লালন আমাদের কেন প্রয়োজন?

আমাদের রাজনীতি হবে, সেইসঙ্গে অন্য অনেক নীতিও থাকবে। তবে সেইসব নীতিতে লালনকে উপেক্ষা করলে আমরা আর আমরা থাকি না। আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রয়োজনে, আমাদের অস্তিত্বের নিশানায় লালনের বড় প্রয়োজন।

আনিসুর রহমানআনিসুর রহমান
Published : 22 Sept 2022, 01:55 PM
Updated : 22 Sept 2022, 01:55 PM

জীবন দুনিয়ার বড় পাঠশালা। সেই পাঠশালার শিক্ষার্থী ধরাধামের সকলে। তবে কাল জয় করে এই পাঠশালার পাঠ বিরল কিছু মানুষকে মনীষীর আসনে বসায়। আমাদের লালন ফকির ছিলেন এরকম একজন বিরল মানুষ। যিনি মনীষী, দার্শনিক আর কবি। তার জীবনের বহুল পঠিত ও বোধগম্য গল্পটা আমরা প্রায় সকলেই কম আর বেশি জানি। যাকে তীর্থযাত্রায় সঙ্গীরা মৃত ভেবে নদীতে ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছিল। শেষে সেই মৃত ঘোষিত লালন ভাসতে ভাসতে ভাটি পারের এক তীরে ভিড়েছিল।  হিন্দু মায়ের পুত এক মুসলমানের সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে বেঁচে উঠেছিল। মৃত ঘোষিত সেই লালন বেঁচেছিলেন ১১৭ বছর। সারাজীবনে তিনি বেঁচেছিলেন ‘না হিন্দু’, ‘না মুসলমান’ মায়ের পুত হিসেবে। তিনি বেঁচে থাকলেন একজন ‘মানুষ মা’য়ের পুত বা মানবসন্তান হিসেবে।

ঋতুর পালাবদলের মতো গাছের পাতা ঝরে, পাতা ধরে, ফুল ঝরে আর ফুল ফোটে। ধরে ফল। সেই ফল হয় পরিপক্ক। লালনের জীবন ছিল বৃক্ষসম। তিনি স্থির ছিলেন মননে, চলনে ছিলেন গতিশীল এবং পরিশীলিত। জীবনের সকল অনুষঙ্গের সহজিয়া অবলম্বন আর দর্শন দেখিয়ে দিয়ে গেছেন নিজের কথা ও জীবনাচরণে।

লালনকে একজন আধুনিক বাঙালি মানসের ধর্মনিরপেক্ষ সহজিয়া বাউল মনীষী হিসেবে আমরা আমাদের চেনা প্রয়োজন। যদি পারি, তবে সেই চেনা-জানা থেকে বোঝাপড়ার জায়গায় ভণ্ডামি ব্যতিরেকে, দেখানোপনা পোশাকি ফ্যাশন সর্বস্ব লালনপ্রীতি পরিত্যাগ করা সম্ভব হবে। যদি আমাদের কথা ও কাজে, সমাজ ও রাজনীতিতে, সঙ্কট ও সম্ভাবনায় লালন দর্শনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারি, তাহলে আজকে দুর্নীতিতে নিমজ্জমান রাজনীতি প্রশাসন, পঁচা-নর্দমাময় ভেঙে পড়া ভোগবাদী সমাজ রূপান্তর, ধর্মের নামে ভেদাভেদ, ব্যবসা আর দুইনম্বরি, সংস্কৃতির মোড়লদের কর্পোরেট ঠিকাদারি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব।

আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে ফরিদা পারভিনের কণ্ঠে লালন সঙ্গীত শুনে বঙ্গবন্ধু আপ্লুত হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, “এই লালনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে”। সেই বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয়ের মধ্যে কোনোরকম রাজনীতি বা বাকসর্বস্বতার প্রকাশ ছিল না। এটা ছিল জাতির পিতার ভেতরের তাগিদ এবং গভীর অভিনিবেশের প্রকাশ। এই বাঁচিয়ে রাখার অর্থ ছিল জনজীবনে মানুষের প্রয়োজন ও বাঙালির মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের তাগিদ থেকে।

বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের যে গানকে আজ থেকে সত্তর বছর আগে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ভেবে রেখেছিলেন, সেই গানের কথা রবীন্দ্রনাথ লালনের বাউল ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েই রচনা করেছিলেন। আর এর সুর তিনি পেয়েছিলেন লালনের গানের সুর করা মহান সুরকার গগন হরকরা থেকে। এখানেই মহামনীষীদের চিন্তার জায়গার যোগগসূত্রগুলো মিলে যায়। লালন-গগন হরকরা-রবীন্দ্রনাথ-বঙ্গবন্ধু বিশ্বচরাচরের বাঙালির এ এক চিরন্তন মানবিক অক্ষ।

