রোগীদের জিম্মি করে দাবি আদায় অন্যায়

যত যাই হোক, দাবি আদায়ে ডাক্তাররা ধর্মঘট করতে পারবেন না। কখনো শুনেছেন পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের কেউ ধর্মঘট করেছেন? কিন্তু ডাক্তাররা বারবার দাবি আদায়ে ধর্মঘট করেছেন।

প্রভাষ আমিনপ্রভাষ আমিন
Published : 18 July 2023, 05:05 PM
Updated : 18 July 2023, 05:05 PM

এক ডাক্তার বন্ধু একবার আমাকে বললেন, আপনি কিন্তু ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে গ্রামের দিকে কোথাও বেড়ানোর সময় সাবধান থাকবেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, গ্রামে কোথাও যদি কখনো আপনার হার্ট অ্যাটাক ধরনের কোনো সমস্যা হয়, আপনি কোনো চিকিৎসা পাবেন না। আপনি সাংবাদিক এটা জানার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ডাক্তার আপনাকে ঢাকায় রেফার করবেন। কোনো ঝুঁকি নেবেন না। নিজে প্রাথমিক চিকিৎসাটাও দেবেন না। তাতে আপনার মৃত্যুও হতে পারে। অথচ একই সমস্যা সেখানকার কোনো রিকশাওয়ালার হলেও স্থানীয় ডাক্তার তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠাবেন, যাতে তিনি বেঁচে যেতে পারেন। অথচ ডাক্তারদের যে এথিক্স, তাতে যে কোনো রোগীকে চিকিৎসা দেয়াটা তার পেশার অংশ। কিন্তু নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরিবেশ বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। সেটা শুধু ডাক্তারদের ক্ষেত্রে নয়, সব পেশার ক্ষেত্রেই কমবেশি সত্যি।

তবে ডাক্তাররা অন্য সব পেশার চেয়ে আলাদা। মানুষ যখন অসহায় হয়, তখনই ডাক্তারের কাছে যায়। আল্লাহর পরেই ডাক্তারদের ওপর ভরসা। কিন্তু বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষ, হাজারটা সমস্যা। তারপরও ডাক্তাররা যে আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, আমার তো ডাক্তারদের মানুষ নয়, ফেরেশতা মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ফেরেশতার মত ডাক্তার যেমন আছে, তেমনি অর্থলোভী কসাই ডাক্তারেরও অভাব নেই দেশে। কিন্তু ডাক্তারদের আচরণ দেখলে মনে হয়, তারা সবাই ফেরেশতা, কখনো ভুল করেন না। ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালে ঠিকমত রোগী না দেখলেও প্রাইভেট চেম্বারের সামনে বাজার বসে যায়। কিন্তু রোগীদের তারা মনোযোগ দিয়ে দেখেন না। অপ্রয়োজনে গাদা গাদা টেস্ট করান। প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞের কাছে না পাঠিয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখেন। এমন শত অভিযোগ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে। টেস্ট দিলে তারা কমিশন পান, নির্দিষ্ট ওষুধ কোম্পানির কমিশনের টাকা ব্যাংক একাউন্টে চলে যায়, গিফট পৌঁছে যায় বাসায়। এই প্রত্যেকটি অভিযোগের যৌক্তিক জবাব আমি জানি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। আর সবাই শুরুতেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে চান। তাই অল্পসংখ্যক ডাক্তারের চেম্বারের সামনে মধ্যরাত অব্দি মানুষের ভিড়। কিন্তু সেই ডাক্তারও তো মানুষ। একজন ডাক্তারকে চিনি, যিনি রাত দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত রোগী দেখেন। এখন সন্ধ্যা থেকে শুরু করে মধ্যরাতে একশ নম্বর রোগীর প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেয়া কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। টানা ছয় ঘণ্টা রোগী দেখা তো দূরের কথা, আমার পক্ষে তো প্রিয় সিনেমা দেখাও সম্ভব না। পরদিন আবার তাকে সময়মত অফিসে পৌছাতে হয়। ভাবি তিনি ঘুমান কখন? অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দিনের রুটিন শুনে আমারই কান্না পায়। আমার তাদের মানুষ মনে হয় না, দেবতা মনে হয়, ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। মধ্যরাত পর্যন্ত রোগী দেখলেও আমরা গালি দেই, আবার রোগী না দেখে চলে গেলে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করি।

ডাক্তার বেচারারা যাবেন কোথায়? ডাক্তারদের আমার খুব অসহায় মনে হয়। এক ডাক্তার বন্ধু খুব অসহায় কণ্ঠে বললেন, এই যে টেস্ট দিলে আপনারা এত গালিগালাজ করেন। কিন্তু ক্লিনিকগুলো তো আমাদের টার্গেট দিয়ে দেয়। পরপর তিন মাস টার্গেট পূরণ করতে না পারলে আমার চেম্বার ক্যান্সেল হয়ে যাবে। তখন আমি খাবো কি?

