সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ, অনুবাদ এবং আমাদের বইমেলা

বাঙালি যখন ইংরেজি ইংরেজি করে ঘুর ঘুর করে, পৃথিবীর অনুবাদচর্চা তখন অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 17 Feb 2023, 05:11 PM
Updated : 17 Feb 2023, 05:11 PM

একটি খবরের সূত্র ধরে লেখাটি শুরু করতে চাই। দিন দু-এক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে প্রথম বাংলা-নর্ডিক সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। উৎসবে কবিতা পাঠ এবং আলোচনা সংলাপের পাশাপাশি জাতির জনকের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছাকে নিয়ে রচিত বিশেষ নাটক ‘আমাদের বঙ্গমাতা’ প্রদর্শিত হয়েছে।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টাডি সেন্টার, সুইডেনের উপসালা সাহিত্যকেন্দ্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সহযোগিতায় আয়োজিত এই উৎসবে দেশি-বিদেশি কবিদের সঙ্গে এদেশের আদিবাসী ভাষাভাষী কবি ও শিল্পীরা যেমন অংশ নিয়েছেন তেমনি ঢাকার বাইরে থেকে বিশেষ করে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম থেকেও লেখকরা এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন।

উৎসবের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল বাছির। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টাডি সেন্টারের পরিচালক, অধ্যাপক সৌরভ সিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী পর্বে উৎসবের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরে কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছিল। এই আয়োজনে ঢাকাস্থ নরওয়েজিয়ান দূতাবাসের প্রতিনিধি ইউহানে এরিকসেন সালটনেস এবং সুইডিশ দূতাবাসের প্রতিনিধি আনা স্ভান্তেসনও বক্তব্য রাখেন।

উৎসবে প্রদর্শিত আমার রচিত এপিক মনোলোগ ‘আমাদের বঙ্গমাতা’ নির্দেশনা দিয়েছেন দিব্যেন্দু উদাস, অভিনয় করেছেন ঝুমু খান, শব্দ ও সঙ্গীত পরিকল্পনায় মোশাররফ হোসেন টুটুল, আলোক পরিকল্পনায় ঠাণ্ডু রায়হান। সুইডেনের উপলিট থিয়েটার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশের উত্তরীয় থিয়েটার এই নাটকটি প্রযোজনা করেছে।

অংশগ্রহণকারী কবিদের মুধ্যে ক্রিস্টিয়ান কার্লসন, সোহরাব হাসান, সুজন বড়ুয়া, মথুরা ত্রিপুরা, কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, আসলাম সানী, রাশেদ রউফ, নজরুল জাহান, অরুণ শীল, অদ্বৈত মারুত, সুজন হাজং, মাসুদ রানা, মাহমুদ কামাল, মাসুদুজ্জামান, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মালেক মাহমুদ প্রমুখ। উৎসবে সঙ্গীত পরিবেশন করেন চামেলী সিনহা চারু। উৎসবটি উপস্থাপনা করেন আবৃত্তিকার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশিনের অনুষ্ঠান উপস্থাপক আয়শা হক শিমু। এই ছিল উৎসবের মোটাদাগের খবর।

আমি এই খবর ছাপিয়ে এই উৎসবের ছোট একটি পর্ব নিয়ে কথা বলতে চাই। পর্বটির শিরোনাম ছিল , ‘সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ: বর্তমান বিশ্বে স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং বাংলা কবিতা’। এই পর্বটি সঞ্চালনা করেন এবছর প্রবন্ধ শাখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার গ্রহণকারী কবি ও অনুবাদক মাসুদুজ্জামান। এই পর্বে কথা বলার সুযোগ আমিও পেয়েছিলাম। অন্যদের মধ্যে সুইডিশ কবি, অনুবাদক ও প্রকাশক ক্রিস্টিয়ান কার্লসন, মথুরা ত্রিপুরা এবং কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচনায় অংশ নেন। দুই-এক কথায় এই সেমিনার পর্বের সারমর্ম এই বলে তুলে ধরা যায়, ‘সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে অনুবাদের বিকল্প নেই’।

