“কোনো উগ্র গোষ্ঠী যদি তার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চালাতে চায়; তাহলে সমাজ অগ্রগতি লাভ করবে না, সমাজ এগিয়ে যাবে না,” বলেন রিজভী।
Published : 08 Mar 2025, 02:59 PM
দেশে ‘মব জাস্টিসের’ নামে যে অরাজকতা চলছে, তা ঠেকাতে অন্তর্বর্তী সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেখতে পাচ্ছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান।
তার ভাষ্যে, “৫ অগাস্টের বিপ্লবে আমাদের যে তরুণ সমাজ তাদের বুকের রক্ত দিয়ে ছাত্র-জনতা- এই যে স্বাধীনতা এসেছে, যেখানে ফ্যাসিস্ট সরকার পদত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে; সেইখানে কেন এখনও নারী ধর্ষণ হচ্ছে, বাসে হচ্ছে; পথেঘাটে নারীকে হেনস্তা করা হচ্ছে। মাগুরার কাহিনী দেখেন, একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে।
“এখানে মনে হয় কোনো একটা গোষ্ঠী যেটা বলছে- মব জাস্টিস… হোয়াট ইজ মব জাস্টিস, কীসের মব জাস্টিস? আপনার মিডিয়াতে জানিয়ে…কারা এটা করছে। সরকার কেন চুপচাপ? সরকার কেন কথা বলছে না?”
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে শনিবার সকালে নয়া পল্টনে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের শোভাযাত্রা পূর্ব সমাবেশে তিনি এ প্রশ্ন তোলেন।
সেলিমা রহমান বলেন, “যে সরকার- আমরা জানি ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্ববিখ্যাত নন্দিত নেতা। আমরা তার কাছে আশা করেছিলাম, এই সময়ে কঠোর হস্তে যারা বিভিন্ন অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে, দেশকে আজকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে- তাদের ওপর কঠিন হবেন এবং তাদের শাস্তি দেবেন।
“সরকারকে বলতে চাই, সমাজে যে অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা, সমাজে যে মব জাস্টিস, সমাজে যে নারী ধর্ষণ… এটা যদি বন্ধ করতে না পারেন, তাহলে বাংলাদেশের জনগণ যে স্বপ্ন নিয়ে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছিল, সেই স্বপ্ন আমাদের পূরণ হবে না।”
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিন মহিলা দলের শোভাযাত্রা-সমাবেশ ঘিরে পুলিশের যে ভূমিকা ছিল, সেই প্রসঙ্গে সেলিমা বলেন, “নারীরা আজকে মুক্ত…অন্তত পুলিশ দিয়ে আমরা এখন ঘেরা নই। যেখানে আমার বোনেরা মিছিল করতে পারতো না, কোনো কিছুই করতে পারতো না। সেই অবস্থা থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতাদের উদ্দেশে সেলিমা বলেন, “তোমরা এখন দল করেছে, আমরা স্বাগত জানাই। আজকাল ছাত্রজনতা বলে, বৈষম্যবিরোধী বলে যে কেউ দুইজন-তিনজন করে বিভিন্ন জেলায় তারা বিভিন্ন অফিস-আদালতে গিয়ে বসে থাকছে, তারা ভাগ চাইছে।
“এখন তোমাদের উচিত- তোমরা তাদের সাথে কথা বলে তাদেরকে শিক্ষাঙ্গনে ফিরিয়ে নিয়ে আসো।”
‘নারীদের সচেতন হতে হবে’
সেলিমা রহমান বলেন, ‘‘ আজকে নারীদের ভয়েস, ওম্যান ভয়েস একযোগে উচ্চারিত হতে হবে। নারীদের বলব, পরিবারের সদস্যদের বলব, বিশেষ করে গণমাধ্যমের ভাইয়েরা এখানে আছেন- তাদেরসহ সকলকে আজকে সজাগ হতে হবে। পরিবারের যে মূল্যবোধ ছিল- বড়কে সম্মান করা, শিক্ষককে শ্রদ্ধা করা, মা-বাবাকে সম্মান করা- এগুলোর এখন কোনোটাই বিরাজ নেই। সম্মান-শ্রদ্ধার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
“আমি বলতে চাই বোনদের, আপনাদের সচেতন হতে হবে। আপনার অধিকার কোনটা, আপনার কোনটা সমতা- সেটা আপনাকে বুঝতে হবে এবং আপনাদেরকে নিজ পরিবারে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমাদের পরিবর্তন আসবে সমাজে।”
‘নিপীড়নের ঘটনা সামনে আসে অল্প’
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “জুলাই-অগাস্টের বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার…এখন কেন সমাজের মধ্যে অস্থিরতা থাকবে। এখন একটি কথা বেরিয়েছে আপনারা জানেন, মব কালচার।
“এই মব কালচার তৈরি হলো কেন? আজকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তো সকল গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলের সমর্থিত সরকার।”
তিনি বলেন, “এই মব কালচারে সমাজে কত যে নিপীড়ন-নির্যাতন হচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নাই। কত নারী ও কন্যা শিশু নিপীড়িত হচ্ছে- এর পরিসংখ্যান যা আসে, তা অল্প। মহিলা পরিষদ তার মাসিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, জানুয়ারি মাসেই কন্যা নির্যাতিত হয়েছেন প্রায় ৮৫ জন, নারী নির্যাতিত হয়েছেন ১২০ জন।
“এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৭ জন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৪ জন…এতো ভয়ংকর পরিস্থিতি। মহিলা পরিষদ তার মাসিক প্রতিবেদনে দিয়েছে; কিন্তু এটাই শেষ নন, সংখ্যা হয়ত আরও বাড়বে। কেন এই পরিস্থিতি চলছে?”
