মানুষ ফেরে না, হায়েনারা ফিরে ফিরে আসে

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 29 Feb 2020, 01:40 PM
Updated : 29 Feb 2020, 01:40 PM

পৃথিবীজুড়ে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ছিল শুক্রবার। দিল্লির এক মসজিদে জুমার নামাজ পড়ছিল মুসলিমরা। হাতে হাত রেখে মানববন্ধন করে সে মসজিদ পাহাড়া দিয়েছিল প্রতিবেশি হিন্দুরা। খুব সাধারণ একজন মানুষ যার নাম রবার্ট (হয়তো তিনি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী) তিনি এই ছবির নিচে মন্তব্য করেছেন- "বহুদিন পর ঈশ্বরকে নেমে আসতে দেখলাম! ঈশ্বর সম্ভব হলে থেকে যাবেন ইন্ডিয়াতে!"

পৃথিবীতে মানুষকে ভালোবাসার অপরাধে (!) অনেকের শাস্তি হয়েছে। ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য সহসা কারো শাস্তি হয়নি, ভবিষ্যতেও হয়তো হবে না। ঈশ্বরের নামে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করা হয়েছে এবং যারা হত্যা করেছে তারা এসব ঈশ্বরের নামেই করেছে। ভারতের দিল্লিতে মানুষকে ভালোবেসে যারা প্রতিবাদে নেমেছিল তাদের কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে।যারা হত্যা করেছে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেনি বরং সাংবাদিক কিংবা অটোরিক্সা চালককে কাপড় খুলে তাদের 'ধর্ম' (!) দেখাতে হয়েছে! ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনারা মুক্তিকামী নিরীহ মানুষদের হেনস্তা করতো, কাপড় খুলে ধর্ম দেখাতে বাধ্য করতো। যুগে যুগে সহসা তাই মানুষ ফেরে না, হায়েনারা ফিরে ফিরে আসে!

ধর্ম যখন ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম অন্য ধর্মের অনুসারীদের ঘৃণা করতে শেখায়। যুদ্ধ যতো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তারচেয়ে ঢের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে ধর্ম নিয়ে উন্মাদনায়। নরেন্দ্র মোদির হৃদয়ে মানুষের জন্য এখন ঘৃণা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যা তিনি ঘটিয়েছিলেন নিজরাজ্য গুজরাটে, তাই তিনি উসকে দিয়েছেন দিল্লিতে। হয়তো আরও কয়েক রাজ্যে ছড়িয়ে দেবেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তার নাম দেওয়া হয়েছিল 'গুজরাটের কসাই'। আশা করি এরপর থেকে তার নাম হয়ে যাবে 'ভারতের কসাই'।

আফগানিস্তান, ইরান আর তুরস্ক আজও কবি ও দার্শনিক জালালউদ্দীন রুমীকে নিয়ে গর্ব করে। আটশ বছর আগে রুমী বলে গিয়েছিলেন-"মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আসল ধর্ম। মানুষের হৃদয় হচ্ছে উপাসনালয়।"

কাজী নজরুল তাই প্রশ্ন তুলতেই পারেন- হিন্দু না মুসলিম আজ জিজ্ঞাসে কোন জন?

নজরুল আরও বলেছিলেন- "হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই।" জাত-পাত-ধর্মীয় অনাচারের এই পৃথিবীটাকে লালন সাঁইজি বলতেন- 'আজব কারখানা'।

রুমী বলে গেছেন পৃথিবী নামের আজব কারখানায় যত মসজিদ-মন্দির- গির্জা বা প্যাগোডা আছে কোথাও ঈশ্বর থাকেন না। ঈশ্বর থাকেন মানুষের হৃদয়ে। যে মানুষের হৃদয়ে ঈশ্বর নেই ইশ্বরের সেইসব অনুসারীরাই ঈশ্বরের নামে খুনোখুনি করতে নেমে পরে। যুক্তদরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প (২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ভারত সফরে এসে যখন নরেন্দ্র মোদির সাথে খাসির বিরিয়ানি খাচ্ছিলেন তখন সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া এক সাংবাদিকের পোশাক খুলে দেখা হচ্ছিল তিনি হিন্দু না মুসলমান। খাওয়া দাওয়া শেষে ট্রাম্প যখন ইন্ডিয়ান মিঠাই মন্ডা খাচ্ছিলেন তখন দিল্লির এক গরীব অটো রিকশা চালক শহীদ খানের বউ বুঝতে পারছিলেন না তার স্বামীকে কেন হত্যা করা হয়েছে। অল্পবয়সী এই মেয়েটা বুঝতে পারছিলেন না তার পেটের অনাগত সন্তানকে নিয়ে তিনি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন!

