমন দাবিও করেন জি এম কাদের বলেন, “এমন এক মুহূর্তে আমাদের এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন একটি চক্র জাতীয় পার্টিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত করতে অপচেষ্টা করছে। অথচ, জাতীয় পার্টি শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিল।”
আন্দোলনে অংশ নিয়ে রংপুরে মহানগর জাতীয় পার্টির নেতা মেরাজুল ইসলাম এবং মানিক মিয়া নিহত হয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, “আমার নির্দেশে জাতীয় ছাত্রসমাজ রাজধানীতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে আন্দোলনে। রংপুরে জাতীয় পার্টি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ ১১টি মিথ্যা মামলায় পার্টির ৩৩ জন নেতা-কর্মী আসামি হয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে এ সংক্রান্ত একটি তালিকাও দেয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন।”
সংলাপে না ডাকা 'অদ্ভুত' ঠেকছে জি এম কাদেরের
দুই সমন্বয়কের ক্ষোভ, প্রধান উপদেষ্টার সংলাপে ডাক পাবে জাপা?
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া ও আন্দোলনের সময় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পড়ে শোনান জিএম কাদের। বলেন, “এই সংবাদগুলো তো আমি করি নাই। এগুলো আপনারা করেছেন। আন্দোলনের সময়কার এই সংবাদগুলোই আমার রক্ষাকবচ।”
ছাত্র-জনতার উপরে গুলি ও হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ ঘটনায় তদন্ত করে দোষীদের বিচারের দাবি জানিয়েছিলাম। সংসদে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে বক্তৃতা করেছি। দাবি মেনে নিতে বিবৃতি দিয়েছি। আন্দোলনে আটক ৬ সমন্বয়ককে মুক্তি দিতেও দাবি জানিয়েছিলাম আমরা।
“আন্দোলনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা অত্যন্ত পরিষ্কার। ২০১৮ সালে যখন ছাত্ররা কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিল, তখনও পার্টির প্রতিষ্ঠাতা পল্লীবন্ধু এরশাদ সমর্থন দিয়েছিলেন।”
“শেখ হাসিনার দায় নেতাকর্মীদের উপর পড়ে না”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত কি না- এই প্রশ্নে জিএম কাদের বলেন, “আমি আসলে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই। যদি দেশবিরোধী বা সন্ত্রাসী সংগঠন না হয়, তাহলে নিষিদ্ধ করা উচিত না।
“দেশে সবাই রাজনীতি করুক। নির্বাচনে কোনো দলকে জনগণ যদি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে প্রত্যাখ্যান করুক। আর আমি মনে করি- শেখ হাসিনা যেটা করেছে, এটার দায়ভার সব নেতাকর্মীদের উপর পড়ে না।”
প্রয়োজন পড়েনি, তাই ডাকেনি: সংলাপ নিয়ে জাপা মহাসচিব
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড সহ্য করতে পারেননি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেকেই এই আন্দোলনের সফলতা কামনা করেছে।”
জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, “আমরা আগে একটা দলকে বাদ দিয়ে ইলেকশন করলাম এখন আবার বাদ দিয়ে…তাহলে তো এই সমস্যাটার কোনো সমাধান হবে না। কেউ যদি অপরাধ করে থাকে, তার বিচার করেন, বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেন। বিচারের মাধ্যমে অবিচার কইরেন না।”
গত তিন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কীভাবে?
জাতীয় পার্টি কোন পরিস্থিতিতে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, সেই ব্যাখ্যাও দেন জিএম কাদের।
তিনি বলেন, “২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাতীয় পার্টি ও বিএনপি। কিন্তু পরে চাপে পড়ে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন করতে হয়।
“তখন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ঠিকই অংশ নেয় বিএনপি। তারপর ২০১৮ এর নির্বাচনে প্রায় সব দল এসে নির্বাচনের বৈধতা দিল। বিএনপিসহ অন্যান্য দল চার বছর পার্লামেন্টে ছিল। বিএনপি ইলেকশন করে অর্ধেক বৈধতা দিয়েছে, আর আমরা অর্ধেক দিয়েছি। শুধু আমরা একা না, বিএনপিসহ সব দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনের বৈধতা দিয়েছে।”
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বর্জন করা হলে জাতীয় পার্টির আরেকটা পক্ষ (রওশন এরশাদ) দিয়ে ভোট করা হবে বলে চাপ দেওয়া হয়েছিল বলেও জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “তখন আমরা ‘নির্বাচন ফেয়ার করার গ্যারান্টি দিতে হবে, না হয় থাকব না’ বলে জানাই।
“আমরা কোনো ছাড় চাইনি, আমরা চেয়েছি নির্বাচন যেন নিউট্রাল হয়। শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে আসার চেষ্টা করলে গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে জোর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো হয়েছে।”
শেষে জিএম কাদের বলেন, “শেখ হাসিনা দুটা বিষয়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। একটা হচ্ছে মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করা, আরেকটা হচ্ছে মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করা।
“এই হতাশা এবং ভীতি ছিল সেই সময়ের পরিস্থিতি। এর ভেতরেই রাজনীতি করতে হয়েছে আমাদেরকে। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে যেতে হয়েছে। সুতরাং এগুলো বিবেচনা করার প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।”