মগজহীন মানুষ ও বিদ্বেষ

আমাদের দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনগুলোতে পাঠকদের অভিমত দেখলেই বোঝা যায়, আমরা কতটা রুচি ও চিন্তার দুর্ভিক্ষে বসবাস করছি।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 4 Feb 2023, 05:15 PM
Updated : 4 Feb 2023, 05:15 PM

একথা ঠিক যে, অর্থ, বিত্ত, ভোগ, যন্ত্রপ্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা দিন দিন উন্নতি করছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দেশের মানুষের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বাড়ছে, বাড়ছে যেকোনো বিষয় সম্পর্কে জানার ‍সুযোগ। কিন্তু মেধা, মনন, চিন্তা, আচরণ, মন-মানসিকতায় দিন দিন আমরা যেন পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের কথা-বার্তা-আচরণে রুচি ও উন্নতির চিহ্নমাত্র নেই। যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেক-বিচারের পরিবর্তে ক্রমেই আমরা যেন কে কত রক্ষণশীল, সংকীর্ণমনা, স্থূল মনমানসিকতার প্রকাশ ঘটাতে পারি– তারই প্রতিযোগিতা করছি। মানবিকতা, সহানুভূতি, সততা, জীবনবোধ, যুক্তি-বুদ্ধি-বিজ্ঞানকে বিসর্জন দিয়ে আমরা মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার চর্চা করছি। আমাদের সামষ্টিক স্থূল ও পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটাচ্ছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এখন বিভিন্ন গণমাধ্যমের একটি অনলাইন ভার্সন থাকে। সেখানে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা ও খবরের নিচে পাঠকের মত বা মন্তব্য প্রকাশিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে মূল খবর বা লেখার চেয়ে পাঠকের মন্তব্যগুলো হয়ে ওঠে অনেক আকর্ষণীয়। সেখানে পাঠকের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনার প্রতিফলন থাকে। অনেক গঠনমূলক সমালোচনাও থাকে। এসব দেখে একটা জাতির চিন্তা ও রুচি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনগুলোতে পাঠকদের অভিমত দেখলেই বোঝা যায়, আমরা কতটা রুচি ও চিন্তার দুর্ভিক্ষে বসবাস করছি। আমাদের দেশে বেশিরভাগ খবর ও বিশ্লেষণমূলক লেখার নিচেই থাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ, নিন্দা, সমালোচনা, গালিগালাজ। অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মত-মন্তব্য লক্ষ করা যায়। এসব নিয়ে আমরা জাতিগতভাবেই যেন দিন দিন দিন যুক্তিহীন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। ‘কাঠমোল্লা’-র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেশিরভাগ মন্তব্যকারী হাজির হয়। কারও কোনো মন্তব্যে যুক্তি-বুদ্ধি-রুচির লেশমাত্র থাকে না। কেউ যদি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে যুক্তিপূর্ণ কোনো মন্তব্য করেন, তাহলে বাকি সবাই মিলে তাকে যেন পিষে ফেলতে চায়। এ এক আশ্চর্য অন্ধকার যাত্রা! অথচ বিষয়টি নিয়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।

আজকাল এই শ্রেণিটির কাছে চারটি শব্দ খুব অপছন্দের। ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নারী স্বাধীনতা ও বুদ্ধিজীবী। ওই লোকটিকে আমার পছন্দ নয়, কারণ লোকটি ধর্মনিরপেক্ষ। ওই মানুষটি খুবই জঘন্য কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই জাতিকে ভাগ করার অপপ্রয়াস। ওটা একটি বিশেষ দলের স্বার্থ হাসিলের বুলি। আমরা কোনো বিশেষ চেতনা-ফেতনার ধার ধারি না। ওই মানুষটি আসলে খারাপ, কারণ তিনি বুদ্ধিজীবী। আর নারী স্বাধীনতার কথা বললে তো সবাই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। যেন পর্দা করা ছাড়া সমাজে নারীর আর কোনো ভূমিকা নেই। সমাজের এই অংশের উচ্চকিত তর্জন-গর্জন হাসি-ঠাট্টা-কটাক্ষ শুনলে মনে হবে, ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া বোধহয় সাংঘাতিক অপরাধ। আইনত দণ্ডনীয়। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা বা বুদ্ধিজীবী হওয়া, নারী স্বাধীনতার কথা বলা আরও খারাপ কাজ। এই অংশটির বিশ্বাস, এদেশের মানুষের প্রথম এবং একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত সে একজন মুসলিম। ধর্মনিরপেক্ষতার মানে হচ্ছে ধর্মচ্যূত হওয়া। একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে তোষণ করা।

