উন্নয়নের সব ‘বলদ’ সবসময় গোয়ালে থাকে না

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 6 Jan 2022, 03:08 PM
Updated : 6 Jan 2022, 03:08 PM

রাশিয়ার ভোদকার মতো রাশিয়ান কৌতুকও খুব জনপ্রিয়। বেশিরভাগ কৌতুকেরই অবশ্য অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে জন্ম। যেমন- সরকারি লোকজন এসেছে এক প্রাইমারি স্কুল পরিদর্শনে। তাদের একজন ক্লাশ ফাইভের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলো- "আমরা এমন এক দেশে বাস করি যেখানে সবাই পেটপুরে ভাত খেতে পারে। পর্যাপ্ত মাখন আর পাউরুটি দেয়া হয়। মাংস খাবার পরে দাঁত পরিষ্কারের জন্য 'খিলানি'ও সরবরাহ করা হয়! বক্তব্য শেষে ক্লাশের সবচেয়ে দুষ্টু ছাত্রকে বলা হলো- তুমি কিছু বলো। দুষ্টু ছেলে বললো- আপনি যে রূপকথার গল্পটি বলেছেন সেরম একটা বলবো?

এবার শিক্ষক একটু রেগে সবচেয়ে ভীতু ছাত্রটিকে বললেন- এবার তুমি কিছু বলো। ভীতু ছাত্র বললো- যেখানে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যায় আমি সেইদেশে যাব!

আমরা সেইদেশে বাস করি যেখানে স্বপ্নপ্রাপ্ত মহৌষোধের কল্যাণে  ঘুমালেও নাকি মানুষ বড়লোক হতে পারে। কবিবন্ধু ইমতিয়াজ মাহমুদের একটা হিসেব তুলে ধরছি। ধরুন, হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস থেকে তিনি দুই লাখ টাকা পেলেন। একই সময়ে শাহবাগের দুই কবি তাদের কবিতার বইয়ের পেছনে একলাখ টাকা ইনভেস্ট করে সেসব বই এর প্রচারণা চালাতে থাকলেন। দুই কবির এক লাখ টাকা ইনভেস্টকে আয় ধরে যদি হুমায়ূন আহমেদসহ তিনজনের উপার্জনের একটা গড় করা হয় তাহলে মাথাপিছু আয় দেখা যাবে এক লাখ টাকার বেশি। বুঝুন তাহলে…

বড়লোক হওয়ার পরিসংখ্যানের ভেতরের গল্প অন্যরকমও হতে পারে। একারণে কেউ কেউ বলে থাকেন- মিথ্যে তিন ধরনের। মিথ্যে, ডাহা মিথ্যে ও পরিসংখ্যান! যেমন ধরুন ধান ওঠার গল্প। সরকার আপনাকে বলবে এবার কোটি কোটি টন ধান হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলার কৃষি কর্মকর্তার অধীন জনা পঞ্চাশেক কর্মচারী প্রত্যেক গ্রামের প্রত্যেক কৃষকের কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছে কী পরিমাণ ধান হয়েছে। সব গ্রামের হিসেব যোগ করে উপজেলায় আনা হয়েছে। এরপর জেলায়। তারপর রাজধানীতে গিয়ে টোটাল হিসেবের পর জানা গেছে কয়েক কোটি টন ধান হয়েছে। বাস্তবে কোন কৃষকের কাছে কেউ জানতে চায়নি খরা বা অতিবৃষ্টির কারণে আসলেই তারা পরিমাণ মতো ধান পেয়েছে কিনা? যাদের হিসেব দেওয়ার কথা প্রথমে তারা একটা হিসেব দিয়েছে, পরে গ্রাম থেকে শহরে আসা ধানের হিসেব তারা মিলিয়েছে। বাজেটে প্রবৃদ্ধির হিসেবও তাই!

ভারতে বাজেটের প্রবৃদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে না খেয়ে থাকা মানুষের সংখ্যাও বাড়ে! বাড়ে কৃষক ও গৃহবধুদের আত্মহত্যার সংখ্যা। সরকারের টনক নড়ে। ফসল না হওয়া এবং ঋণের বোঝা সইতে না পেরে যে আত্মহত্যা সেটা বদলে দেয় পুলিশ। আত্মহত্যার পুলিশ কেইসে লেখা হতে থাকে বিষ খেয়ে হত্যা। ঋণের বোঝা বইতে না পেরে তো বিষ খাবেই। আবার সরকারকে 'আত্মহত্যার' দায়ও নিতে হচ্ছে না। পেটের জ্বালায় কিংবা ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করা গৃহবধূর আত্মহত্যার ঘটনাও চালিয়ে দেয়া হতো পারিবারিক কলহের নামে। বাজেটে প্রবৃদ্ধি কিন্ত বাড়ে এতসব সত্ত্বেও। বাজেটের প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন কিন্তু কবিতা দিয়ে হয় না। সাধারণ মানুষ বুঝে ওঠার আগেই এক ধরনের অংক বা পরিসংখ্যান দিয়ে এসব হয়। 'অংক কষে চাই না তোমায় কবিতা দিয়ে চাই' কবিতার লাইন এমন হলেও সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন- "ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"। 