এই সত্য জানার পরও কেবল আমাদের দেশ নয়, দুনিয়ার খুব কম রাষ্ট্রেই সাহিত্যের অনুবাদের পেছনে বড় রকম অর্থ জোগান দেয়া হয়ে থাকে। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনুবাদের ওপর বারবার জোর দেয়া সত্যেও সংশ্লিষ্ট আমলা ও মন্ত্রীরা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেননি। স্বাধীনতার অর্ধশতকেও অনুবাদ নীতি প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অনুবাদের জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ বা লাগসই বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়নি আজও। বাংলা একাডেমির প্রয়াত সভাপতি শামসুজ্জামান খান এই একাডেমির অধীনে বিশ্বমানের একটি অনুবাদ প্রতিষ্ঠান চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার প্রয়াণের মধ্য দিয়ে ওই উদ্যোগটিও থেমে গেছে। ১৯৭০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক একটি অনুবাদ ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেটিও আজকে প্রায় বিলুপ্ত, এর কোনো কার্যক্রম এখন আর দৃশ্যমান নেই। দেশের প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ উদযাপন ঘিরে নানা উদ্যোগ নিলেও অনুবাদ ব্যুরোটি কার্যকর করার ব্যাপারে কোনো টুঁশব্দটিও করল না কেন?

বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের অধীনে তরুণ অনুবাদক গড়ে তোলার যৎসামান্য একটু সুযোগ ছিল। সেই প্রকল্পটিও আর কার্যকর নেই। এখানে উল্লেখ করতে চাই প্রশিক্ষণ দিয়ে লেখক গড়ে তোলা সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ অনুবাদক গড়ে তোলা সম্ভব। এরকম ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে দেশে দেশে।

আমাদের দেশে একটি প্রবণতা খেয়াল করার মতো। একজন মানুষ দুই-এক বাক্য ইংরেজি বলতে পারলেই তাকে আমরা প্রাজ্ঞ-পণ্ডিত বলে সমীহ করতে থাকি, ঠিক যেমন কারও মুখে দুই-একটি আরবি বয়ান শুনে পরহেজগার বুজুর্গান বলে পীর মান্য করতে থাকি। এই একই প্রবণতাবশত দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের অনুবাদ বলতে আমরা ইংরেজি থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে ইংরেজিই বুঝে থাকি। আমাদের অনুবাদের প্রচলন তাই বলে। অন্য ভাষার যেসব লেখাজোখা এবং আমাদের লেখাজোখা ইংরেজি ছাড়া অন্যবিধ ভাষাসমূহে অনুবাদ যা হয়েছে তার প্রায় সবটাই ইংরেজির ওপর ভর করেই হয়েছে। তীর্থযাত্রায় আরবিই যেমন একমাত্র মুক্তির ভাষা নয়, তেমনি জ্ঞান বিজ্ঞান ও অনুবাদে ইংরেজিই একমাত্র অবলম্বন হওয়া সঙ্গত নয়।

এই পর্যায়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে সাহিত্যের অনুবাদ চর্চা নিয়ে দুই-একটি কথা বলে নিতে চাই। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং সুইডেনে বেসরকারি এবং বাণিজ্যিক উদ্যোগ ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক সরকারি নানা পর্যায়ে অনুবাদের জন্যে অর্থকড়ি খরচের বন্দোবস্ত রয়েছে। এই বন্দোবস্তের মধ্যে আর্টস কাউন্সিল, লেখক তহবিল, সুইডিশ একাডেমি, ডেনিশ একাডেমি ছাড়াও স্থানীয় ও আঞ্চলিক সরকারের বাজেটে সংস্কৃতির জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থ ও বৃত্তি বণ্টন ব্যবস্থার মধ্যে অনুবাদও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে থাকে।

সরকারি তরফ থেকে দুনিয়ার নানা প্রান্তের অনুবাদক-প্রকাশক সাহিত্যের বিপণন প্রতিনিধির জন্যে বৃত্তির ব্যবস্থা থাকে। যার আওতায় বইমেলাসহ লেখালেখি ও অনুবাদের নানা কর্মশালা সম্মেলন ও উৎসবে অংশ নেবার সুযোগ অবারিত থাকে।

এসব পৃষ্ঠপোষকতার কারণে নানা প্রান্তের নানা ভাষার ধ্রুপদী ও সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম প্রতিবছর অনূদিত হয়ে থাকে এই অঞ্চলের ভাষাগুলোতে, একই সঙ্গে প্রায় এক কোটি জনগোষ্ঠীর ভাষা সুইডিশ, অর্ধকোটি মানুষের ভাষা নরওয়েজিয়ান এবং ডেনিশ। অথচ এই ভাষাগুলোর সাহিত্যকর্ম দুনিয়ার লেখালেখির দরবারে দাপট ও মর্যাদার আসনটি দখলে রেখেছে ইংরেজি ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণের একমাত্র ত্রাতা মান্য না করেই।

