মৃত্যুমুখেও বঙ্গবন্ধুর অনন্য সংগ্রাম

পাকিস্তানিরাও একদিকে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছে, আরেক দিকে তার বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে, ভক্তি দেখিয়েছে।

বিপ্লব বড়ুয়াবিপ্লব বড়ুয়া
Published : 17 March 2023, 04:31 AM
Updated : 17 March 2023, 04:31 AM

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সায়েরা খাতুন আর শেখ লুৎফর রহমানের ঘর আলো করে পৃথিবীতে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্লুকোমা নিভিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল যে চোখের জ্যোতি, সেই চোখেই জ্বলে উঠল বাঙালির মুক্তির স্ফুলিঙ্গ। বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত ভগ্নস্বাস্থ্য খোকা বাংলার কাদামাটি দাপিয়ে জীবন দিয়েছেন একটা স্বাধীন দেশের জন্য। সাধারণ বাঙালি ঘরে জন্ম নিয়ে বাংলার বন্ধু রঙিন করে দিয়েছেন বাংলাকে। এই মানুষটি জন্মেছিলেন বলেই হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালি জাতি শত শত বছরের পরাধীনতার গ্লানি ঘুচিয়ে একটি দেশ পেয়েছে। আমরা পেয়েছি সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। আমরা একটি স্বাধীন দেশের গর্বিত সার্বভৌম নাগরিক হতে পেরেছি। আজ জাতির পিতার ১০৩তম জন্মবার্ষিকী।

আমরা যখন ১৭ মার্চের এই শুভ দিনে জাতির পিতাকে স্মরণ করি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়, তার আদর্শ আবারও নতুন করে বুকে ধারণ করি; ঠিক তখনই মনে পড়ে যায় একদল ঘৃণ্য ও পরজীবী মানসিকতার মানুষকে যারা দীর্ঘ একুশ বছর ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির নাম মুখে নিতে দেয়নি। কী লজ্জার বিষয়! অথচ যারা বাঙালির শত্রু, যারা বাংলাদেশের জন্ম রোধ করতে, বাংলাদেশ জন্মের প্রসব বেদনাকে দীর্ঘায়িত করতে আমাদের ওপর নারকীয় গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণ সংহার করেছে, দুই লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করেছে, সেই পাকিস্তানিরাও একদিকে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছে, আরেক দিকে তার বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছে, ভক্তি দেখিয়েছে। এমন এক পাকিস্তানির বর্ণনায় ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উন্নত শিরে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অনন্য সংগ্রাম।

দীর্ঘ দুই যুগের নিপীড়ন, শোষণ; নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বারবার আঘাত; রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চনা– মুক্তির সনদ ৬-দফা বাঙালিকে দিয়েছিল জেগে ওঠার, আদায় করে নেবার প্রেরণা। ১৯৭০-এর নির্বাচন তুঙ্গে তুলেছিল স্বাধীনতার দাবি, বৈধতা দিয়েছিল ধারাবাহিক মুক্তি সংগ্রামের। ৭ই মার্চ– মাহেন্দ্রক্ষণ। এই মাহেন্দ্রক্ষণটি সৃষ্টি করতে বাংলাদেশের স্থপতির সময় লেগেছিল দীর্ঘ ২৩টি বছর। রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের ডাকে সেদিন গর্জে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না’। তারপর ক’দিনের টালবাহানা শেষে ২৫ মার্চের ভয়াল কাল রাত। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। তিনি জানতেন পাকিস্তানিরা তাকে বাঁচতে দেবে না। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবস্থান করছিলেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াননি। তিনি বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কালিমা লেপে দেবার সুযোগ করে দিতে পারেন না। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আমি জানতাম পাকিস্তানি সেনারা আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে। আমি ঘর থেকে বের হলে আমার গাড়িতে গ্রেনেড মেরে আমাকে হত্যা করে তার দায় চাপানো হবে আমার বাঙালির উপর। সেই অজুহাতে তারা আমার মানুষের উপর নির্যাতন চালাবে, হত্যা করবে।’

