ভারত কি তার বহুত্ববাদকে বিসর্জন দিতে চায়?

মীর মোশাররফ হোসেনমীর মোশাররফ হোসেন
Published : 29 Feb 2020, 02:10 PM
Updated : 29 Feb 2020, 02:10 PM

পিংক ফ্লয়েডের রজার ওয়াটার্সের কাছেও দাগ কেটেছে দিল্লির রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ-সহিংসতা। ভারতের তরুণ কবি আমির আজিজের লেখা গানে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনিও বলেছেন- সাব ইয়াদ রাখা জায়েগা। তো, ফেব্রুয়ারির দিল্লির কী কী মনে রাখতে হবে? মসজিদ ভাঙার দৃশ্য, পাল্টাপাল্টি পাথর ছোড়া, রক্ত, লাশ, আগুন। ভয়, আতঙ্ক। এটুকুই? না। আরও কিছু মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে- এই ঘৃণার সময়ে, এই বিভেদের রাজনীতিতে, এই উসকানিতেও গুরুদুয়ারা খুলে শিখরা অপেক্ষা করেছেন প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো মুসলমানের। মহারাষ্ট্রের এক বাসিন্দা টুইটারে বলেছেন, "যে কোনো মুসলমান পরিবারসমেত তার বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারবেন; এ জন্য 'বেঈমান', 'গাদ্দার' হতেও আপত্তি নেই তার।"

মনে রাখতে হবে, খুনের বদলা খুনের সময়েও হিন্দুর বিয়ে পাহারা দেয়া মুসলিম যুবকদের; আতঙ্কিত মুসলিমদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হিন্দু পরিবারগুলোকে।

আরেকটু এগিয়ে বললে, বিরুদ্ধ সময়ে মনে রাখতে হবে- শিরদাঁড়া উঁচু করে রুখে দাঁড়ানো মানুষজনকে। মনে রাখতে হবে- বিদ্বেষের আগুন থেকে ৬ মুসলমানকে বাঁচিয়ে নিজেই মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া প্রেমকান্ত বাঘেলকে।

সাব ইয়াদ রাখা জায়েগা। তবে এটা ‍কি পূর্বঅনুমিত কিছু নয়? গত বছর নরেন্দ্র মোদি যখন বিপুল ভোটে দ্বিতীয় মেয়াদে দিল্লির মসনদে বসেন, তখন থেকেই কি এরকম একটা কিছুর প্রতীক্ষা চলছিল না? নাগরিকপঞ্জি, সংশোধিত নাগরিক আইন; এনপিআর- ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার একের পর এক এ ধরনের আইন আর পদক্ষেপকে ঘিরে কি ভেতরে ভেতরে দানা বেধে উঠছিল না ক্ষোভের অস্ত্র?

গুজরাটে শত শত মানুষকে কচুকাটার উদাহরণ হয়তো দশক পুরনো; কিন্তু রক্তের দাগ তো এখনো শুকায়নি। ক্ষতিগ্রস্তরা পাননি বিচার। গুজরাটের সেই মডেলই যেন গত সপ্তাহে ফিরে এসেছিল দিল্লির উত্তর পূর্ব অংশে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফর ঘিরে রাজধানীতে সাজ সাজ রব। তার মধ্যেই ছিল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনবিরোধী বিক্ষোভকে ঘিরে উত্তাপ।

জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আর শাহিনবাগের আন্দোলন ঘিরে বিজেপির নেতাকর্মীরা তো আগে থেকেই খ্যাপা। তাদের এক নেতা কপিল মিশ্র আরও এককাঠি এগিয়ে, ট্রাম্প দিল্লি ছাড়ার পরপরই শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের তুলে দেওয়া হবে বলে হুমকিও দিয়েছিলেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের বক্তব্য অনুযায়ী, কপিলের এ বক্তব্যই যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। রোববার পক্ষে-বিপক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। এবং তারপর গুলি, হামলা, সহিংসতা। পাঁচদিনেই এ সহিংসতা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ৪২ জনের; আহত পেরিয়েছে ৩০০। তিন হাজারের বেশি বাড়িঘর-দোকান পুড়ে গেছে; মসজিদের মিনার ভেঙেছে, তিনটি স্কুলে চলেছে তাণ্ডব, লাশ পড়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তা, পুলিশ সদস্যের।

অথচ কি আশ্চর্য, সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেন দায়ই দেখা যায়নি। একদিকে লাগাতার সংঘর্ষ চলছে, অন্যদিকে ট্রাম্প-মোদী করছেন প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনা, মেলানিয়া করছেন আরেক স্কুলে 'হ্যাপিনেস ক্লাস'। একদিকে নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি, অন্যদিকে সংঘর্ষকে বাড়তে দেয়া। বিরোধীদলের চাপ ছিল সেনা মোতায়েনের; কেন্দ্রিয় সরকার তাতে গা করেনি। কয়দিন আগেই দিল্লির নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে জিতেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল; সহিংসতা নিয়ে এমনকী তাকেও আশ্চর্য রকমের চুপ থাকতে দেখা গেছে। আম আদমি পার্টির এক নেতার বিরুদ্ধে সহিংসতার মধ্যে গোয়েন্দা কর্মীকে হত্যারও অভিযোগ উঠেছে।

