১ জুন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বাসা থেকে অফিস আসার সময় রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম, আজ তো সংসদে বাজেট পেশ হবে। বাজেট কেমন হবে বলে মনে করেন? রিকশাচালক প্রচণ্ড গরমে ঘেমে-নেয়ে উঠেছেন। গামছা দিয়ে মুখের ঘাম একটু মুছে বললেন, আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। বাজেট-ফাজেটের আমরা কি বুঝি? আমি আর কিছু না বলে চুপ থাকলাম। কিছু দূর এগিয়ে রিকশাচালক বললেন, বাজেট কে পেশ করবেন, অর্থমন্ত্রীকে নাকি পাওয়া যায় না? এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। মনে হলো রিকশাচালক খোঁজখবর রাখেন। বললাম, অর্থমন্ত্রীকে পাওয়া যায় না মানে?
রিকশাচালক অনেকটা এভাবেই বললেন, কিছুদিন আগে আমার রিকশায় দুই যাত্রী কথা বলছিলেন। তাদের কথায় বুঝলাম, আমাদের অর্থমন্ত্রী নাকি নিয়মিত অফিস করেন না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভায়ও নাকি তিনি উপস্থিত থাকেন না। তার অনুপস্থিতিতেই নাকি কাজকর্ম হয়। রিকশাচালক বললেন এবং জানতে চাইলেন ঘটনা কি সত্যি?
আমি বললাম, হ্যাঁ, এমন খবর একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আজ অর্থমন্ত্রীই বাজেট পেশ করবেন। বাজেট তৈরির ব্যাপারে যে তিনি সক্রিয় ছিলেন, সে খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে।
রিকশাচালক স্বগতোক্তি করে বললেন, মন্ত্রী-মিনিস্টারদের ব্যাপারই আলাদা।
আমি এবার একটু আগ্রহ নিয়ে জানতে চাই, আপনি তো খোঁজখবর জানা লোক। বাজেট নিয়ে কিছু বলবেন না?
তিনি বললেন, বাজেট মানেই তো বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। কোনো কোনো পণ্যের দাম কমার কথা বলা হয়। কিন্তু বাজারে তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় না। তবে যেসব পণ্যের দাম বাড়ার কথা বলা হয়, সেগুলো টের পাওয়া যায় সহজেই।
জিনিসপত্রের দাম নিয়ে রিকশাচালকের বক্তব্য অস্বীকার করা যাবে না।
যা হোক, সংসদে বাজেট পেশ হয়েছে। এটা নিয়ে অনেক কথা হবে। তর্ক-বিতর্ক হবে। তারপর এই বাজেট পাশও হবে।
আমি নিজে অর্থনীতি বা বাজেট নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা রাখি না। আমার বাজেট জ্ঞান ওই রিকশাচালকের মতোই। তারপরও পেশার কারণে কিছু লিখতে হয় বলেই এই লেখা। আমার বিবেচনায় বাজেট হলো সরকারের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা। সরকার সারা বছর কি কি কাজ করতে চায়, সেসব করার জন্য কত ব্যয় হবে এবং সেই অর্থ কোথা থেকে, কীভাবে জোগাড় হবে তা-ই বাজেটে উল্লেখ করা হয়। যাদের নিয়ে সরকার তারা কিন্তু নিজের টাকা দিয়ে দেশের কাজ করেন না। বরং উল্টো তারা কাজের জন্য সরকারি তহবিল থেকে টাকা নেন, মানে বেতন-ভাতা ইত্যাদি না নিলে তাদের জীবন চলে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারের তহবিলটা কোত্থেকে আসে? একটা কথা আছে, লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন? এই গৌরী সেন বাবুর সন্ধান আবার কারও জানা নেই। আসলে দেশের মানুষের খাজনা-ট্যাক্সের পয়সায় তৈরি হয় সরকারি তহবিল। সরকার দেশের বেশি বেশি উন্নয়ন করার জন্য বিদেশ থেকেও ধারকর্জ করে করে থাকে। তবে এই ধারকর্জ কেউ লিল্লাহ বা খয়রাত হিসেবে দেয় না, সুদে-আসলে তা পরিশোধ করতে হয়। এই পরিশোধের দায়ও কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষেরই কাঁধে বর্তায়। দেশে বাস করতে হলে নাগরিকদের খাজনা-ট্যাক্স দিতে হয়। বিনিময়ে দেশপরিচালকরা নাগরিকদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকেন। বিষয়টা ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেলের মতো'। অর্থাৎ আপনি টাকা দেবেন, তারপর সরকার আপনার জন্য রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল ইত্যাদি বানিয়ে দেবে। আপনার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
কিন্তু এটাও ঠিক যে, ট্যাক্স, খাজনা, ভ্যাট ইত্যাদির মাধ্যমে আপনি সরকারি কোষাগারে যা জমা দেন তার সবই আপনি সেবার নামে ফেরত পাওয়ার হকদার। কিন্তু অনেক সময় সরকার তেলা মাথায় একটু বেশি তেল দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে থাকে। এখানে হয়তো যুক্তি এটাই যে, তেলা মাথায় তেল দিতে কম তেল লাগে! যাই হোক, আদায় ও বন্টনে সমতার নীতি অনুসরণ করা না হলে বৈষম্য তৈরি হয়। বৈষম্য আবার সামাজিক অস্থিরতারও সৃষ্টি করে!
