রাজধানীসহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তত ২১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাংগুলোকে মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
Published : 17 Apr 2024, 04:28 PM
‘নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ।’
যিনি এই লেখাটি পড়ছেন, তার বয়স যদি উনিশের বেশি হয়, তার মানে তিনিও একসময় কিশোর/কিশোরী ছিলেন। কৈশোর মানে ১৩ থেকে ১৯। কৈশোর মানে তারুণ্যের হাতেখড়ি। কৈশোর মানে উন্মাদনা। বাবা মায়ের শাসন না মানার ঔদ্ধত্য। কৈশোর মানে নতুন কিছু করে দেখানো এবং কৈশোর পার হয়ে আসা মানুষদের দেখে তাদের মতো হতে শেখা। কৈশোর মানে একটি নতুন জীবনের উদ্বোধন। কৈশোর মানে পরবর্তী জীবনের ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’।
বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা আমাদের কলেজ জীবনে ঝালকাঠি শহরে ‘সন্ধানী ডোনার ক্লাব’ করতাম। পাড়ায়-মহল্লায় স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি করতাম। প্রতিটি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় গিয়ে একটি স্লোগান দিতাম: ‘আপনার ১৮ বছর বয়স উদযাপন হোক এক ব্যাগ রক্তদানের মধ্য দিয়ে’।
গত শতাব্দীর শেষ দিকে আমাদের ওই কার্যক্রম দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল ঝালকাঠি জেলা শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত এলাকায়। অসংখ্য তরুণ আমাদের ওই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। আমরা দেখেছি কৈশোরের শক্তি। আমরা দেখেছি কীভাবে বিপন্ন মানুষের পাশে তরুণরা কোনো ধরনের বিনিময় ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু আমরা এও দেখেছি, এই তরুণরাই কীভাবে স্বেচ্ছাশ্রম থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রিন আর মোটর সাইকেলের সিটে বসে তারুণ্যের অপচয় করেন।
এখন ‘কিশোর’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে হয় এর পরের শব্দটিই বোধ হয় ‘গ্যাং’। পত্রিকার পাতায়, অনলাইন পোর্টালের খবর আর টেলিভিশনের পর্দায় ‘কিশোর গ্যাং’ এখন নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম। কীভাবে আমাদের কিশোররা ‘গ্যাং’ হয়ে যাচ্ছে; কীভাবে আমাদের চোখের সামনে একটি বিপজ্জনক প্রজন্ম গড়ে উঠছে— তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর উত্তরায় আদনান কবির নামে ১৪ বছরের এক কিশোর খুন হন তার সমবয়সীদের হাতে। পেশাদার খুনির মতো নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালে নতুন মডেলের মোটর সাইকেল কিনে দেয়ার বায়না পূরণ না করায় বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন ফারহিন মুগ্ধ নামে এক কিশোর। ঘটনাটি ঘরে ফরিদপুরে। তারও আগের বছর ২০১৫ সালে রাজধানীর এজিবি কলোনিতে বখাটে তরুণদের বেপরোয়া মোটরবাইকের চাপায় নিহত হন এক কর্মজীবী নারী। একসময় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ডা. এইচ বি এম ইকবালের ভাইয়ের ছেলে ফারিজ রহমানের কথাও হয়তো আপনার মনে আছে— যিনি রাজধানীর গুলশানে প্রাইভেটকার চাপা দিয়ে একজন রিকশাচালকসহ আরও কয়েকজনকে যে আহত করেছিলেন। বরগুনায় নয়ন বন্ড নামে এক তরুণ তার গ্রুপ নিয়ে জনসম্মুখে রিফাত শরিফ নামে আরেক তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করেন। এই ঘটনায় ১১ কিশোরকে কারাদণ্ড দিয়ে বরগুনার আদালত বলেছিলেন, ‘সারাদেশে কিশোর অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। গডফাদাররা এই কিশোরদের ব্যবহার করছে।’
সম্প্রতি চট্টগ্রামে কোরবান আলী নামে এক চিকিৎসক খুন হওয়ার পরে নতুন করে কিশোর গ্যাং ইস্যুটি সামনে এসেছে। ছেলেকে কিশোর গ্যাংয়ের হামলা থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ওই চিকিৎসক।