এসব দেশ অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রথমে গুরুত্ব দিয়ে থাকে আঞ্চলিক ভাষাগুলোর সঙ্গে সাহিত্যের বিনিময় বা অনুবাদ কর্মযজ্ঞ অবারিত রাখা। এই জন্যে অনুবাদ কার্যক্রমে বিশেষ করে আর্টস কাউন্সিলের নিয়মিত অর্থবরাদ্দে দুটি স্বতন্ত্র ভাগ চিহ্নিত করে দেয়া আছে। নর্ডিক অঞ্চলের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে আইসল্যান্ড এবং ফিনল্যান্ডসহ এই পাঁচটি দেশের সাহিত্যকর্ম অনুবাদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা আর বাকি দুনিয়ার ভাষাসাহিত্যের জন্যে আলাদা অর্থবরাদ্দের ব্যবস্থা করা আছে।

এর বিপরীতে আমাদের পাশের দেশ নেপাল বা ভারতের ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় রচিত সাহিত্যর সঙ্গে আমরা ইংরেজির মাধ্যমেই পরিচিত হই। আমাদের সাহিত্যের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক বিনিময়ের জন্যে আমাদের পাশের দেশগুলোর ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পারস্পরিক অনুবাদ বিনিময়ের উদ্যোগ থাকলে বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হবার সুযোগ আমাদের সামনে খোলা ছিল। এতে করে আমাদের সাহিত্যের বাণিজ্যিক একটা চাহিদা আমরা কাজে খাটাতে পারতাম বিশেষ করে হিন্দি উর্দু, বার্মিজ, ফার্সি, নেপালি, সিংহলি, তামিলসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে আমাদের অনুবাদ বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করে আমাদের বইয়ের বাজার সৃষ্টি করার সুযোগ থাকলেও জাতি হিসেবে আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি।

আমরা পড়ে আছি সাহেবদের ভাষা নিয়ে। একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া আর ব্রিটেনের সাহেবরা বাঙালির ইংরেজির আদিখ্যেতাকে ধর্তব্যের মধ্যে রাখে না। ইংরেজি সাহেবদের মাতৃভাষা। বাঙালি যতই ফাল পাড়ুক, সাহেবরা আমাদের বাঙাল বা বাঙালিদের সাহেবি স্বীকৃতি কি আদতে দিয়েছে, নাকি দেবে? শিক্ষিত বাঙালির সাহেব হবার এত খায়েশ কেন? বাঙালি থাকতে এত লজ্জা কীসের?

বাঙালি যখন ইংরেজি ইংরেজি করে ঘুর ঘুর করে, পৃথিবীর অনুবাদচর্চা তখন অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে। আমাদের সেই অনুবাদ চর্চা ও দৃষ্টান্তগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। চীন, জাপান, কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের যে কজন লেখক আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন তারা অনুবাদের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিকীকরণের জাহাজে সওয়ার হয়েছেন। তা কেবল ইংরেজিনির্ভর হয়ে নয়।

প্রায় দুই কোটি মানুষের অঞ্চল স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় সাহিত্যের পেশাদার অনুবাদক দুই হাজারের কাছাকাছি। এর বিপরীতে প্রায় বিশ কোটি মানুষের আমাদের দেশে পেশাদার অনুবাদক কয়জন? এমনকি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ তার লেখাজোখা অনুবাদের ক্ষেত্রেও কি যথাযথ পেশাদারি মানদণ্ড সবক্ষেত্রে মান্য করা হয়েছে?

অনুবাদকে পেশাদারি চর্চা এবং বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে কাজে খাটাতে চাইলে প্রথমেই আমাদের একটি আধুনিক জাতীয় অনুবাদ নীতি প্রণয়ন করতে হবে। আর সেই নীতি বাস্তবায়নের জন্য কর্ম অবকাঠামে নির্মাণে উদ্যোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমের অনুবাদ নীতিমালার পাশাপাশি জাপান, শ্রীলঙ্কা এবং কোরিয়ার নীতিমালা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে নিতে পারি।

এই পর্যায়ে চলমান বইমেলা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে লেখাটি শেষ করতে চাই। গোটা দুনিয়ায় বাংলা একাডেমির মতো যত একাডেমি বা সাহিত্য একাডেমি রয়েছে তার বুনিয়াদি ধারণাটি এসেছে ফরাসিদেশের ফরাসি একাডেমি থেকে।