আজ পর্যন্ত যত সরকার যত বাজেট দিয়েছে, কোনো বাজেটকেই কি গরিব বাঁচানোর বাজেট বলে কেউ অভিহিত করেছে? যারা সরকারে থেকে বাজেট দেন তারা অবশ্য বাজেটকে গরিবের বাজেট না বললেও সুষম বাজেট বলে দাবি করেন। আবার যারা বিরোধী দলে থাকেন তারা বাজেটকে গরিব মারার বাজেট বলে সমালোচনা করে থাকেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যে বাজেট ১ জুন জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে, এটাও এর বাইরে নয়। বাজেট নিয়ে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তা গতানুগতিক।
২ জুনের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম নিচে উদ্ধৃত করছি, যা থেকে বাজেট সম্পর্কে মোটাদাগে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
প্রথম আলো: বাস্তবতা কম, স্বস্তির চেয়ে চাপ বেশি
বাংলাদেশ প্রতিদিন: ঘাটতি চ্যালেঞ্জে ভোটের বাজেট
আমাদের সময়: শর্ত পূরণ ও চাপের বাজেট
সমকাল: কঠিন সময়ে আরও অস্বস্তি
কালেরকণ্ঠ: বিশেষ সময়ে সাধারণ বাজেট
যুগান্তর: বাজার গরম ঠান্ডা আইএমএফ
আজকের পত্রিকা: মহামারি, যুদ্ধ, এবার বাজেট
কালবেলা: স্বপ্নে মোড়া শর্তে ভরা শঙ্কা ঘেরা
দেশ রূপান্তর: আশার আলো নেই উচ্চাশার অঙ্কে
The daily Star: A budget divorced from reality
TBS: Election budget? Yes and no
এবার বিশিষ্টজনদের উদ্ধৃত করে লেখার ওজন বাড়ানো যাক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম তার বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, তা পূরণ হবে না। বলা হয়েছে, জিডিপির ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগ হবে। এটিকে অবাস্তব বললেও উদার বিশ্লেষণ হবে। এটি একেবারে অসম্ভব। কারণ, কয়েক বছর পর্যন্ত জিডিপির ২২-২৩ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ হয়নি। এর মধ্যে এবার হঠাৎ কীভাবে ২৭ শতাংশ হবে, তা বুঝে আসে না। এখানে দুটি বিষয়। প্রথমত, লক্ষ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ না। দ্বিতীয়ত, বাস্তবায়নের সক্ষমতাও কম। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি উচ্চাভিলাষী। কারণ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্য সংস্থাগুলো লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এটিও অবাস্তব। কারণ, এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। ফলে মূল্যস্ফীতি কমার খুব একটা লক্ষণ দেখছি না।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, আশা করেছিলাম বর্তমান বাস্তবতা জনমানুষের জীবনে যে কষ্ট দিচ্ছে, সেটাকে সুরাহা করার জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ থাকবে। কিন্তু সেই পথনির্দেশ খুঁজে না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ হয়েছি। এবার যে ধরনের রাজস্ব ও ব্যয় কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানেও ওই ধরনের সুচিন্তার প্রতিফলন দেখিনি। অর্থাৎ যে ধারাতে সাধারণভাবে আমাদের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়, সে রকমভাবেই বাড়ছে। এ বছরও পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। এর মানে হলো আগামী অর্থবছরে বাড়তি আয়টুকু আসবে, সেগুলো ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র সবাই মিলেই দেবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে বড় মনোযোগ দেখিনি। উপরন্তু, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দের পরিমাণ অনেক কমেছে।
তিনি মনে করেন, সামষ্টিক অর্থনীতির কাঠামো খুব জোরদার নয়। জিডিপি এবং ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগসহ যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বর্তমানে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে, তা খুব দ্রুত কমবে বলে মনে হয় না। এই মূল্যস্ফীতি কমানোর পথরেখাও বাজেটে নেই।
