চুকুর হতে পারে বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় ফসল

এ কে এম আমিনুল ইসলাম
Published : 23 August 2020, 03:53 PM
Updated : 23 August 2020, 03:53 PM

চুকুর বা চুকাই, বাংলাদেশে বিস্মৃত প্রায় একটি  অল্মমধুর ফলের নাম। চুকাই মূলত এক প্রকার উপগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের ফল। এর ইংরেজি নাম রোজেল বা সরেল (Roselle, Sorrel) এবং বৈজ্ঞানিক নাম 'Hibiscus sabdariffa '। সিলেটে এটিকে 'চুকাই' বা 'হইলফা' বলা হলেও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন- অম্ব মধু, অম্বল মধু, চুকুল, মেডশ, মেট্টস, মেষ্টা, চুকুর, চুকুরি, চুপুরি, চুকোর, চুকা, চুক্কি, গোডা ইত্যাদি। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ডাকা হয় আরও সুন্দর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ নামে। গ্রামবাংলায় সবজি হিসেবেও এটি বেশ পরিচিত। 

ভোজনপ্রেমী বাঙালি এটিকে বিভিন্নভাবে খেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বন্য প্রজাতির মেস্তা (এম-৭১৫) থেকে বিশুদ্ধ সারি নিবার্চন ও গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সবজি হিসেবে খাবার উপযোগী একটি উন্নত মেস্তার জাত উদ্ভাবন করেছে এবং জাতীয় বীজ বোর্ড কতৃর্ক ২০১০ সালে বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১) নামে অবমুক্ত করা হয়েছে। এটি চুকুর হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। চুকুর পাতা রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। চুকুর ফল ও পাতা দিয়ে তৈরি করা ভর্তা ও শাক-গরম ভাতের সাথে খেতে অসাধারণ। আবার চিংড়ি মাছ, শোল মাছ, ট্যাংড়া মাছ, পুটি মাছ দিয়ে এর ঝোল যে কোনও ভোজনপ্রেমী মানুষ একবার খেলে দীর্ঘদিন মুখে লেগে থাকবে। অনেকে গরু কিংবা খাসির মাংসের সাথেও চুকুর পাতা ও ফল ব্যবহার করে থাকেন। এতে খাবারের স্বাদ আরও বাড়িয়ে তোলে। এর মাংসল বৃতি (শাঁস) কনফেকশনারি খাদ্যসামগ্রী যেমন-জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান থাকে। চুকুরের ফলে পেকটিন থাকায় শুধু চিনি ও চুকাই দিয়ে সহজেই জ্যাম তৈরি করা যায়। এছাড়া চুকুর এর বৃতি থেকে খাবারের রং ও ফ্লেভার প্রস্তুত হয়। চুকুর এর বীজ এ ২০ শতাংশ তেল পাওয়া যায়। পৃথিবীর অনেক দেশে এই তেল সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং খাবার তেলের সাথে এই তেল মিশানো হয়।

উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুকুর শুধু নিজেদের খাবার হিসেবে নয়, বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে সম্ভাবনাময় একটি খাতে পরিণত হতে পারে। চুকুর দিয়ে উৎপাদিত চা, মেস্তাসত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ইত্যাদি বাজারজাত করা গেলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতির চিত্র। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে এই শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, খাবার ও সম্ভাবনাময় শিল্পের এই চুকাই ভেষজ উদ্ভিদ হওয়ায় এর স্বাস্থ্য উপকারিতাও অনেক। পুষ্টিবিদদের মতে, চুকুর দিয়ে তৈরি যেকোনও খাবার অন্যসব খাবারের তুলনায় অধিক পুষ্টি সম্বলিত। এক সময় চুকুর গাছ কবিরাজি ওষুধ হিসেবে ব্যাপক ব্যবহৃত হতো। চুকুর ফল ও পাতা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া মূত্রবর্ধক, মৃদু কোষ্ঠ-নরমকারী, হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং স্নায়ুরোগের চিকিৎসায় এটি অপরিসীম। চুকুর পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান রয়েছে। 

এছাড়াও চুকুের প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল কমায়, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, উচ্চরক্তচাপ কমায়, রক্তের চিনি পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে, ওজন কমাতে এবং বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই সবজি মেস্তা খাদ্য হিসাবে খুবই জনপ্রিয়। চুকুর আফ্রিকা, কেনিয়া, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ভারত, চীন, ফিলিপাইন, আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য উষ্ণমন্ডলীয় দেশে ভাল জন্মায়। তবে সবচেয়ে বেশি চুকুর উৎপাদন হয় জামাইকা, সুদান, মেক্সিকো এবং চীনে। বর্তমানে এর বাণিজ্যিক গুরুত্বের জন্য এশিয়ার অনেক দেশ যেমন, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াতে চুকুর এর চাষাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চুকুর বাংলাদেশে একটি দেশীয় সবজি হলেও বাণিজ্যিকভাবে এই সবজিটির চাষাবাদ তেমন হয় না। তবে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, সিলেট ও অন্যান্য জেলায় সবজি মেস্তা বা চুকুর এর চাষাবাদ হয়। বিশ্বে চুকুরের হেক্টর প্রতি ফলন সাড়ে চার থেকে ৬ টন (ফ্রেশ বৃতি) এবং ৮০০-১২০০ কেজি (শুকনা বৃতি)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর চুকুর এর উন্নত জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও চুকুর চাষ একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কাঁচা খাওয়ার পাশাপাশি চুকুর প্রক্রিয়াজাত করেও ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া বিদেশে চুকুর-এর প্রচুর চাহিদা থাকায় চুকুর থেকে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চুকুর উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং বাণিজ্যিকভাবে চুকুর চাষ করছে, পাশাপাশি নতুন নতুন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কলকারখানা স্থাপন করছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং খাদ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। অদুর ভবিষতে চুকুরকে ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনে প্রক্রিয়াজাতকরণ কলকারখানা গড়ে ওঠতে পারে যার ফলে দেশে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। দেশের কৃষক ও জনগণকে এই ফসলের উপকারিতা সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে পারলে চুকুর চাষ সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। তবেই চুকুর বাংলাদেশে একটি সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিণত হবে।