এর আগের মাসেই একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল: ‘রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবরে সক্রিয় ১২ কিশোর গ্যাং।’ খবরে বলা হয়, এই দুই এলাকার সাধারণ মানুষ অন্তত ১২টি কিশোর গ্যাংয়ের কাছে জিম্মি। তাদের উৎপাত এতটাই বেড়েছে যে সাধারণ মানুষ রাস্তায় একা চলতে ভয় পায়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, র্যাব কার্যালয়ের ৫০০ গজের ভেতরেই কিশোর গ্যাং চক্র সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া। বসিলা থেকে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত রাস্তাটিতে সবসময় চলে ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম। চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, বসিলা চল্লিশ ফিট, কাঁটাসুর ও ঢাকা উদ্যান এলাকাজুড়ে ধারালো দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রতিদিনই চলে কিশোর গ্যাংয়ের মহড়া। এই এলাকায় প্রতিদিনই দোকান, বাড়িঘর কিংবা কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে হামলা করছে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। পুরো এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রের মহড়া দিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে ভূমি দখলের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব বিপথগামী কিশোর। আর এর সুবিধা নিচ্ছে প্রভাবশালী এলাকার কিছু অসৎ ব্যক্তি।
যে বয়সে ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে কিংবা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকার কথা, ওই বয়সে কিশোরদের একটি অংশ কেন ‘গ্যাং কালচারে’ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে? বয়স ২০ হওয়ার আগেই তারা কীভাবে অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠছে? কারা তাদের মন ও মনন থেকে কৈশোরের সরলতা খেয়ে ফেলে তাদেরকে বয়সের চেয়েও বয়সী বানিয়ে দিচ্ছে? কোন প্রক্রিয়ায়, কোন স্বার্থে?
এই কিশোরদের জন্য কী ধরনের পারিবারিক কাঠামো, কী ধরনের সমাজ, কী ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে? এই কিশোরদের সামনে কাদেরকে ‘আদর্শ’ হিসেবে দাঁড় করানো যাচ্ছে, যাদেরকে দেখে তারা অনুপ্রাণিত হবে? কারা তাদের মডেল? তারা কী হতে চায়? এইম ইন লাইফ কী? সে কি বিসিএস ক্যাডার হতে চায়? সে কি বড় ব্যবসায়ী হতে চায়? সে কি যেকোনো উপায়ে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হতে চায়? সে কি বিজ্ঞানী হতে চায়? শিক্ষক হতে চায়? সাংবাদিক হতে চায়? নাকি সে রাজনীতি করতে চায়? তার সামনে কোন পথগুলো খোলা আছে?
কিশোর সন্তানটি যে গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে যাচ্ছে— ওই খবর বাবা মা রাখেন? অঞ্জন দত্তের একটি বিখ্যাত গান—
‘সাবধান মিসেস মুখার্জী একটু ভেবে দেখবেন
মেয়েটি আপনার হচ্ছে বড় সে তো নয় ফাউন্টেন পেন
আগলে আগলে রেখে আঁচলের তলায় ধরে রাখা যায় না সময়
চোখে চোখে রাখা মানে কিন্তু মনে ধরে রাখা নয়।’
এখানে মেয়ের স্থলে ছেলে পড়লেও অসুবিধা নেই। অর্থাৎ চোখে চোখে রাখলেই যে সন্তানের মনের খবর জানা যায় তা নয়। কেননা ‘জামার মাপটা তার জানেন ভালোই মনের খবর কী রাখেন?’ সন্তানের মনের ভেতরে কী খেলা করে, সেটি বুঝতে ও জানতে না পারলে; সে মোবাইল ফোনে কী দেখে; কাদের সাথে বন্ধুত্ব করে; কোথায় যায় সেটি কজন জানেন? বায়না করেছে বলে মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছেন, কারণ না দিলে জেদ করবে, চিৎকার করবে, সেই ভয়ে কিংবা সামাজিকভাবে নিজের অর্থবিত্তের গরম দেখানোর জন্যও অনেক সময় অভিভাবকরা কিশোর সন্তানকে মোটর সাইকেল কিনে দেন কিন্তু সেই মোটর সাইকেল নিয়ে সে যে পাড়ার বড় ভাইয়ের ফরমাশ খাটে এবং নিজেও মনে মনে বড় ভাই হওয়ার স্বপ্ন দেখে— ওই খবর কতজন বাবা মা রাখেন?