এবার ভোটের আগের এবং সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট বলে মনে করা হয়েছিল, সরকার জনতুষ্টির কথা ভেবে এমন একটি বাজেট দেবে যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা খুশি হয়। কিন্তু তা হয়নি। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেছেন, “যদি সত্যিকার গণতান্ত্রিক ভোট করে, তাহলে তাকে জনগণকে সন্তুষ্ট করতে হবে, যাতে সে ভোট পায়। আর যদি অর্থ ও পেশিশক্তি দিয়ে ভোট করতে চায়, তাহলে তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে ধনীদের। কারণ, ধনীরা টাকা না দিলে সে নির্বাচনে কোথা থেকে টাকা ছড়াবে? সেখানেই দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের চেয়ে ধনীরাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
এবারের বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ৫ লাখ কোটি টাকা। তার মধ্যে এনবিআর তুলবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মানে ৮৫ শতাংশ আসবে কর থেকে। প্রশ্ন হলো, এই করটা আসবে কোথা থেকে। আমাদের পরামর্শ ছিল, এটি যাতে প্রত্যক্ষ কর সম্পদ কর থেকে তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু রাজস্ব আয়ের যে বিবরণী আমরা দেখলাম, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কতগুলো অদ্ভুত নিয়ম করেছে।
বর্তমানে ৭০ লাখ মানুষের টিআইএন আছে। এর মধ্যে ৩০ লাখ ট্যাক্স দেয়। বাকি প্রায় ৪০ লাখ দেয় না। এখন সরকার বলছে, সবাইকে ট্যাক্স দিতে হবে। টিআইএনধারী মানুষের সংখ্যা ৭০ লাখ। কিন্তু আমরা জানি যে, আয়কর শুধু তারাই দেবে, যাদের আয় করমুক্তসীমার ওপরে। আগে করমুক্ত সীমা ছিল ৩ লাখ টাকা। তার মানে, কেউ যদি মাসে ২৫ হাজার টাকার ওপরে আয় করেন, তাহলে তিনি কর দেবেন। এখন এটি ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। তার মানে, মাসে যদি ৩০ হাজার টাকা আয় করে, তাহলে তাকে কর দিতে হবে। কিন্তু এখন যে ব্যবস্থা করেছে, তাতে কেউ ৩০ হাজার টাকার কম আয় করলেও তাকেও ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। তার মানে, কিছুতেই সে কর জাল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। কিন্তু এ ধরনের মানুষের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা নেওয়ার চেয়ে যে রাঘববোয়ালরা উপরে আছে, অর্থাৎ উপরের ১০ শতাংশ অতি ধনীর কাছ থেকে উচ্চহারে কর নেওয়া উচিত। কিন্তু উল্টো তাদের কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যেমন সম্পদ করের সীমা আগে ৩ কোটি টাকা ছিল, এবার তা ৪ কোটি করা হয়েছে।
তার ফলে এই বাজেটের যে চরিত্রটা দেখা যাচ্ছে, তা হলো, গরিবের কাছ থেকে সমূলে কর আদায় করো আর বড়লোকদের কাছ থেকে তুলনামূলক কম কর আদায় করো। আর চাপ বেশি থাকলে সবাইকে কর দিতে হবে—এই স্লোগান তুলে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাইকে একটা টাকা করের মধ্যে ফেলে দাও। সেই অর্থে এই বাজেট মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে আক্রমণ করেছে বেশি।"
একই সঙ্গে অনেক প্রবল চাপের কারণে অর্থনীতি একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই ঝুঁকিগুলো মোকাবিলার জন্য এই বাজেট উপযুক্ত হয়নি বলে আমি মনে করি। সেটি অবশ্য প্রমাণসাপেক্ষ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই যখন আইএমএফের চাপটা বাড়বে, তখনই কিছুটা বুঝতে পারব—এই বাজেট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সক্ষম হলো?
শেষে বলার কথা এটাই যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বাজেটকে জনবান্ধন বলে উল্লেখ করে এটাকে ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থমন্ত্রীও নানা বিষয়ে মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আশার কথা শুনিয়েছেন। দারিদ্র্য কমবে, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা হবে, কর-জিডিপি অনুপাত উন্নীত হবে, বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ হবে, পেপারলেস, ক্যাশলেস স্মার্ট বাংলাদেশের হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা চাই মানুষকে যেন স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে বাঁচতে না হয়। স্বপ্ন যেন অধরা না থাকে।