রিজভী বলেন, “একটি জনগণের সমর্থিত সরকারের সমাজের মধ্যে শান্তি-স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা প্রধান দায়িত্ব; আর সেখানে যদি নারী ও কন্যারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আমার-আপনার কন্যা সন্তান স্কুলে গিয়ে সে নিপীড়িত হয়ে ফিরে আসে- এই লজ্জা এই জাতির, এই লজ্জা এই দেশের, এই লজ্জা যারা একাত্তরে শহীদ হয়েছেন, যারা জুলাই বিপ্লবে শহীদ হয়েছেন, যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদ হয়েছেন- সেই শহীদদেরকে অপমান করা।
“কেন দুষ্কৃতকারীরা আধিপত্য বজায় রাখবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাহলে সরকার কীসের জন্য?”
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্টাফ কীভাবে সাহস পায়?’
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘‘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্টাফ রিকশা থামিয়ে এক মেয়েকে বলছে যে- তোমার এই পোশাক পরা ঠিক হয়নি। তাহলে বলুন, তার মুরুব্বি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সেটা যদি অশ্লীলও হয়- বলতে পারতো।
“আমরা শুনছি এখন- ওড়নাকাণ্ড, পোশাককাণ্ড। একটা তো মব কালচার, আরেকটা কোথায় যেন উগ্রবাদী গোষ্ঠী কাজ করছে।”
তিনি বলেন, “পুরুষ এবং মেয়ে আমরা হলাম মানব সম্প্রদায়। যিনি প্রথম ইসলামে দীক্ষিত হয়েছেন তিনি তো একজন মহিলা- বিবি খাদিজা (রা.)। তাহলে নিজেকে কেমন করে চলতে হবে, সন্তানকে কীভাবে মানুষ করতে হবে- এই ইন্সটিটিউশন তো হচ্ছে মা।
“আর মা তো একজন নারী… বাবা সত্য কথা বলিস, মিথ্যা কথা বলিস না, শিক্ষকদেরকে সম্মান করিস, মুরব্বিদেরকে সম্মান করিস- এটা কে শেখায় সন্তানকে? সেটা হলো মা।”
রিজভী বলেন, “তাহলে নারীদের কীভাবে চলতে হবে, সেটা পুরুষরা যদি প্রতিদিন বাতিয়ে দেয়- তাহলে তো আমি মা-বোন-স্ত্রী তার স্বাধীনতায়, আমি তো তার চলাফেরায়, আমি তো তার চিন্তায়, তার লেখাপড়ায়, তার মূল্যবোধে হস্তক্ষেপ করছি।
“সে (মা-বোন-স্ত্রী) কীভাবে চলবে, তাকে সেই স্বাধীনতা দিতে হবে। এই স্বাধীনতায় কোনো গোষ্ঠী ও কোনো দলের কারো হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নাই। কারণ ধর্মীয় মূল্যবোধ বলুন, সমাজ নৈতিকতা বলুন- এটা সবচেয়ে বেশি প্রথিত থাকে, ধারণ করে নারীরা।”
‘নারীদের আটকে রাখলে সমাজ এগোবে না’
রিজভী বলেন, “মায়ের কাছ থেকে আমরা প্রথম নৈতিকতার বাণী শুনি। সুতরাং সেই নারীকে যদি আমরা খোয়াড়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখি, সেই বন্দিশালায় রাখি আজকের উন্নতির যুগে, আজকের অগ্রগতির যুগে- যখন মানব আত্মার বিকাশের পথ, সেখানে এই বন্দি করে রাখার কোনো মানে হয় না।
“কোনো উগ্র গোষ্ঠী যদি তার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চালাতে চায়; তাহলে সমাজ অগ্রগতি লাভ করবে না, সমাজ এগিয়ে যাবে না। কী খেলাধুলা, কী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, কী লেখাপড়ায়- প্রত্যেকটি জায়গায় মেধায় মননে পুরুষের চাইতে মেয়েরা কম নয়। তাদেরকে যদি আমরা আটকে রাখি, বন্দি রাখি- তাহলে সমাজ কোনোদিন এগোবে না।”
জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাসের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদের সঞ্চালনায় এই সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। সমাবেশের পর একটি শোভাযাত্রা লী কাকরাইলের নাইটেঙ্গল রেস্তোরাঁর মোড় হয়ে আবার নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়।