রুটি বা পেটই আসল। এই দুনিয়ার সবাই জানুক আসল ধর্ম পেট। মানুষ হয়তো ক্ষুধার কারণেই বড়লোক হতে চায়। সব খাবার, সব ক্ষমতা, সব শক্তি মানুষ তার নিজের মুঠোয় রাখতে ভালোবাসে। তবে কেউ কেউ নিজ সাধনা ও কর্মফলের কারণে অর্থের দিক থেকে ধনী বা বড়লোক হতে পারেন। চীনের জ্যাক মার কথাই ধরুন। ১৯৯৫ সালে প্রথম ইন্টারনেটের কথা জানতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রে এসে। ১৯৯৯ সালে চীনে ফিরে অনলাইনে কেনাকাটার অন্যতম প্লাটফর্ম আলীবাবা প্রতিষ্ঠা করেন যা আমাজনকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। প্রথম জীবনে ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক আর এখন তিনি চল্লিশ বিলিয়ন ডলারের মালিক। জ্যাক মার মতো আরও আছেন হাওয়ার্ড সালচেজ বা পল জোরিয়া। সালচেজ থাকতেন দারিদ্রপীড়িত এলাকায়। নজরুলের কবিতার মতো দারিদ্র তাকে করেছে মহান। ইউনিভার্সিটিতে ফুটবলের ওপর বৃত্তি নিয়ে যাবার পরে সেখানে প্রথম কফি শপ খোলেন। সারা পৃথিবীতে এখন স্টারবাক্‌স এর ১৫টি শাখা আছে। তাদের কল্যাণে কয়েক বিলিয়ন ডলারের মালিক হাওয়ার্ড সালচেজ। পল ডি জোরিয়াও তাই। গরীবি তাকে বেঁধে রাখতে পারে নি। এক সময়ে 'ক্রিসমাস কার্ড' বিক্রি করতেন। এরপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে চুলের শ্যাম্পু বিক্রি করে কিছু টাকার মুখ দেখেছিলেন। এখন কয়েক বিলিয়ন ডলারের মালিক। পৃথিবী জুড়ে এমন উদাহরণ অসংখ্য আছে। কিন্তু রাষ্ট্র কী সবসময় এমন বড়লোক হবার পরিবেশ তৈরি করে নাকি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের 'মহান' করে দেখানোর ইচ্ছেতেই আমলা বা কর্তাব্যক্তিরা তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা ব্যয় করেন? এটা করতে যেয়ে প্রান্তিক মানুষের সামর্থ্য নিয়ে নিদারুণ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়। গরীবরা জানে তারা গরীব। কিন্তু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ?

এ দুনিয়ার সবাই জানে মানুষের আসল ধর্ম-পেট। করোনাভাইরাস অতিমারী সংক্রমণের এ সময়ে সারা পৃথিবীতে ব্যবসা বাণিজ্য দারুণভাবে মার খেয়েছে। কতগুলো গার্মেন্ট, মুদি দোকান, সিনেমা হল আর খাবার হোটেল বন্ধ হয়েছে তার কি কোনও পরিসংখ্যান আছে? বিদেশে যে শ্রমিক মানবেতরভাবে ছিল তার কি কোনও আয় বেড়েছে? তাহলে রেমিটেন্সের কী হাল? প্রান্তিক মানুষের আয় কমেছে অনেক। রাস্তায় রাস্তায় কথিত স্বল্পমূল্যে চাল-ডাল-তেল-পেঁয়াজ কিনে কোনরকমে খেলে কি সুখের ঘুম আসে? এই ঘুমেই কী স্বপ্নপ্রাপ্ত মহৌষধ পাওয়া যায়? এই ওষুধ খেলে কী মানুষ ঘুমের মধ্যেই বড়লোক হয়? করোনা অতিমারীর ধাক্কা পৃথিবীর কোনওদেশই কাটাতে পারেনি। সেখানে বাংলাদেশ যদি এমন স্বপ্নের ওষুধ পায় তাহলে এটা বিদেশে রপ্তানি করলে ক্ষতি কী?