সমস্যাটা যতটা না ব্যক্তির, তারচেয়ে বেশি ব্যবস্থার। সরকারি হাসপাতালে তো জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থাই নেই। বেসরকারি হাসপাতালেও নেই। অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালই একেকটা কসাইখানা। ডাক্তাররা সেখানে অসহায় কসাইমাত্র। বাংলাদেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নামে অনেকগুলো মৃত্যু ফাঁদ বা অন্তত পকেট কাটা ঘর আছে। একই টেস্টে একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একেক রিপোর্ট আসবে। আপনি কোনটা বিশ্বাস করবেন? ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নাকি গড় করে রিপোর্ট দেয়। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে মোটামুটি অসুস্থ রোগী গেলেই আইসিইউতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তারপর লাইফ সাপোর্টের নামে স্বজনদের ফতুর বানিয়ে দেয়া হয়। রোগী মারা যাওয়ার পরও লাইফ সাপোর্টে রেখে বিল বাড়ানোর অভিযোগেরও কমতি নেই। টাকার জন্য লাশ আটকে রাখার ঘটনাও আকছারই ঘটে। বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মান নিয়ে এক কোটি প্রশ্ন আছে, সেবা নিয়ে দুই কোটি অভিযোগ আছে। কে জবাব দেবে এই প্রশ্নের, কে ব্যবস্থা নেবে এই অনিয়মের।

ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগে দুই ডাক্তারকে গ্রেপ্তারের ঘটনা নিয়ে এখন সারাদেশে তোলপাড়। সেই ঘটনাটি কিন্তু ঘটেছে সেন্ট্রাল হাসপাতালের মত নামকরা হাসপাতালে। সেন্ট্রাল হাসপাতালেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বাকি ছোটখাটো হাসপাতালে কী হয়, একবার ভাবুন তো। নবজাতকের মৃত্যু, তারপর প্রসূতির মৃত্যু, থানা পুলিশ, গ্রেপ্তার—এত ঘটনার মাস পার হয়নি এখনও। আবারও সেই সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ এসেছে। অভিযোগ আসে, ডাক্তারদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভুল বোঝাবুঝি হয়, ডাক্তাররা জেলে যান। কিন্তু হাসপাতালের মালিকদের কিছুই হয় না।

ভুল চিকিৎসার অভিযোগ কিন্তু প্রায়শই শোনা যায়। ডাক্তারের অদক্ষতায়, অবহেলায়, ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যান; এটা ডাক্তাররাও জানেন। কিন্তু কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করলে বা কাউকে গ্রেপ্তার করলেই সবাই ক্ষেপে যান। যেন ডাক্তাররা সব আইন এবং জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। এটা ঠিক সত্যি সত্যি ভুল চিকিৎসা হয়েছিল কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। সঠিক চিকিৎসার পরও রোগী মারা যেতে পারে। আর কারো মৃত্যুর পর যত সঠিক চিকিৎসাই হোক, ক্ষুব্ধ স্বজনদের কাছে ভুল চিকিৎসা মনে হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে সত্যি সত্যি ভুল চিকিৎসা হলেও ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মামলা করাই যাবে না, গ্রেপ্তার করা যাবে না; এটা তো ঠিক নয়। আদালত হোক, বিএমডিসি হোক; কোথাও না কোথাও ডাক্তারদের ভুলের, অদক্ষতার, অবহেলার প্রতিকার হতেই হবে। ভুল চিকিৎসার অভিযোগের জবাবে ডাক্তাররা বলেন, চিকিৎসাটা ভুল না ঠিক, এটা আপনারা বুঝবেন কীভাবে? এটা ঠিক, আমরা বুঝবো না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো বুঝতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাক্তাররা তো সবকিছুর উর্ধ্বে নন, অন্য গ্রহের মানুষ নন।

