“আমাদের কাছে অপরাধের বিপুল পরিমাণ প্রমাণ আছে। যার মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টও অন্তর্ভুক্ত।”
Published : 14 Feb 2025, 09:40 PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা এবং তার ‘দোসরদের’ বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, “যদি তাদের অপরাধের বিচার না করা হয়, তাহলে দেশের মানুষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমা করবে না।”
বাসস জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ন্যাশনালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন সরকারপ্রধান। দুবাইয়ের ওয়ার্ল্ড গভার্নমেন্টস সামিটের (ডব্লিউজিএস) ফাঁকে তিনি এই সাক্ষাৎকার দেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে এবং আইনের মুখোমুখি করা হবে।”
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
এরপর গতবছর ৮ অগাস্ট নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় ন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্রধান উপদেষ্টা দ্য ন্যাশনালকে বলেন, “আমরা ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছি, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করতে হবে।
“আমাদের কাছে অপরাধের বিপুল পরিমাণ প্রমাণ আছে। যার মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টও অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ এটিকে নথিভুক্ত করেছে এবং আমাদের কাছে শেখ হাসিনা, তার সরকার এবং ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের অপরাধের প্রচুর প্রমাণ রয়েছে।”
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতন আন্দোলন ঘিরে ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে তথ্যানুসন্ধান কমিটির এই প্রতিবেদন বুধবার প্রকাশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশন।
প্রতিবেদনে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় বলেছে, “বাংলাদেশের সাবেক সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস উপাদানগুলোর পাশাপাশি, গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের সাথে জড়িত ছিল।”
ওই প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় সিদ্ধান্ত পৌঁছেছে, জুলাই-অগাস্টে বড় আকারের অভিযানগুলোতে প্রাণহানির ঘটনাগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের ‘নির্দেশনা ও তদারকিতে’ সংঘটিত হয়েছে।
জুলাই ঘটনাবলির পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘ বলেছে, নিরস্ত্র মানুষের ওপর পরিচালিত ওই হত্যাযজ্ঞ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। বহু ঘটনা আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারের আওতায় আসার উপযোগী বলেও মত দিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্ক।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্টের মধ্যে যে এক হাজার ৪০০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে শতাধিক ছিল শিশু। নিহতদের মধ্যে ৭৮ শতাংশই আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে নিহত হওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। নিহতদের মধ্যে ৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে এমন গুলির ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা যুদ্ধে ব্যবহার হওয়ার কথা।
ইউনূস বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি এবং আশা করছি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে (শেখ হাসিনাকে) বিচারের মুখোমুখি করা হবে।”
প্রবাসী বাংলাদেশিদের মুক্তি ও আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক
বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
আন্দোলনের সময় আমিরাতে ৫৩ জন বাংলাদেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অধ্যাপক ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোন করে আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদের কাছে অনুরোধ জানালে পরে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।
‘দ্য ন্যাশনাল’ পত্রিকাকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমিরাতের সাথে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। যখন আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হলাম, তখন আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করি। আমি তাকে ব্যাখ্যা করি যে, তারা (আটক প্রবাসী) শুধু বাংলাদেশে চলমান আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছিল।’
ইউনূস বলেন, “আমি প্রেসিডেন্টের কাছে অনুরোধ করেছি যে, তিনি যেন তাদের ক্ষমা করে মুক্তি দেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমা করায় আমি অত্যন্ত খুশি হই। এটি একটি অসাধারণ পদক্ষেপ ছিল এবং পুরো বাংলাদেশ সেটি উদযাপন করেছে।”
তিনি বলেন, “আমরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই, কারণ সেখানে ১২ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
সংস্কার
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল, নিরাপদ এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে তার পূর্ণ দৃষ্টি এখন সংস্কার কার্যক্রমের ওপর নিবদ্ধ।
সেই লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ ও প্রশাসনিক খাতে সংস্কারের জন্য আলাদা আলাদা কমিশন গঠনের কথা তিনি সাক্ষাৎকারে বলেন।
সেই সঙ্গে বিগত সরকারের আমলে চুরি ও পাচার হওয়া টাকা পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
ইউনূস বলেন, এই সংস্কারগুলোর লক্ষ্য হল জনকল্যাণ ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে একটি ‘নিরাপদ’ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে বাংলাদেশের ১৭ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ‘প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাবান’ হয়।
প্রধান উপদেষ্টা সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা দ্রুত পুনরুদ্ধার এবং অর্থনীতিকে সচল করা। আমরা রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সাথে আলোচনা করছি— কোন সংস্কার এখন বাস্তবায়ন করা হবে, কোনটি ভবিষ্যতে হবে এবং কোন সংস্কার প্রস্তাব তারা গ্রহণ করতে চান না
“এটাই আমাদের সরকারের কাজের সীমা। এরপর আমরা ১৬ বছর পর প্রথমবারের মতো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন করব। জনগণ এটিকে উদযাপন করবে এবং আমাদের কাজ শেষ হবে।”