“দশ বছর এই মিথ্যা মামলার ঘানি টানতে হয়েছে। হেনস্তা হতে হয়েছে। অভিযোগটি যে মিথ্যা ছিল, তা আজ প্রমাণিত হল।”
Published : 22 Aug 2024, 01:17 PM
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অর্থপাচারের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় খালাস পেয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
ঢাকার প্রথম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবুল কাশেম বৃহস্পতিবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দশ বছর এই মিথ্যা মামলার ঘানি টানতে হয়েছে। হেনস্তা হতে হয়েছে। অভিযোগটি যে মিথ্যা ছিল, তা আজ প্রমাণিত হল।”
খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবীর মো. বোরহান উদ্দিন ও মোহাম্মদ তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ। দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আইনজীবী আহমেদ আলী সালাম।
দুদকের পরিচালক নাসিম আনোয়ার ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রমনা মডেল থানায় মোশাররফের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করেন। ওই বছর ১৪ অগাস্ট নাসিম আনোয়ার আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলায় মোশাররফের বিচার শুরু করে আদালত। মামলার বাদী, তদন্তকারী কর্মকর্তা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও আয়কর কর্মকর্তাসহ মোট ৯ জনের সাক্ষ্য শুনে বিচারক বৃহস্পতিবার রায় দিলেন।
অভিযোগে বলা হয়, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালে খন্দকার মোশাররফ হোসেন ‘ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা’ পাচার করেছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, খন্দকার মোশাররফ ও তার স্ত্রী বিলকিস আক্তার হোসেনের যৌথ নামে যুক্তরাজ্যের লয়েড টিএসবি অফশোর প্রাইভেট ব্যাংকে ৮ লাখ ৪ হাজার ১৪২ দশমিক ৪৩ ব্রিটিশ পাউন্ড জমা করেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮১ টাকা।
আদালতের পর্যবেক্ষণ
বৃহস্পতিবার মোশাররফকে খালাসের রায় দিয়ে বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক নাসিম আনোয়ারের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামির ব্যাংক হিসাবের পূর্ণাঙ্গ তথ্য না জেনেই তিনি এজাহার দায়ের করেন। ফলে এজাহার দায়ের ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ছিল।
মামলায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২০০২ এর ১৩ এবং ২০০৯ এর ৪ ধারা ও ২০১২ এর ৪ ধারায় অভিযোগ আনা হলেও অনুসন্ধানকালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আসামি কত টাকা কার কাছে ঘুষ চেয়েছিলেন, সেই প্রশ্নে সাক্ষী বলেন, আসামির বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তিনি পাননি।
“ফলে অতি উৎসাহী হয়ে মামলা দায়ের করা একটি দুরভিসন্ধি মর্মে অত্র আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়,” বলেন বিচারক।
মামলার তৃতীয় সাক্ষী বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের উপ-পরিচালক সালমা আক্তার সাক্ষ্যে বলেন, বাংলাদেশি কোনো নাগরিক বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করাকালে বিদেশে ব্যাংকে হিসাব খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।
অন্যদিকে খন্দকার মোশারফ হোসেন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, ১৯৬৯ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যে উচ্চ শিক্ষায় যান। এর সমর্থনে দালিলিক প্রমাণও দাখিল করেন।
রায়ে বলা হয়, সাধারণত এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থীর নামে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেওয়ার আবশ্যকতা থাকে না।
মামলার তৃতীয় সাক্ষী ঢাকা অঞ্চল-৪ এর যুগ্ম কর কমিশনার হাসিনা আক্তারের সাক্ষ্যে দেখা যায়, খন্দকার মোশাররফ হোসেন যথা নিয়মে ২০১৩-২০১৪ কর বর্ষের কর পরিশোধ করেছেন। কর সংক্রান্ত বিষয় নিষ্পত্তি হয়েছে। তাকে প্রত্যয়নপত্রও দেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম সাক্ষী ঢাকার কর অঞ্চল-৫ প্রধান সহকারী মো. লুৎফর রহমানের সাক্ষ্যে দেখা যায়, খন্দকার মোশারফ হোসেন ২০১৩-২০১৪ করবর্ষে তার বিদেশে থাকা আয় যথানিয়মে প্রদর্শন করেন এবং আয়কর দেন।
সপ্তম সাক্ষী ঢাকা কর অঞ্চল-৫, সার্কেল-৯০ (কোম্পানিজ) এর উপ-কর কমিশনার মাসুমা খানমের সাক্ষ্যে দেখা যায়, খন্দকার মোশারফ হোসেন তার বিদেশে থাকা আয় প্রদর্শন করে জরিমানা, সারচার্জ সহ আয়কর পে অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করার পর সেই পে অর্ডার আয়কর অফিস নগদায়ন করে। তাকে কর দেওয়ার প্রত্যয়নপত্রও দেওয়া হয়।