ঈশ্বরের নৃশংস সন্তানদের নির্মমতায় সবকিছু হারিয়ে নি:স্ব হয়েছেন মোহাম্মাদ সাইদ সালমানি। হিংসার আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছেন সালমানির মা আকবরি যার বয়স কিনা ৮৫! রাজধানী দিল্লির খাজুরী খাস থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে গমরী এক্সটেনশন লেনে কয়েকশ মুসলিম পরিবারের বসবাস ছিল। পুলিশের সহায়তা নিয়ে মোদির অনুসারীরা মুসলিমদের বাড়ি ঘর লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়। সাইদ সালমানির আট লাখ রূপি লুটে নেয় তারা, পালাতে না পারা আকবরি হন পুড়ে ছাই। উম্মত্ত মোদি সমর্থকদের হামলা থেকে বাঁচতে কয়েকশ মুসলিম রাতে আশ্রয় নেন আজিজিয়া মসজিদে। (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০) সকালে অন্য মুসলিমরা তাদের মসজিদ থেকে উদ্ধার করে।

ভারত তার সাম্প্রদায়িক চরিত্র ক্রমশ হারানো শুরু করে মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিল মোদীদের পূর্বসূরী। এখনও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো  নাথুরাম গডসেকে 'নায়কজ্ঞানে' স্মরণ করে। শোষণের নামে একদা ব্রিটিশরা ভারতে 'ডিভাইড অ্যান্ড রুলের' নামে হিন্দু মুসলিম বিভাজন ও দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি সেই পুরোনো পথেই নিয়ে গেছেন ভারতকে। এখন মোদি-বিরোধিতাকে প্রচার করা হয় 'পাকিস্তানি চিন্তাধারা'র বহির্প্রকাশ হিসেবে। হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টানদেরও উসকে দেয়া হচ্ছে মুসলিম বিরোধিতায়। মোদি সমর্থকরা প্রচার করে যাচ্ছে মুসলিমরা মূলত 'ভিনদেশি'। প্রকাশ্যে বলা হয়, ঘোষণা দেয়া হয়-রাস্তা ছাড়, দেশ ছাড়!

মুসলিমদের জানিয়ে দেয়া হয় তারা 'ভারতপ্রেমিক' নয়। তাদের বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানে চলে যেতে বলা হয়। তারা ভারতের জাতীয় সংগীত গাইতে পারে কিনা সেই পরীক্ষা নেয়া হয়। মোদির উগ্র সমর্থকরা প্রচার করে যে মোদির বিরোধিতা মানে 'হিন্দুত্বের' বিরোধিতা। মোদীর বিরোধিতা মানে নাকি 'ভারত বিরোধিতা'। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা, বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া, প্রবাসী ভারতীয়দের রেমিটেন্স পাঠানো কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, সবচেয়ে বেশি সম্পদের মালিকদের ভারত ছাড়ার প্রবণতা, সামাজিক বৈষম্য, ধনী গরীবের ব্যবধান স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি হওয়া এসব নিয়ে যখন সাধারণ ভারতীয়দের নাভিশ্বাস চরমে, তখনই ধর্মের নামে বিভাজন উসকে দিয়ে জনপ্রিয়তা ধরে রাখার মোদির এই হীন কৌশল ভারতের দীর্ঘদিনের কথিত 'অসাম্প্রদায়িক' চরিত্রটা বদলে দিয়েছে। যা ছিল গুজরাটে, যা আজ দিল্লিতে হয়তো কাল সেটা মোদিরা ছড়িয়ে দেবে আসামে বা অন্য কোথাও!

উগ্রবাদিতা ধর্ম নয়। শত ধর্ম, বর্ণ আর বিচিত্র সংস্কৃতির যে মিলনমেলা ভারত, সেই মিলনমেলার ভারতেই ঈশ্বর থাকেন। মোদির ভারতে ঈশ্বর থাকতে পারেন না। শোষণ, উগ্রবাদ আর মানুষ ভাগের মোটা দাগে যে ধর্ম মোদি ভারতের ওপর চাপিয়ে দিতে চান সেটা কোন ভারতীয়ের ধর্ম হতে পারে না। মোদির ভারতে মুসলিমরা যে নিগ্রহের স্বীকার হচ্ছেন আমরা যেন তাদের জন্য প্রার্থনা করি। দিল্লিতে মসজিদের পাশে মানববন্ধন করে যে হিন্দুরা মুসলিমদের নির্বিঘ্নে নামাজ পড়তে দিয়েছেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে দিয়েছেন তাদের কথা মনে রেখে আমরা যেন বাংলাদেশের সব সংখ্যালঘু মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখি।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাংলাদেশের ছবি এঁকেছিলেন, ধর্মের বিভাজনের নামে মানুষ শোষণের বিরুদ্ধে যে পিতা আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, সেই পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে অতিথি বা বক্তা হিসেবে বাংলাদেশ মোদিকে কামনা করে না। হৃদয়ের যে উপাসনালয়ে ঈশ্বর থাকেন, হৃদয়ের যে জানালায় দাঁড়ালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা আমাদের প্রেরণা হয়ে ওঠে, হৃদয়ের সেই উঠোনে- মোদির কোনও আশ্রয় হতে পারে না।

পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশ তোমাকে চায় না নরেদ্র দামোদর মোদি।