এখন প্রশ্ন, বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা কি সেই অক্ষে আছে নাকি অক্ষ বা কক্ষচ্যুত হয়েছি? আমার প্রশ্ন আমি দিয়ে রাখলাম। যার যার মনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের নিজ নিজ উত্তর মিলিয়ে নিতে পারি। এর জন্যে আমাদের সংবিধান-আইন-আদালত-গণমাধ্যম কোনোকিছুই ঘাঁটাঘাঁটির দরকার পড়বে না।

এবার নজর বুলিয়ে নিতে পারি, লালনকে লালন বা ধারণ করার জন্যে, লালনের জীবনদর্শন আমাদের জনগোষ্ঠীর জীবনদর্শনের কোন জায়গায় দৃশ্যমান? লালন সঙ্গীত শুনলেই আর লালনের গানের সমঝদার আর বক্তৃতা বিবৃতিতে লালনকে উদ্ধৃত করলেই লালনকে ধারণ করা বোঝায় না। লালন দর্শন কারো ভেতরে থাকলে ঘুষ খাওয়া অত সহজ নয়, ধর্মীয় ভেদাভেদ কাজ করার কথা নয়। ফেইসবুকে ধোঁয়া তুলে বৌদ্ধ মন্দির বা হিন্দুদের পূজা মণ্ডপে হামলে পড়ার কারণ থাকতে পারে না। ধর্মীয় উন্মাদনা আর সম্পদ দখলের ভোগবাদী ভোজবাজি এতটা কুৎসিত রূপ নেবার কথা না।

কয়েক বছর আগে একজন নিম্নমানের ভাস্কর ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে লালনের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন। মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাপে এবং দাপটে কর্তৃপক্ষ ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এখানে বলে নিতে চাই, লালনের ভাস্কর্য নির্মাণ করলেই লালন প্রেমিক হয়ে যায় না কেউ।  আদতে এই ভাস্কর্যের পেছনেও নিদারুণ ধান্দাবাজি আর রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি কাজ করেছিল। কর্তৃপক্ষের সামনে অবারিত সুযোগ খোলা ছিল উন্মুক্ত ঘোষণার মাধ্যমে লালনের মানসম্মত ভাস্কর্য নির্মাণ করে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করার। এরকম পদক্ষেপ যুগোপযোগী দৃষ্টান্ত হতে পারতো। কর্তৃপক্ষ সেই দিকটায় অগ্রসর হয়নি। যাতে করে মৌলবাদী গোষ্ঠীই জয়যুক্ত হয়েছে। এই জয় যেমন দৃশ্যামান, তেমনি অদৃশ্যমান প্রশাসন ও সমাজের অন্তরে এবং অন্দরে। আমরা স্বীকার করি বা না করি, মাঠের বক্তৃতায় যতই অসাম্প্রদায়িক হাঁকডাক করুন, তাতে কাজের কাজ হচ্ছে না।

এরকম অবস্থায় লালন থাকলে তিনি কি করতেন? কিংবা বঙ্গবন্ধু সারাজীবন অহিংস রাজনীতির পথে থাকলেও সহিংসতার মুখে উনি কি বার্তা দিতেন, কিভাবে দিতেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমি একটা কথা বলে নিতে চাই। লালন এবং বঙ্গবন্ধু উভয়েই ছিলেন কথা ও কাজে বিশ্বাসী। উনাদের প্রকাশ ছিল সরাসরি রাখঢাক বা চালাকি থেকে মুক্ত। লালন যেমন ছিলেন কঠিন জীবনদর্শনের সহজিয়া পথের পথিক আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন কঠিন পথের সহজিয়া রাজনৈতিক নেতা। দেশের মানুষ সহজেই তার কথা ও কাজের ওপর ভরসা রাখতেন। লালনের পথও এমন ভরসার সন্ধান করে। 

 এখন লালন এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। একবার কুষ্টিয়ার ঠাকুর জমিদারেরা কাঙাল হরিনাথ সম্পাদিত ‘কৃষক বার্তা’ পত্রিকায় জমিদারদের প্রজা শোষণের খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে এর সম্পাদক হরিনাথকে শায়েস্তা করার জন্যে গুন্ডা ভাড়া করে এনে তার ওপর আক্রমণ করেছিল। লালন এই খবর পেয়ে তার নিজের দলবল নিয়ে গিয়ে জমিদারদের গুন্ডাদের পাকড়াও করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং কাঙাল হরিনাথকে বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন।