তবে আমার কাছে ডাক্তারদের অন্য গ্রহের মানুষই মনে হয়। অনেক বড় বড় বাঘা বাঘা মানুষ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে বসে থাকেন অসহায়ের মত। অসুস্থ অসহায় মানুষ ডাক্তারের কাছে যান বাঁচার আশায়। ডাক্তারদের তখন মানুষ নয়, ফেরেশতা মনে হয়। সব আশা শেষ হয়ে যাওয়া রোগীও ডাক্তারের কাছে যান গভীর আশা নিয়ে, নিশ্চয়ই কোনো অলৌকিক উপায়ে ডাক্তার সাহেব তাদের ভালো করে দেবেন। এই যে আমরা ডাক্তারদের ভিনগ্রহের মানুষ বা ফেরেশতা মনে করি, অন্যরকম মর্যাদা দেই। কিন্তু ডাক্তাররা কিন্তু বারবার প্রমাণ করেন, তারা আমাদের মতই সাধারণ। ক্ষুব্ধ হলে তারাও ট্রাক ড্রাইভারদের মত কর্মবিরতিতে চলে যান। এটা অবিশ্বাস্য। ডাক্তারি পেশা আর দশটা পেশার মত নয়। আপনি তো জেনেশুনেই ডাক্তার হয়েছেন। তাই যত যাই হোক, দাবি আদায়ে ডাক্তাররা ধর্মঘট করতে পারবেন না। কখনো শুনেছেন পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের কেউ ধর্মঘট করেছেন? কিন্তু ডাক্তাররা বারবার দাবি আদায়ে ধর্মঘট করেছেন। বাস্তবতা হলো, আমরা সব পেশার মানুষের মধ্যেই জিম্মি করে দাবি আদায়ের একটি প্রবণতা আছে। দাবিটা ন্যায় না অন্যায়, সেটা বিবেচ্য নয়, আসল বিবেচনা হলো আপনি কত বেশি মানুষকে জিম্মি করতে পারছেন, কত বেশি মানুষকে ভোগাতে পারছেন। যত বেশি মানুষ, তত তাড়াতাড়ি দাবি আদায় হবে। তার মানে আপনি অপরাধী হোন আর না হোন আপনার যদি শক্তিশালী সংগঠন থাকে, আপনি আইনের উর্ধ্বে উঠে যাবেন। আমরা না হয় ভুল চিকিৎসা, ঠিক চিকিৎসা বুঝি না। কিন্তু ডাক্তাররা তো জানেন, কে ভুল করেছেন, কে খামখেয়ালী করেছেন। ডাক্তাররা কি কখনো সেই খামখেয়ালী ডাক্তারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, মানববন্ধন করেছেন? 

অবস্থা যাই হোক, রোগীদের জিম্মি করার অধিকার ডাক্তারদের নেই। এবারও ডাক্তাররা ধর্মঘট করে দাবি আদায় করেছেন। একমাসেরও বেশি সময় পর জামিন পেয়েছেন সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসক। তার মানে আইন নিজের গতিতে চলেনি। ডাক্তাররা রোগীদের জিম্মি করে আইনের গতি দ্রুততর করেছেন। ডাক্তাররা আইনের উর্ধ্বে নন, এটা যেমন সত্যি। আবার অভিযোগ এলেই ডাক্তারদের গ্রেপ্তার করে ফেলাটাও কোনো কাজের কথা নয়। মাথায় গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিয়ে কোনো ডাক্তারই ঠিকমত চিকিৎসা সেবা দিতে পারবেন না। তাই বিএমডিসিকে ঠুঁটো জগন্নাথ থেকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। সংক্ষুব্ধ মানুষের অভিযোগের প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সঠিক তদন্তের পরই কেবল গ্রেপ্তারের মত কঠোর ব্যবস্থায় যেতে হবে।

আমরা কোনো ডাক্তারকেই অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করতে চাই না। আমরা তাদের জীবন রক্ষাকারী ফেরেশতার আসনেই দেখতে চাই। দেশে খারাপ সাংবাদিক যেমন আছে, অসৎ পুলিশ যেমন আছে; অদক্ষ ডাক্তারও আছে। তবে সাংবাদিক খারাপ হলে মান যায়, ডাক্তার খারাপ হলে জান যায়। এটা সত্যি সব পেশাতেই খারাপের সংখ্যা কম, ভালোর সংখ্যাই বেশি। খারাপ ডাক্তার বেশি হলে এতদিনে আমরা সব মরে সাফ হয়ে যেতাম। অদক্ষ ডাক্তার আছে, মাঝে মাঝে তাদের ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারা যায়, এই সত্যিটা মেনে নিয়ে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। কিছু হলেই একসঙ্গে মিলে দোষীদের রক্ষা করতে রোগীদের জিম্মি করা কোনো কাজের কথা নয়।