এটা মোটামুটি পরিষ্কার যে, দিল্লির এ আগুন থেকে ফায়দা লুটতে চেষ্টা করবে মোদি-অমিত শাহের বিজেপি। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে এমনিতেও তারা বিপাকে। নাগরিকপঞ্জি নিয়ে, এনপিআর নিয়ে খানিকটা পিছিয়ে। সাম্প্রতিক ভোটগুলোতে ভোটের হারও কমছে। বিরোধীরা একজোট হচ্ছে। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর দিক থেকে চাপও বাড়ছে। কেন্দ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ-সমাবেশ হচ্ছে।

ব্যাপারটা এমন নয় যে, বিজেপির জনসমর্থন হু হু করে কমছে। ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতি উসকে দিয়ে, অন্যদের দমিয়ে রেখে, তারা এখনও ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী দলই থাকছে। সবচেয়ে বেশি আয় করা দলও তারা। ট্রাম্প, এর আগে বোলসোনেরোকে দেশে এনে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের বন্ধু সংখ্যাও যে কম নয়, তারও প্রমাণ দিয়েছে তারা।

অনেকেই বলছেন, দিল্লির সহিংসতা আদতে দেশটির বদলে যাওয়া চরিত্রেরই রূপ। না সংঘর্ষ, দাঙ্গা আগেও দেখেছে ভারত। কিন্তু এ যেন নতুন কিছুর বার্তা। যে ভারত বহুত্ববাদের কথা বলে এসেছে, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে এসেছিল, বিশ্বকে দেখাচ্ছিল তার বৃহৎ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সে এখন ধীরে ধীরে বিশ্বের সেসব দেশের কাতারে এসে হাজির হচ্ছে- যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত, ভাষা, ধর্ম, চাহিদা সবচেয়ে প্রাধান্যশীল।

বিজেপির বিকাশ এই মুহূর্তে এই প্রশ্নটিকেই জোরের সঙ্গে হাজির করছে। গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়েই তারা ক্ষমতায় এসেছে; এখন রাষ্ট্র যন্ত্রকে ব্যবহার করে সেই সুবিধা অন্যদের জন্য ছেঁটে ফেলতেই তারা যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে।

মোদির দুই মেয়াদে আমরা বিভিন্ন বিধানসভা নির্বাচনের পর বিধায়ক কেনা-বেচা দেখেছি; যেনতেন উপায়ে (এটাই নাকি এখন সব দলের মোক্ষ) ক্ষমতায় বসতেই হবে- এই পন্থা কার্যকরে হন্যে হয়ে উঠতে দেখেছি। বিচার বিভাগকে সরকারঘেঁষা সিদ্ধান্ত দিতে দেখেছি। কেবল তাই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত অনেক দলকেই 'সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ও তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতি নরম' হতে দেখেছি।

তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির মতো দলগুলো আগে যেখানে ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে সরব ছিল; গত কয়েক বছরে তাদের সুর খানিকটা মোলায়েম মনে হচ্ছে। ভোটের হিসাব কষে, তারাও সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠদের বেজার না করার নীতিতে সওয়ার হয়েছে। কেবল এ আঞ্চলিক দলগুলোই বা কেন, বিজেপিকে ঠেকাতে কংগ্রেসকেও কি মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে জোট বাঁধতে হয়নি?

অবশ্যই, রাজনীতিতে মাঝে মাঝে কৌশল, নীতিকে ছাপিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এ যাবতীয় ঘটনা ও এর অনুষঙ্গ জাতীয়ভাবে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাবকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। যাকে বিজেপির দীর্ঘমেয়াদি লাভ হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে।

পৃথিবীজুড়েই ডানপন্থার বাড়বাড়ন্ত দেখছি আমরা; ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়, আঞ্চলিক ভেদাভেদ আর বিদ্বেষের মুখোমুখি অবস্থান দেখছি। ক্ষমতাসীনরা এসব বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক অধোগতিকে ঢেকে ফেলতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের জিগিরকে কাজে লাগিয়ে নিজেরা আরও আরও কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারে।

ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থাও মারাত্মক। একের পর এক সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিকরণ করতে হচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে; উৎপাদন কমছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটির শ্লথ প্রবৃদ্ধি নিয়ে দেশে-বিদেশের সব অর্থনীতিবিদ আর সংস্থা উদ্বেগ জানিয়েছে। বৈশ্বিক বিভিন্ন ঘটনাবলী তো আছেই। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্বের কারণে তেলের বাজারে অস্থিরতা, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মন্দা। তবে এতকিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই নয়া দিল্লির। অর্থনীতির ভালোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের চেয়ে তাদের বেশি আগ্রহ নিত্যনতুন অস্ত্র কেনায়, পাকিস্তান কিংবা চীনের সঙ্গে জং ধরে রাখায়।

এনিমি আউটসাইড, অ্যান্ড এনিমি ইনসাইড। অনেকে বলছেন, বহুল ব্যবহৃত এই নীতি কার্যকর রাখতেই বিজেপি সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে কাজে লাগাচ্ছে। হাজির করছে নাগরিকপঞ্জি, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের মতো বিতর্কিত সব কর্মপরিকল্পনা।

কে জানে, এই তত্ত্বায়নে হয়তো বিজেপির দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ইচ্ছা পূরণ হবে। কিন্তু বিপদে পড়বে ভারতের বহুত্ববাদী সহাবস্থান। কেবল তো ধর্মই নয়, নানান ভাষা, জাতি, সম্প্রদায়ের এই যুথবদ্ধতা আঘাতপ্রাপ্ত হলে, রাষ্ট্র ভারত টিকে থাকতে পারবে তো?