কথিত আছে, পাকিস্তান আমলে একবার ঢাকার ফুলবাড়িয়ার আওয়ামী লীগ অফিসে রাতের বেলায় হামলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাতের বেলায় দলীয় অফিসে ছুটে গিয়েছিলেন। এরপরের ঘটনা সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। সেখানে সহিংসতা মোকাবিলার মোক্ষম বার্তা তিনি দিয়েছিলেন ঠিক ঠিক। তাহলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যতটা পকেট ভরার পরহেজগার বক্তৃতা করি আদতে কিন্তু ততটা আমরা সঙ্গত সঙ্কট মোকাবিলার পথে হাঁটি না।

এই কুৎসিত সত্যের কুফল ভোগ আমাদের করতেই হবে, যেমনটা ভোগ করছে বার্মা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্য। মুক্তি আমাদের হতে পারে, যদি আমরা কফিনের শেষ পেরেক ঠোকার আগেই প্রাণের সন্ধান পেয়ে যাই। সেই সুযোগ আমরা কি পাবো? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্যও আমাদের আশ্রয় খুঁজতে হবে লালন আর বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনেই।

আমরা দিনের বেলায় ক্যামেরার সামনে নেতা হবার প্রক্রিয়ায় গলা ফাটিয়ে বলতে পারি, 'একাত্তুরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার'. কিন্তু রাতের অন্ধকারে যখন বৌদ্ধ পল্লীতে, আদিবাসী গ্রামে পাহাড়ে সমতলে, হিন্দু পূজা মণ্ডপে ধর্মীর স্লোগান ব্যবহার করে একদল দুশমন হামলে পড়ে, একটিবারের জন্যেও কোনো একটি জায়গায় কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে উঠলো না কেনো? একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে তোলার একজন মানুষও কেন বেড়িয়ে আসলো না? এই প্রশ্নের উত্তরও লালনের জীবনদর্শনেই পাওয়া যাবে।

লালন স্বদেশি সংস্কৃতির পক্ষেই বলে গেছেন। বলে গেছেন, বাড়ির কাছের আরশিনগরের খোঁজ করতে। এটি যেমন মনের খোঁজ তেমনি অন্য অর্থে নিজের ঠিকানা বা আত্মপরিচয়ের সন্ধানের কথাও বলেছেন।

সৃষ্টি রহস্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।   সেই রহস্য উপলদ্ধি কি আমরা করতে পারি? আমরা পশ্চিমা দর্শন পড়ব, পুবের দর্শন পড়ব, ইউরোপ আমেরিকাসহ সারাদুনিয়ার দর্শন নিয়ে পণ্ডিতি ফলাবো, রাজনীতি করবো, তত্ত্বের তাত্ত্বিক হবো বিদেশিয়ানা ফলাবো। কিন্তু আমাদের বাঙালির আত্মদর্শন কী? বাঙালির নিজস্ব দর্শন, আধুনিক দর্শন কী? এই প্রশ্নটা যদি করি উত্তরটা কী? আমাদের এতো কাঁচুমাঁচু ভাব জাগে কেন লালনের নাম নিতে? লালন বাঙালি বলে? লালন বাংলাদেশের বলে? লালন পণ্ডিতি বিদ্যায় সনদধারী নয় বলে?

আমরা পশ্চিমের অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের নাম নিবো। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ববাদী দার্শনিক কে বা কারা?

লালন ফকির। তারপর আরজ আলী মাতুব্বর। প্রশ্ন করার দর্শনটা লালনে বিদ্যমান। মানুষের নানা গোঁড়ামি আর ভণ্ডামিকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে গেছেন লালনের পথ ধরেই আরজ আলী মাতুব্বরও। বাঙালির প্রশ্ন করার ক্ষমতার শিক্ষাটা আমাদের লালন থেকেই শুরু।

বাঙালির নিপীড়িত মানুষের ধনিক জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধে যে লড়াই, সেই লড়াইয়ে লালন থেকেছেন, লড়েছেন। জীবনকে ছেনে ছেঁকে দেখেছেন, সেই দেখা থেকেই তার গান আর দর্শন ভিত্তি পেয়েছে। মৃতপ্রায় লালন ভেলায় ভেসে তীরে ভিড়েছেন, সেই তীরে এক মায়ের আশ্রয় পেয়েছেন। এই মা মুসলমান হলেও লালনের কাছে তো চিরন্তন মানুষ মা, যেমন তার জন্মদাত্রী মা যিনি ধর্মে ছিলেন হিন্দু। লালনের একদিকে হিন্দু মা, অন্যদিকে মুসলমান মা।  এইভাবে লালন হয়ে উঠেছেন ধর্মের ভেদাভেদ বাতিল করা এক মনের মানুষ, মানুষ ‘মানুষ’।