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু বিবিসির সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি তাঁদের বলেছিলাম, হয়ত এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই তাদের করতে হবে।’ নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে প্রকাশিত নিবন্ধে লিখেছে, ‘২৫ মার্চ রাত ১০:৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে রেকর্ড করা বার্তা পাঠিয়েছিলেন, যে বার্তার মূল বক্তব্য ছিল, আমার যা-ই হোক না কেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলো। এখন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’

নিউ ইয়র্ক টাইমস আরও লিখেছে, ‘রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে একদল সেনা সদস্য ৩২ নম্বরের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। কাছেই মর্টারের গোলার আওয়াজ হয়। সেনারা বাড়ির ভেতর গুলি করতে থাকে, একজন নিরাপত্তাকর্মী সিঁড়িতে তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালে তাকে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় বঙ্গবন্ধু বেড়িয়ে এসে গুলি বন্ধ করতে বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘গুলি করছ কেন? তোমরা যদি আমাকে হত্যা করতে চাও, আমি এখানে, আমাকে গুলি কর, কেন তোমরা আমার লোকদের গুলি করছ?’ এক মেজর তখন তাকে জানালেন যে, তারা তাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন। এরপর তিনি পরিবারের সকলকে কাছে ডেকে প্রত্যেককে চুম্বন করে বললেন, ‘তারা আমাকে হত্যা করতে পারে, আমি তোমাদের আর কখনো নাও দেখতে পারি। কিন্তু আমার মানুষেরা একদিন মুক্ত হবে। আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।’

সেই রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। রাত কাটে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে, বর্তমানে যা শহীদ আনোয়ার স্কুল ও কলেজ। এরপর অত্যন্ত গোপনীয়তায় তাকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় করাচী। করাচী বিমানবন্দরে চেয়ারে বসা বঙ্গবন্ধুর ছবি পরদিন সকল পত্রিকায় ছাপা হয়। ২৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেন, ‘তিনি (শেখ মুজিব) এ দেশের ঐক্য ও সংহতির ওপর আঘাত হেনেছেন– এই অপরাধের শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে’। ১ অগাস্ট তৎকালীন পাকিস্তানের মিত্রদেশ ইরানের কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকার রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর বিচার যে আসন্ন তার ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়, ‘আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এতে সর্বোচ্চ শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড।’ ৮ অগাস্ট ব্রিটেনের সানডে টাইমসকে ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘আজকের পর শেখ মুজিবের জীবনে কি হবে, সে বিষয়ে তিনি ওয়াদা করে কিছু বলতে পারেন না’। ‘মুজিবকে কালই আমি গুলি করছি না’, শিরোনামে এ খবর ছাপায় পত্রিকাটি।

পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর বন্দিদশার বিস্তারিত পাওয়া যায় গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে দ্য ডেইলি পাকিস্তানের সাংবাদিক তাহির মাহমুদ চৌধুরীকে দেয়া রাজা আনার খানের সাক্ষাৎকারে। রাজা আনার খান ছিলেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের (সিআইডি) কর্মকর্তা। ৮৮ বছর বয়স্ক আনার খান বর্তমানে বসবাস করেন রাওয়ালপিন্ডিতে। ১৯৭১ সালে তাকে সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাজিয়ে পাঠানো হয় মিয়ানওয়ালী জেলে। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তার দিনলিপি প্রতিদিন ঊর্ধ্বতন কর্তাদের কাছে পাঠানো ছিল আনার খানের দায়িত্ব। প্রথম দিন তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে জানান যে তিনি তার সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। জানতে চাইলে ‘রাজা খান’ নামে নিজের পরিচয় দিয়ে রাজা আনার খান বঙ্গবন্ধুকে জানান যে, তিনি একটি মেয়েকে অপহরণ মামলায় তিন বছরের সাজা পেয়ে এই জেলে আছেন। সে কথা শুনে বিচক্ষণ বঙ্গবন্ধু আনার খানের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলে বলেছিলেন, ‘এখানে আগেও একজন সাহায্যকারী একই মামলায় সাজা পেয়ে আমার দেখাশোনা করতে এসেছিলেন’। আনার খান পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি, লায়ালপুর এবং শাহিওয়াল জেলে এবং পরে সিহালা রেস্ট হাউসে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন। আনার খান জানান, প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতেন, ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে। তিনি আরও জানান যে বঙ্গবন্ধুকে সলিটারি কনফাইনমেন্টে (কনডেম সেলে) রাখা হতো, সেখানে পত্রিকা এবং রেডিও দেয়া হতো না, তিনি ছাড়া অন্য কোনো বন্দির সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর দেখা হওয়ার বা কথা বলার সুযোগ ছিল না। এমনকি তাকে সূর্যের আলো পর্যন্ত দেখতে দেয়া হতো না।

জেলে নেবার পর ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতাসহ ১২টি অভিযোগ দায়ের করে, যার মধ্যে ৬টির সাজা মৃত্যুদণ্ড। একটি ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অপরাধ। এই মামলা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আনার খানকে বলেছিলেন, ‘আমি একজন সাধারণ মানুষ আর এটা হচ্ছে সামরিক আদালত। সামরিক আদালতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার হতে পারে না।’ তারও কয়েক মাস পর মামলার কার্যক্রম শুরু হলে প্রথম দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের আইনজীবী এ কে ব্রোহীকে বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আনার খান জানান, ‘এ কে ব্রোহী যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলখানায় দেখা করতে আসতেন তখন শুধু তাদের দুজনকে এক সঙ্গে আলোচনা করতে দেয়া হতো না’। আনার খান নিজে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কিছুটা দূরত্বে উপস্থিত থাকতেন। মামলার বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে এ কে ব্রোহীর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ দেয়া হতো না, আনার খান নিজে তা নিশ্চিত করতেন।

মামলায় জনৈক বাঙালি ব্রিগেডিয়ারকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করা হয়। ওই ব্রিগেডিয়ারের আচরণ সন্দেহজনক ছিল। তার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আনার খানকে বলেছিলেন, ‘এর অবস্থা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে, তাকে কোথা থেকে ধরে আনা হয়েছে তা আমি জানি না। তাকে একজন ব্রিগেডিয়ারের মতো দেখায় না।’ মামলা শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন এটা একটা সাজানো নাটক। তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘এই নাটকের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে কোনো ভাবে একটা রায় নিয়ে আমাকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে দেয়া’। তিনি মামলার কার্যক্রম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করেন। সামরিক আদালতকে জানিয়ে দেন যে, তিনি এই মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না, তার আইনজীবীর প্রয়োজন নেই। আদালতের কার্যক্রম চলাকালে বঙ্গবন্ধু বিচারকের দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকতেন। ৪ ডিসেম্বর মামলার বিচারকার্য শেষ হয়। ইয়াহিয়া খান তড়িঘড়ি করে মামলার রায় দিতে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু নিউ ইয়র্ক টাইমসকে আরও বলেছেন, ‘ভুট্টো তাঁকে সিহালা রেস্ট হাউসে জানিয়েছেন যে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তখন ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে বলেছেন, “আমার দুঃখ এই যে আমি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারলাম না। আপনি পূর্ববর্তী তারিখে কাগজপত্র তৈরি করে শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিয়ে দেবেন যাতে সবাই জানতে পারে যে আমিই তাঁর বিচার করেছি”।’

ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের অনুরোধ রাখতে পারেননি। মিত্রবাহিনীর অংশগ্রহণের ফলে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যায়, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং পাকিস্তানের প্রায় ৯০ হাজার সেনা বাংলাদেশে বন্দি হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘এমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে ৯০ হাজার পাকিস্তানির জীবন বিপন্ন হবে, এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে সকল সৈন্যকে হত্যা করা হতে পারে যার প্রতিক্রিয়া পড়বে পশ্চিম পাকিস্তানের (পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যেখান থেকে বেশিরভাগ সেনা বাংলাদেশে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল) রাজনীতিতে অর্থাৎ সদ্য দায়িত্ব নেয়া রাষ্ট্রপতি ও সামরিক শাসনের প্রধান ভুট্টোর ওপর। ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের অনুরোধ রাখতে এত বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে চাননি।’

আনার খান দ্য ডেইলি পাকিস্তানকে জানান, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবার একদিন আগে মিয়ানওয়ালী জেলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, পূর্ব পাকিস্তানে মিয়ানওয়ালীর সন্তান জেনারেল টিক্কা খানকে মেরে ফেলা হয়েছে। এতে জেলের ভেতরে আসামিদের মধ্যে এবং নিচের সারির জেলরক্ষীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে টিক্কা খান হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়; তৈরি হয় ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর সেলে আসার জন্য একটা সিঁড়ি লাগানো হয়েছিল। ষড়যন্ত্রের খবর জেল সুপারের কাছে পৌঁছালে তিনি আনার খানের সহায়তায় শেষ রাতে বঙ্গবন্ধুকে তার সেল থেকে বের করে মিয়ানওয়ালীর ডিএসপি হেডকোয়ার্টারের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে দুই দিন থাকার পর তাকে চশমা ব্যারেজ আবাসিক কলোনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে প্রায় এক সপ্তাহ রাখা হয়। এখান থেকে হেলিকপ্টারে করে তাকে সিহালা রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয় ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার জন্য। ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার সময় আনার খান বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন পর্দার আড়াল থেকে। বঙ্গবন্ধু এবং ভুট্টো ছাড়া তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই ঐতিহাসিক আলোচনার সাক্ষী ছিলেন। এখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আনার খানের শেষ দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু তাকে নিজের ধুমপানের পাইপ এবং কারাগারে রাখা দস্তয়েভস্কির লেখা বিখ্যাত বই, ওয়ার অ্যাণ্ড পানিশমেন্ট উপহার দিয়েছিলেন। বইটির ওপর তিনি নিজ হাতে লিখে দিয়েছিলেন, ‘In the long run lies and truth triumph, untruth prevails, but in the end, truth prevails’. বইটি এখনো তার সংগ্রহে রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে ঢাকায় চলো। তুমি সেখানে আমার এসপি হবে।’

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, সিহালা রেস্ট হাউসে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হলে বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমি মুক্ত কিনা?’ তিনি বলেছেন, ‘যদি আমি মুক্ত হই তবে আমাকে যেতে দাও। যদি না হই, আমি কথা বলতে পারি না।’ ভুট্টো তাকে পাকিস্তানের দুই অংশ এখনো আইন এবং প্রথা অনুযায়ী এক আছে বলে জানান। বঙ্গবন্ধু প্রতি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তা হলে তুমি নও, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আমি’। ৭ জানুয়ারি ভুট্টো তৃতীয় এবং শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে যেতে দাও, দেরি করার আর কোনো সুযোগ নেই। তুমি আমাকে হত্যা করো অথবা যেতে দাও।’ ভুট্টো চলে যেতে যেতে বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখার অনুরোধ করেছিলেন। এর দু-দিন পর পিআইয়ের একটি বিশেষ ফ্লাইটে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সাইপ্রাস, ওমান, দিল্লি হয়ে তিনি ১০ জানুয়ারি স্বাধীন স্বদেশে ফেরেন। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিপূর্ণতা পায়।

আজ বাঙালি ইতিহাসের নির্মাতা সেই মহামানবের জন্মদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।