অতএব সন্তান যদি বখে যায়, সে যদি কিশোর গ্যাংয়র সদস্য হয়ে যায়, বাবা মা তার দায় এড়াতে পারেন কিনা, সেটি বিরাট প্রশ্ন। সন্তান বায়না করেছে বলেই মোটরসাইকেল কিনে দিলেন, অথচ ওই মোটরসাইকেল নিয়ে সে কী করে কোথায় যায়, কার পেছনে ঘোরে, কাদের সঙ্গে মেশে— কোনো খবর রাখলেন না; সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ কানে এসেছে, সেগুলো আমলে নিলেন না বরং আপনার সন্তানকে পাড়ার লোকেরা ভয় পায়, সমীহ করে বলে ভেতরে ভেতরে শ্লাঘা বোধ করেন; সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ বোধ করেন— এমন অভিভাবকের সংখ্যাও কম নয়।
যেসব কারণে এবং যে প্রক্রিয়ায় একজন সাধারণ কিশোর বা তরুণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং কিশোর গ্যাং তৈরি হয়, নির্মোহ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, সেখানে মূল ভূমিকা পালন করে রাজনীতি। এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক বড় ভাইরা তাদের ছোট ভাইদের দিয়ে নানান ফরমাশ খাটান এবং তাদেরকে ধীরে ধীরে ক্ষমতার বলয়ে নিয়ে আসেন। সেই ক্ষমতা চর্চার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে মোটরসাইকেল— যা কিশোরদের কিনে দিতে বাধ্য হন তাদের অভিভাবকরাই।
কিশোর গ্যাংগুলো গড়ে ওঠে মূলত ওয়ার্ড কাউন্সিলদের (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) প্রত্যক্ষ মদদে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, রাজধানীসহ সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তত ২১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাংগুলোকে মদদ দেয়ার অভিযোগ আছে— যারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ডিশ ব্যবসা, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, নির্মাণ কাজে চাঁদাবাজি, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তোলা, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। প্রতিটি গ্যাংয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল থাকে— যাদের চলাচল ও কার্যক্রমের মূল বাহন মোটরসাইকেল। এরা সাধারণত দলবদ্ধ হয়েই চলাফেরা করে।
অভিযোগ আছে, অনেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারাই কিশোরদের অস্ত্র দেন। কিশোর গ্যাং সদস্যরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজেরাও স্বাধীনভাবে নানাবিধ অপরাধ করে। কোনো একটি অপরাধ করে তার বিনিময়ে টাকা পাওয়ার পাশাপাশি আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়া এবং আইনের আওতায় না আসায় কিশোররা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। তারা ধরেই নেয়, রাজনৈতিক বড় ভাইরা তাদেরকে যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রশ্রয় দেবেন। পুলিশ তাদের ধরলেও বড় ভাইরা ছাড়িয়ে আনবেন। এভাবে তাদের মধ্যেও একদিন রাজনৈতিক বড় ভাই হওয়ার স্বপ্ন তৈরি হয়। ফলে তারা সহজে আর এই পথ থেকে বের হতে পারে না। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যায় যে, বাবা-মাও তাদেরকে আর এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন না। অনেক সময় বাবা-মা তাদের আক্রমণেরও শিকার হন।
অথচ এই কিশোরদের একটি বিরাট অংশই নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে দেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব অহিংস আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ওই আন্দোলনের ফলে দেশের সড়ক কতটুকু নিরাপদ হয়েছে, ওই তর্কে না গিয়েও বলা যায়, ওই আন্দোলন দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, নীতি-নির্ধারকদের মনেও বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছিল। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদেরও তারা গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করেছিলেন। এটাই কৈশোর ও তারুণ্যের শক্তি। আমরা তারুণ্যের এই শক্তিটাই দেখতে চাই। গ্যাংয়ের শক্তি নয়।
কিন্তু মুশকিল হলো, আধিপত্যবাদী রাজনীতির ধর্মই হলো সে সবসময় প্রতিপক্ষের আক্রমণের ভয়ে থাকে। সে সবসময় নিজের ক্ষমতা ও চেয়ার হারানোর ভয়ে থাকে। ফলে সে সবসময় নিজেদের ক্ষমতার প্রদর্শন করতে চায়। চারপাশে নিরাপদ বলয় গড়ে তুলতে চায়। সবসময় দেখাতে চায় সে অনেক ক্ষমতাবান। সে যখন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হয়, তার সামনে পেছনে একশ মোটরসাইকেল থাকে— যাতে লোকেরা বোঝে যে গাড়ির ভেতরে যিনি বসে আছেন তিনি অনেক ক্ষমতাবান। ফলে তাদেরকে গ্যাং তৈরি করতে হয়। পুষতে হয়। অতএব রাজনীতি ঠিক না হলে কিশোরদের গ্যাং নির্মূল করা কঠিন। সেজন্য প্রধানত সতর্ক থাকতে হবে অভিভাবকদের। জামার মাপটা জানার পাশাপাশি সন্তানের মনের খবরটা রাখতে পারলেও পরিস্থিতির অনেকখানি উন্নতি ঘটানো সম্ভব।