লালন ঢাকা দিল্লি লাহোর করার আগে ঘরের খবর নিতে বলেছেন। সেই দর্শন আমাদের রাজনীতি সমাজনীতি আর খাসলতে থাকলে সুইস ব্যাংকে বাঙালির টাকা জমা হতো না, কানাডায় বাঙালির বেগমপাড়া গড়ে তুলতে হতো না, চুরি করে চুরির টাকায় হজ করে হাজি হবার দরকার পড়তো না। বাঙালিকে জোচ্চোরির পথ বেছে নিতে হতো না। গোটা জীবনে কথা ও কাজে লালন জুলুমবাজির বিরুদ্ধে সায় দিয়েছেন। তার গোটা জীবনদর্শনে তিনি সাম্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বৈষম্য বা বঞ্চনার বিরুদ্ধে তার ছিল আজীবন যুদ্ধ।

সম্পদ বণ্টনেও তার মৃত্যুর পূর্বে তার অর্জিত সব সম্পদ সমান ভাগ করে দিয়ে গেছেন তার পালিত কন্যা, সারাক্ষণের সঙ্গী শিষ্য, তার স্ত্রী বা সাধন সঙ্গীর মাঝে। উত্তরাধিকার ব্যবস্থাপনার এতো সুন্দর ও মানবিক দৃষ্টান্ত আমাদের উত্তরাধিকার আইনে আমরা এখনো প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আমাদের উত্তরাধিকার আইনে রয়ে গেছে নানা গোঁজামিল। এখনও মেয়েদের উত্তরাধিকারের বিরুদ্ধে মোল্লাদের মিছিল মিটিং এই ভূবঙ্গে আমরা তো মেনে নিতে অভ্যস্ত।

আজকে আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যে সঙ্কট তা কাঙাল হরিনাথ আর লালনের সময়ে কোনো অংশেই কম ছিল না। তারা মানুষের কল্যাণকে লক্ষ্যে রেখে টিকে থাকার, লড়াই করে যাওয়ার কৌশল ঠিক করেছেন। এখনকার সম্পাদকরা, এখনকার আঁতেলদের লক্ষ্য কি সেটাই তো খোলাসা করার সাহস দেখাতে পারবে না। আমাদের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের আত্মপ্রকাশ ’জন্মই যেন আজন্ম পাপ’, অবৈধ টাকার গর্ভজাত পত্রিকা বা চুঙা চ্যানেল কাঙাল হরিনাথ বা ’লালন দর্শনে’র তল খুঁজে পাবে কেমনে?

‘লালন দর্শন’কে দুনিয়ার ছোট ছোট 'জীবন-ধর্মে'র একটি মনে করা হয়ে থাকে। সেই লালনের জীবন, দর্শন আর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে দারুণ আগ্রহ দুনিয়ার অন্য প্রান্তের মানুষদেরও। আমাদের সংস্কৃতি, জ্ঞান ও দর্শনের আন্তর্জাতিকীকরণের উপায়গুলো কী? এরকম একটা সাদামাটা প্রশ্ন যদি করি, তার উত্তর কী?

মৌলিক দর্শন বিবেচনায় লালন অগ্রগণ্য। সেই বিবেচনায় লালনকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার জন্যে আমরা কি কোনো জাতীয় উদ্যোগ নিতে পেরেছি? ফরিদা পারভিনের সুবাদে আর বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই-একজন গবেষক অধ্যাপকের কারণে লালনকে কিছুটা তুলে ধরা বা পরিচিত করানো হয়েছে। কিন্তু তাতেই কি যথেষ্ঠ?