নবম সাক্ষী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নাসিম আনোয়ার জেরায় বলেন, তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের আইন অধিদপ্তরের কোনো ব্যক্তিকে সাক্ষী করেননি। তিনি এজাহারে বর্ণিত ঘটনা যাচাই বাছাই করার জন্য বিদেশে যাননি। তিনি হিসাব খোলার ফরম, নমুনা স্বাক্ষর কার্ড ও টাকা জমার রশিদ সংগ্রহ করেননি এবং আদালতে জমা দেননি।
বিচারক বলেন, “সত্য যে, এজাহারে, শুধুমাত্র ব্যাংক হিসাব নম্বর বললেও হিসাবটি পোর্টফোলিও হিসাব। (তদন্ত কর্মকর্তা) এই আসামির নামীয় ব্যবহৃত কূটনৈতিক পাসপোর্ট জব্দ করেননি এবং চার্জশিটে পাসপোর্ট আলামত হিসাবে দেখাননি। তিনি এই আসামির স্বাক্ষরিত টাকা জমার রশিদসমূহ জব্দ করেন নাই। পোর্টফলিও হিসাব নম্বরে টাকা জমা দেয়ার ও উত্তোলনের কোনো বিবরণী তিনি জব্দ করেননি।
“এমতাবস্থায় দেখা যায় যে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে আসামী ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন টাকা পাচার করেছেন দাবি করা হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা উক্ত মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন নাই। অথচ উক্ত মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য পাওয়া যেত। তদন্তকারী কর্মকর্তা লয়েডস টিএসবি অফশোর প্রাইভেট ব্যাংক এর কোনো কর্মকর্তা বা কোনো কর্মচারীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন নাই। এই ব্যাংকের ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করেন নাই। এমতাবস্থায় দেখা যায় যে, তদন্তকারী কর্মকর্তার তদন্ত ত্রুটিপূর্ণ ছিল।”
রায়ে বলা হয়, খন্দকার মোশারফ হোসেন ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকা অবস্থায় কলম্বো প্লান স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে লন্ডনে যান এবং তার স্ত্রী ১৯৭০ সালে লন্ডনে তার সাথে যুক্ত হন। লন্ডনে থাকাকালে তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনে ইনার লন্ডন এডুকেশন অথরিটিতে শিক্ষকতা করেন এবং তার স্ত্রী ১৯৭০ সালে থেকে লন্ডনে তার সাথে অবস্থানকালে চাকরি করে প্রতি মাসে গড়ে তিন হাজার পাউন্ড অর্থাৎ বছরে ৩৬ হাজার পাউন্ড অর্জন করে। তারা যৌথভাবে উপার্জিত অর্থ লন্ডনে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেন। পুনঃপৌণিক বিনিয়েগের মাধ্যমে ওই অ্যাকাউন্টে স্থিতি দাঁড়ায় ৮ লাখ ৪ হাজার ১৪২ পাউন্ড। তা কোনো অবস্থাতেই অবৈধ উপার্জন নয় বা মানিলন্ডারিং এর মাধ্যমেও সঞ্চিত নয়।
“উপরোক্ত বৈধ ও সঞ্চিত পাউন্ড বাংলাদেশে আনার লক্ষ্যে তিনি ও তার স্ত্রী ২০১৩-২০১৪ করবর্ষে বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ডে নির্দিষ্ট ফরমে ঘোষণা করেছেন এবং ট্যাক্স কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালের ২ মে তারিখে রাজস্ব বোর্ড পেনাল্টিসহ তাদের উভয়ের ট্যাক্স গ্রহণ করে এবং তাদেরকে ট্যাক্স সার্টিফিকেট প্রদান করে। এমতাবস্থায়, লন্ডনে রক্ষিত তাদের বৈধ পাউন্ড বাংলাদেশ রাজস্ব বোর্ডের সার্টিফিকেট অনুযায়ী বাংলাদেশেও বৈধ।”
বিচারক বলেন, “আসামি ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন তার উক্ত বক্তব্যের সমর্থনে দালিলিক প্রমাণ দাখিল করেন যা দৃষ্টে তার উক্ত আয় বৈধ মর্মে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়।
“তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষে ৯ নম্বর সাক্ষী কাগজ প্রদর্শনী হিসাবে যা জমা দিয়েছেন, তা সিল স্বাক্ষরহীন ফটোকপি। আসামির বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ থাকলে দুদক লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে যথানিয়মে কাগজপত্র বাংলাদেশে আনাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে কতগুলো ফটোকপি দাখিল করে মামলা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। যা দুদকের দুর্বলতা প্রকাশ করে। দুদকের মত একটি প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে আরো সতর্ক থাকা উচিত ছিল।”
আদালত থেকে বের হয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমাকে নানানভাবে চেষ্টা করা হয়েছে শাস্তি দেয়ার জন্য। বিচারক অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সঠিক তথ্যসমূহ তুলে ধরে রায় দিয়েছেন। আমি আশা করছি এভাবে বিচারকগণ সাহসিকতার সঙ্গে সঠিক রায় দিলে খুব শীঘ্রই দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।”
তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এ ধরনের মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা যেন করা না হয়। প্রতিটি মামলা যেন সত্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে দায়ের করা হয়। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে কেউ যদি শাস্তি পেয়ে থাকে, তার বিষয়ে যেন উদ্যোগ নেওয়া হয়।”