সমস্যা হলো, ঠিক যে চারটি শব্দকে ঘিরে এই বিশেষ অংশের মানুষের সমস্যা, সেই ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং বুদ্ধিজীবী হওয়াটা আসলে খুব কঠিন। আর কে না জানে যেটা আমাদের চিন্তাধারায় অর্জন করা খুব কঠিন, যা আমাদের অধরা, যে অবস্থান আমাদের মানসিক গঠনের উপলব্ধির বাইরে, সেটা সম্পর্কে আমাদের একটা রাগ তৈরি হয়। তাই সেটাকে খারাপ প্রতিপন্ন করতে চাই। ধর্মনিরপেক্ষ হতে গেলে স্রেফ ধর্মের কারণে একজন ব্যক্তিকে শত্রু ভেবে নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে বহু সর্বনাশ করেছে এমন অনেক মানুষ, আত্মীয়, স্বজন, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অফিস, কর্মস্থলে আছে, যারা কিন্তু আমাদেরই নিজের ধর্মসম্প্রদায়। তারা আমারই ধর্মের, অথচ তাদের জন্য আমাদের জীবন হয়তো দুর্বিষহ হয়েছে। আবার বহু উপকারও করেছে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা ভিন্ন সম্প্রদায়ের। একজন মানুষ খারাপ হতেই পারে। কিন্তু একই ধর্ম বা সম্প্রদায়ের সব মানুষ কখনও খারাপ হয় না। ভালোও হয় না।

যে শব্দটি সংবিধানের অন্তর্গত, সেই ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটিকে প্রায় গালাগালির পর্যায়ে নামিয়ে আনা হচ্ছে কেন? এর প্রকৃত ডিজাইনটি কী? উদ্দেশ্য কী? যারা বুদ্ধিজীবী শব্দটিকে অপছন্দ করে, তারা ধরেই নেয় বুদ্ধিজীবী শব্দটির মানে হলো ওই যেসব বিখ্যাত ব্যক্তি আমার পছন্দের দলের বিরোধিতা করছেন, আমার প্রিয় নেতানেত্রীকে আক্রমণ করছেন, আমার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক অবস্থানের দলটির ছাতার তলায় এসে জড়ো হয়েছেন, তারাই। আসলে কি তাই? মোটেই নয়। এরা বুদ্ধিজীবী হতেও পারেন, নাও পারেন। আমার মুখটা টিভি অথবা সিনেমা কিংবা অনুষ্ঠানের বদান্যতায় জনসমাজে পরিচিত মানেই আমি বুদ্ধিজীবী– তা হয় না।

বুদ্ধিজীবী মানে একঝাঁক কবি, সাহিত্যিক, সিনেমা স্টার, সেলেব্রিটি মোটেই নয়। তারা তো সামান্য কয়েকজন! একজন সম্পূর্ণ আড়ালে থাকা, নিজের মনে নিজের সংসারধর্ম, পেশায় থেকে জীবন প্রতিপালন করা মানুষও বুদ্ধিজীবী হতে পারেন। বুদ্ধিজীবী শব্দটির প্রথমাংশ ইন্টেলেক্ট। অর্থাৎ শানিত বুদ্ধি। বুদ্ধিজীবী তারাই, যারা নিজের বুদ্ধি দিয়ে সামাজিক ঘটনাক্রমকে বিশ্লেষণ করেন, অবস্থান গ্রহণ করেন। ইন্টেলেক্ট বাড়ানো যাবে কীভাবে? সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীনভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করা এবং পড়াশোনা করা। বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী সব ধরনের পড়াশোনা। নিছক সোশ্যাল মিডিয়ার শিক্ষা নয়। যা আমার কাছে শেয়ার করা হচ্ছে সেগুলি ভেরিফাই করা, ক্রস চেক করা যে, সত্যিই এই ফরওয়ার্ড করা মেসেজ ঠিক তো? নাকি আমাকে বোকা বানানো হচ্ছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে? আমার অধীত বিদ্যা, আমার মধ্যে থাকা পূর্বপুরুষের ডিএনএ, জিন, আমার শিক্ষা, আমার সংস্কৃতিচর্চা, সমস্ত কিছুর মিশ্রণ দিয়ে, আমি স্থির করব কোনো একটি সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনায় আমার অবস্থান কী হবে। অন্য কেউ স্থির করে দেবেন না আমার অবস্থান। দল অথবা সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ভালো? নাকি খারাপ? এটা আমি দেখেশুনে উপলব্ধি করে বিচার করব। আমার দল একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অতএব সেটি ভালো হতে বাধ্য– এরকম বুদ্ধিহীন, চিন্তাহীন জীবনযাপন নিজেরই অসম্মান নয়?