অবশ্য ব্যক্তিগত চেষ্টার মাধ্যমে টাকা পয়সা বানানোর সাধনা ভিন্নতর। মানুষকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়,বড় হবার স্বপ্ন থাকতে হয়। মানুষ তার স্বপ্নের চেয়ে বড় তাই নিজেকে কখনো ছোট ভাবা যাবে না।' আমার টাকা-পয়সা নেই, ব্যবসা করবো কী করে কিংবা মামা চাচা নাই চাকরি পাব কেমন করে'- এ মানসিকতা পরিহার করতে হবে। সহসা হতাশ না হয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিশ্রমটাই আসল। পাকিস্তানের শাহীদ খান যিনি একদা 'বাসন ' মাজতেন আজ তিনি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক। বিল গেটস তার জীবনে কতবার ব্যর্থ হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু রবার্ট ব্রুসের মত তিনি 'একবার না পারিলে দেখ শতবার'- এ মানসিকতা নিয়ে 'মাইক্রোসফট' কোম্পানির জন্ম দিয়ে সারা বিশ্ব তোলপাড় তুলেছেন। এসব আসলে উদাহরণযোগ্য কিছু মানুষের সাধনা ও কর্ম যা মানুষকে বড় বা ধনী হবার স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু যখন আপনি নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ, আপনার সামর্থ্য নিয়ে যদি কেউ টানাটানি করে তখন? যে সরকার মানুষের, যে সরকার জনগণের তার সাথে কোনকালে হয়তো মানুষ বা জনগণের দেখা হয় না। মানুষের জন্য যে রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রের প্রতিটা পদক্ষেপে প্রান্তিক মানুষের জন্য ভালোবাসা কিংবা জীবনযাপনের মান বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা প্রবল থাকে। কিন্তু সময় এখন অন্যরকম। রাষ্ট্রের সাথে মানুষের সম্পর্ক এখন দাদন নেওয়া জেলেদের সাথে সম্পর্ক যেমন মালিকের ঠিক তেমন। চা বাগান কিংবা গার্মেন্ট শ্রমিকের সাথে মালিকের যে সম্পর্ক সেই সম্পর্কটাই বাস্তব। বাকি সব কিতাবে থাকে। আগের দিনের মতই উন্নয়নের 'বলদ' গোয়ালে থাকে না। 

বছরের প্রথম লেখাটা শুরু করেছিলাম কোন এক মন্ত্রীর আশাবাদ ও সম্ভাবনার কথা দিয়ে। তিনি বলেছিলেন এদেশের মানুষ এখন ঘুমের মধ্যেই বড়লোক হয়। মাথাপিছু আয় বাড়ে। আয় বাড়লে কার না ভালো লাগে। তাই ভালো লাগার গল্প শুনে বিদায় নেই।

বড়লোকদের সব কিছু বড় নয়। ধরা হয়ে থাকে গরীবের খেলা ফুটবল। বলের আকার বেশ। মধ্য আয়ের মানুষের খেলা নাকি ক্রিকেট। ব্যাট,প্যাড, স্ট্যাম্প আর বল কিনতে ফুটবলের চেয়ে বেশি টাকা লাগে।  ক্রিকেট বলের আকার একটু ছোট। বলা হয়ে থাকে বড়লোকের খেলা হচ্ছে 'গল্ফ'। বলের আকার আরও ছোট। দয়া করে বলের আকারের সাথে অন্য কিছু মেলাবেন না।

এবার 'উন্নয়নের' গল্প। এক লোক উন্নয়নপুর রাজ্যে প্রথমবার গিয়েছে। তাকে গ্রাম ঘুরে দেখাচ্ছে প্রহরীরা। গ্রামের যেখানটা তার ভালো লাগবে সে সেখানেই থাকবে। প্রহরী প্রথম নিয়ে গেল তাকে 'বনানী' পাড়ায়। এখানে সব কিছু নিয়ম মাফিক। পাখিরা নিয়ম মাফিক ওড়ে। বাসিন্দারা নিয়ম মতো ঘুমাতে যায়। বাসিন্দারা সব জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। আকাশ বাতাস সব কিছু ছবির মতো। সন্ধ্যার পর নিয়মমাফিক পান করে। লোকটা বললো- আমি আরেকটু ঘুরে দেখতে চাই। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো 'ফকিরেরপুল' গ্রামে। এখানে সবকিছু এক হলেও তেমন নিয়মের বালাই নেই। বনানী বাজারে তরকারির যা দাম ফকিরেরপুলেও তাই। বনানী পাড়ায় যেমন কিছু নায়ক-নায়িকা থাকে, তেমনি ফকিরেরপুল পাড়াতেও থাকে। তবে বনানীর চেয়ে ফকিরেরপুল পাড়ায় ক্যাসিনো আর 'বার' বেশি। রাত হলে এখানে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা বড়লোক গরীব অনেকের দেখা মেলে। লোকটি প্রহরীকে বললো, "আমি ফকিরেরপুল পাড়াতে থাকতে চাই।" প্রহরী একটা বিশতলা ভবনের ছাদ থেকে লোকটিকে ফেলে দিয়ে বললো- ":আপনাকে পাঠিয়ে দিলাম ফকিরেরপুল পাড়ায়। শুভকামনা আপনার জন্য।" লোকটা নিচে পড়তে পড়তে খেয়াল করলো নিচে পচা ড্রেন। পাশেই কীসে যেন আগুন দেয়া হয়েছে। রাস্তা কাটা। গন্ধওয়ালা ডাস্টবিন ও ময়লার পাশে বিশাল ট্রাফিকজ্যাম। লোকটা চীৎকার করে বললো- "আপনারা আমাকে কোথায় পাঠালেন?"

প্রহরী উত্তর দিলো, "আপনাকে বনানী ও ফকিরেরপুল পাড়ার উন্নয়নের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়েছিল। আপনি এখন বাস্তবে ফিরছেন।"

রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক বাস্তবতা রূপকথার গল্প না। উন্নয়নজনিত হিসেব আর পরিসংখ্যানের অনেক 'বলদ'ই কিতাবেই থাকে, বাস্তবের কোনও গোয়ালে থাকে না।