শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পোস্তাগোলা মহাশশ্মানে শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়েছে।
Published : 25 Apr 2023, 06:10 PM
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় সম্মান আর ফুলেল শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানান হল প্রবীণ রাজনীতিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে।
সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ মঙ্গলবার বিকালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। তার দল ঐক্য ন্যাপের পক্ষ থেকে জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয় কফিন।
এরপর ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেদায়েতুল ইসলাম সায়েদের নেতৃত্বে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠককে।
তার আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের শ্রদ্ধার ফুলে ভরে ওঠে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের কফিন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা দেশাত্মবোধক গান ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ গাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব।
সন্ধ্যায় শহীদ মিনার থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় পোস্তগোলা মহাশশ্মান ঘাটে। সেখানেই সম্পন্ন হয় এই রাজনীতিকের শেষকৃত্য।
ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার রাতে ৮৪ বছর বয়সে মারা যান পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
আজীবন বাম ধারার রাজনীতিতে থাকলেও অন্য সব রাজনীতিকদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। তাই তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে দলমত নির্বিশেষ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মিলিত হন শহীদ মিনারে। স্মৃতিকাতর হয়ে কেউ কেউ চোখের জলও ফেলেছেন।
বিকালে শহীদ মিনারে কফিন নেওয়ার পর ৪টা বাজতেই ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে শ্রদ্ধা নিবেদন মঞ্চে নিয়ে আসা হয় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের মরদেহ।
‘সমুখে শান্তি পারাবার/ভাসাও তরণী হে কর্ণধার/তুমি হবে চিরসাথী/লও লও হে ক্রোড় পাতি/অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি ধ্রুবতারকার’ গানের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হয়।
প্রথমেই ঐক্য ন্যাপের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, উপপ্রচার সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম, উপদপ্তর সম্পাদক সায়েম খান শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এরপর কৃষক লীগের পক্ষ সংগঠনটির সভাপতি সমীর চন্দের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
আবদুল্লাহ আল নোমান ও খায়রুল কবির খোকনের নেতৃত্বে বিএনপি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বর্তমান সভাপতি শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষে সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশ জাসদের পক্ষে শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষে সাইফুল হক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষে বজলুর রশীদ ফিরোজ, জেএসডির পক্ষ থেকে কে এম জাবির, গণফোরামের (একাংশ) পক্ষে কামাল হোসেন, গণফোরামের (মন্টু) পক্ষে মোস্তফা মহসীন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরী, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের অসীত বরণ রায়, বাসদের পক্ষে খালেকুজ্জামান ভূইয়া ও রাজেকুজ্জামান রতন এবং গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষে জোনায়েদ সাকি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষেও শ্রদ্ধা জানানো হয় পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, মাহফুজা খানমের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় খেলাঘর, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষে অধ্যাপক বদিউর রহমান ও অমিত রঞ্জন দে, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষে গোলাম কুদ্দুছ, জাতীয় কবিতা পরিষদের পক্ষে কবি মুহম্মদ সামাদ, তারিক সুজাত ও কবি আমিনুর রহমান সুলতান এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের শেষকৃত্য মঙ্গলবার
চলে গেলেন প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য
এছাড়াও গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবে নাট্য অভিনেতা-নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মফিদুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবির, রানা দাস গুপ্ত, সাবেক সচিব ও কবি কামাল চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে হাছান মাহমুদ বলেন, “পঙ্কজ ভট্টাচার্য রাজনীতিতে লোভ-লালসার উর্ধ্বে একজন মানুষ ছিলেন। যিনি রাজনীতি করে গেছেন, কোনো পদ-পদবির পিছনে যিনি ছোটেননি।
“একজন রাজনীতিবিদ কেমন হওয়ার প্রয়োজন, আর উদাহরণ হচ্ছে পঙ্কজ ভট্টাচার্য। তিনি রাজনীতিকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। তিনি যদি লোভ-লালসার পিছনে ঘুরতেন তাহলে রাষ্ট্রীয় জীবনে তিনি অনেক পদ পদবী নিতে পারতেন। সারা জীবন গণমানুষের রাজনীতি করেছেন, তিনি সারা জীবন মেহনতী মানুষের, দরিদ্র মানুষের কথা বলেছেন। পঙ্কজ ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক জীবন থেকে আজকের প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। আমি তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।”
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৩৯ সালের অগাস্টে চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে। ছাত্রজীবনেই তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে।
১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি ও পরে কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।
ষাট দশকের ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীর সংগঠক।
১৯৬৭ সালে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছাকাছি সেলেই রাখা হয়। তখন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহচর্য পান এবং তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠে।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
বাংলাদেশের সব আন্দোলন-রাজনৈতিক পালাবদলের প্রত্যক্ষদর্শী এই রাজনীতিবিদ ১৯৯৩ সালে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।
পরে তিনি গণফোরাম ছেড়ে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। ২০১০ সালে রাজনৈতিক দল ঐক্য ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের বাইরে একসময় তিনি ফুটবলার ছিলেন। রাজনৈতিক কলাম লিখতেন তিনি। এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় পঙ্কজ ভট্টচার্যের আত্মজীবনীমূলক বই ‘আমার সেই সব দিন’ প্রকাশিত হয়।