বুদ্ধিজীবী হতে গেলে কবিতা লিখতে হবে না, সিনেমা করতে হবে না, দার্শনিক ভাষণ দিতে হবে না। শুধু নিজের সিদ্ধান্ত নিজের বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে নিলেই হবে। আমার বিপরীত মতামত যার, সেই লোকটি বোকা এবং শত্রুপক্ষের– এই মনোভাব থেকেও দূরে থাকার শক্তি অর্জন করা।

এই যে নিজের বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে অবস্থান গ্রহণ করা, এটাই সবথেকে কঠিন। আর এটাই বুদ্ধিজীবী হওয়ার প্রথম ধাপ। তাই কে সেলেব্রিটি আর কে সেলেব্রিটি নয়, সেটা দিয়ে বুদ্ধিজীবী হওয়া মোটেই নির্ভর করে না। অত্যন্ত সাধারণ মানুষ যদি কোনো দলদাস না হন, প্রতিটি ঘটনাকেই পৃথক পৃথকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করেন, তা হলে তিনিও কিন্তু একজন বুদ্ধিজীবী। সমস্যা হল, যারা বুদ্ধিজীবী শব্দটিকে ঘৃণা করে, তারা আসলে চিন্তার শক্তিকেই ঘৃণা করে এবং ভয় পায়। তারা কোনো একটি বিশেষ দল বা নেতানেত্রীর ভক্ত হয় এবং তারা নিজেরাই যদি লক্ষ করে, দেখতে পাবে, তারা আসলে কোনো বিশেষ সিদ্ধান্তের সমর্থক নয়। তাদের প্রিয় দল বা নেতানেত্রী যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সেটাই তাদের সমর্থন পায়। তারা অযথা ওই সিদ্ধান্তটির পক্ষে নানারকম যুক্তিতর্ক দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করে। তারা এটা ভুলে যায় যে তার প্রিয় দল বা সরকারের নেওয়া ওই সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষের জন্য ভালোই হোক অথবা খারাপ হোক, তারা সমর্থন করবেই। কারণ, তাদের প্রিয় দল ও নেতা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আসলে যাদের নিজের বুদ্ধি নেই, তারা বুদ্ধিজীবী শব্দটিকে ভয় পায়। আর সে জন্যই বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা-কটাক্ষ করে। যাদের রক্তে রাজাকার ও পাকিস্তানের প্রেতাত্মা এখনও বিরাজমান, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা শুনলে ক্ষুব্ধ হয়। যারা প্রতিনিয়িত সাম্প্রদায়িকতার চর্চা ও লালন করে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শুনলে তাদের গাত্রদাহ হয়। এদের কাছে যুক্তি-বুদ্ধি-বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মবিশ্বাস বড়।

এই শ্রেণির কাছে নারীও হচ্ছেন শত্রুপক্ষ। নারীর একমাত্র কাজ হচ্ছে ‘শালীন’ হওয়া, অন্তপুরে থাকা। স্বামী-সন্তানের সেবা ও মনোরঞ্জন করা। এই শ্রেণির কাছে নারীর নির্যাতিত হওয়ার দায় নারীরই। আর এই শ্রেণির জোরালো মত হচ্ছে, নারীর চেয়ে পুরুষরা সমাজে নির্যাতিত হয় বেশি। সমাজে দ্রুত পুরুষ নির্যাতন আইন চালু করা উচিত। আজ সমাজে এমন ভাবনা লালনকারী মানুষের সংখ্যা ভয়বাহরকম বেড়ে গেছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তো বটেই, সিনেমায়, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, প্রশাসনে, রাজনীতিতে, সাংবাদিকতায়, শিক্ষায়-সবখানেই এখন যুক্তি-বুদ্ধি-মগজহীন ধর্মমোহে আচ্ছন্ন উগ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের আগামীদিনের বিপদটা সম্ভবত সেখানেই।