১৬৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ফরাসি একাডেমির আদলে দুনিয়ায় এই ধরনের একাডেমির আবির্ভাব। আমাদের বাংলা একাডেমি ধারণার উৎপত্তিও বোধ করি এখান থেকেই। কেননা এর স্বপ্নদ্রষ্টা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ফরাসিদেশের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা সম্পন্ন করে ফিরে এসে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে যেমন বাংলা ভাষার পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন তেমনি বাংলা একাডেমির স্বপ্ন ও রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। যার ফলে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৫৫ সালে, ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে।

১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত ডেনিশ একাডেমি, ১৭৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সুইডিশ একাডেমি, ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দিল্লির সাহিত্য একাডেমি এবং ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নেপাল একাডেমি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত স্বায়ত্বশাসন অক্ষুণ্ণ রেখে কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলেছে। এসব একাডেমির কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ তো দূরের কথা, একাডেমির কোনো কার্যক্রম নিয়ে সরকারের কোনো আমলার কোনোরকম শব্দটি করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

এদিকে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের বাংলা একাডেমি আমলাকেন্দ্রিক জটিলতায় পড়েছে। বাংলা একাডেমি আইন সংস্কার করে কার্যকর স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিতের পরিবর্তে এটিকে আমলাতন্ত্রের কব্জার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে ধাপে ধাপে। এরকমই একটি চর্চা দৃশ্যমান হয়েছে সম্প্রতি। পত্র-পত্রিকায় খবর এসেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বাংলা একাডেমিকে এবারকার বইমেলার আমন্ত্রণপত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের লোগো ব্যবহার করতে বলার মাধ্যমে। এমন একটি ঘটনা কোম্পানি আমলেও এতটা সহজসাধ্য হতো কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অথচ স্বাধীনতার অর্ধশত বর্ষে এসে এরকম একটি বিপদজনক প্রবণতার মুখোমুখি আমাদের হতে হলো।

এই একাডেমির নির্বাহী পরিষদে সাধারণ সদস্য এবং ফেলোদের প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা থাকলেও এক যুগ ধরে এদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই একাডেমি পরিচালিত হচ্ছে। যার ফলে একাডেমি কার্যত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি অঙ্গীভূত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচালিত হচ্ছে। তারপরও একাডেমির স্বায়ত্বশাসনে এতটা বেপরোয়া হস্তক্ষেপ আগে চোখে পড়েনি। যেমনটা হয়েছে এবার।

এই ঘটনার বিপরীতে লেখকদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়া, বাধা-প্রতিবাদ বা আপত্তি খুব একটা দৃশ্যমান হয়নি। কোনো দেশের লেখকসমাজ যদি মাইজমরা প্রজাতি হয়ে যায়, সেখানে কোনো একাডেমি কি স্বায়ত্বশাসন রক্ষা করতে পারবে? কথা আর না বাড়াই। একটি গল্প বলে লেখার ইতি টানছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে ঢাকার একটি ইংরেজি কাগজে কাজ করার সময়ে খেয়াল করেছি ওই প্রতিষ্ঠানের এক বয়োজ্যেষ্ঠ ফিচার সম্পাদক সামনে এক কথা বলেন, পেছনে বলেন আরেক কথা। উনাকে অফিসের তরুণরা সবাই চাচা বলে সম্বোধনা করতাম। উনি সামনাসামনি খুব মিষ্টি ব্যবহার করতেন আমাদের সকলের সঙ্গেই। কিন্তু পেছনে পেছনে কথা লাগাতেন। এই কথা লাগানোর তিক্ত সাধের মুখে অনেকেই পড়েছে। এর মধ্যে আমাদের এক সহকর্মী কাজী নওশাদও ছিলেন। ঘটনাটি সত্য, নামটি কাল্পনিক। একদিন ইফতারের সময় চাচা নওশাদকে ডেকে ছবক দিচ্ছেন, শুনো ভাতিজা, তোমাকে একটা কথা বলি, মুরুব্বিদের দেখলে সালাম দিতে হয়। কাজী নওশাদের জবাব, ঠিকই কইছেন চাচা, তবে বেয়াদব মুরুব্বিদের নয়।

আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরও নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোতে একটু ছেদ পড়ুক। আমলাতন্ত্র এড়িয়ে বাংলা একাডেমি বেঁচে থাকুক তার তাৎপর্য ও স্বায়ত্বশাসন রক্ষা করে।