লালনের মতো আমাদের একজন মনীষী রয়েছেন, দার্শনিক রয়েছেন- তাই যেন ইউরোপ-আফ্রিকার মানুষের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। লালন সম্পর্কে জেনে তাদের আগ্রহ বাড়তেই থাকে। এরকম ঘটনা ঘটেছে, ঘটে চলেছে। যা ফরিদা পারভিনের আলাপচারিতা থেকে আমরা কিছুটা জানতে পারি। জানতে পারি বিদেশি পণ্ডিতি মহলে কিছু গবেষণার আলোকেও।

সম্প্রতি সুইডিশ কর্তৃপক্ষ ২০২৩ সালে আন্ত-মহাদেশীয় পর্যায়ে লালন নিয়ে কাজ করার জন্যে একটি উদ্যোগে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। যার কৃতিত্ব এই প্রজন্মের আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় পরিচিত সুইডিশ কবি ক্রিস্টিয়ান কার্লসনের। যিনি ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথ, শামসুর রাহমানসহ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বেশকিছু কবিকে অনুবাদের মাধ্যমে সুইডিশ ভাষাসাহিত্যের জগতে তুলে ধরেছেন।

এরকম একটি প্রেক্ষাপটে অক্টোবর মাসের ৫ তারিখে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে ঢাকার টি থিয়েটার, নাগরিক নাট্যাঙ্গন বাংলাদেশ, সুইডেনের উপলিট থিয়েটার, নেপালের ওয়ান ওয়ার্ল্ড থিয়েটার আর কেনিয়ার কিস্ট্রেক থিয়েটারের যৌথ উদ্যোগে 'লালন' নাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে এই উদ্যোগে যারা সম্পৃক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে টি-থিয়েটারের কবি দিলদার হোসেন, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের হৃদি হক, কামরুজ্জামান রনি, জুয়েল জহুর, আসমা দেবযানী, লিটন হাসান এবং মধুয়াই সংস্কৃতি উদ্যোগের মোশাররফ হোসেন টুটুল অন্যতম।

বিশ্বের দরবারে নিজেদের তুলে ধরবার, আমাদের আত্মমর্যাদার ডালায় মেলে ধরবার জন্যে যা কিছু আছে তার মধ্যে লালন আমাদের অতি আবশ্যক। এই সত্যটা বাঙালির রাজনৈতিক দর্শন, শিক্ষাদর্শন, সমাজ দর্শন, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এমনকি পরিবেশ বিজ্ঞান বা  প্রকৃতিবাদী জীবনব্যবস্থার নিয়ামক বিধান বা দিকনির্দেশনা লালনে বিরাজমান। তা কেবল লালনকে লালন ও ধারণেই সম্ভব।

শতাধিক সদস্য নিয়ে ঠিকাদার, বিশ্ববিদ্যালয়ের  মাস্টার আর মোড়লদের প্রাধান্য দিয়ে মোড়লিয়ানা টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে সংস্কৃতির জাতীয় পর্যায়ে বিশাল কমিটি করে নিজেদের জাহির হয় তো করা যায় বা যাবে। কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হবে না। কেননা গত প্রায় চার দশকে এসব মাস্টার আর মোড়লরা কেবল ফ্যাশন আর ব্যবসা করে গেছেন। লালনের আলো থেকে, বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ থেকে তাদের আত্মা খারিজ হয়ে গেছে। মুখে মুখে তাদের মধুর প্রলাপ অন্তরে তাদের টাকা পদ-পদবি আর বাহবা চাই।  যা লালন ও বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন থেকে বহুদূরে।

'লালনগীতি' বলে লালনের গান গীত করে আমরা লালনকে গীতিকার হিসেবেই দেখে বা দেখিয়ে দায় সারি। আদতে কি লালন দর্শন নিয়ে, লালনের জীবনের শিক্ষা নিয়ে আমাদের বিদ্যায়তনে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় লালনের জীবনদর্শনের বা তার বহুবিধ চিন্তার কোনো আলো আমাদের স্কুলের কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের মাঝে ঢোকানোর কোনো উদ্যোগ বা উপায় দৃশ্যমান আছে? তাহলে?

তেড়েমেড়ে মাঠে বক্তৃতা করে চিল্লাবো- ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবো’!  ব্যাপারটা কি ছেলের হাতের মোয়ার মতো এতো সহজ? এর উপায় ‘লালন দর্শনে’ বিদ্যমান। যা বঙ্গবন্ধু দেখতে পেরেছিলেন। দেখতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

আমাদের রাজনীতি হবে, সেইসঙ্গে অন্য অনেক নীতিও থাকবে। তবে সেইসব নীতিতে লালনকে উপেক্ষা করলে আমরা আর আমরা থাকি না। আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রয়োজনে, আমাদের অস্তিত্বের নিশানায় লালনের বড় প্রয়োজন। তা যেমন বিশ্বপরিসরে নিজস্ব দর্শনের নজির হিসেবে লালন আসবেন, তেমনি আমাদের একান্ত মানবিক, আমাদের 'বাঙালি মানবদর্শন' এর নিরিখে লালনেই আমাদের মুক্তি। লালন আমাদের বড় বেশি প্রয়োজন।