একটি দেশ যখন বাস-অযোগ্য হতে শুরু করে, সুশাসনের অভাব কিংবা অন্য কোনো কারণে, সেটা সবচেয়ে আগে টের পায় নারী, শিশু এবং সংখ্যালঘুরা।
Published : 21 Mar 2023, 12:08 PM
ভূমিকম্প হলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী, যেমন পিঁপড়া, মৌমাছি ইত্যাদি নাকি আগেভাগে টের পেয়ে যায়। জাহাজ ডুবতে শুরু করলে ইঁদুরগুলো নাকি আগে জলে লাফিয়ে পড়ে। একটি দেশ যখন বাস-অযোগ্য হতে শুরু করে, সুশাসনের অভাব কিংবা অন্য কোনো কারণে, সেটা সবচেয়ে আগে টের পায় নারী, শিশু এবং সংখ্যালঘুরা।
বিখ্যাত আলুর মড়কের (১৮৪৮-১৮৫২) পর আয়ারল্যান্ডের লোকজন অভিবাসী হয়েছিল আমেরিকা-কানাডায়। ‘ম্যাক’ দিয়ে শুরু যত নাম দেখবেন এখানে, ম্যাকডোনাল্ড, ম্যাকগিল...সব আইরিশ। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর একাংশ পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে পঞ্চাশের দশক থেকে। শুনেছি ইসমাইলী, আহমদীয়া, বোম্বাইয়া ইত্যাদি মুসলমান সম্প্রদায়ও দেশত্যাগ করেছে। আশির দশকেও আমি চট্টগ্রামে বোম্বাইয়া দোকানে চানাচুর-বিস্কিট কিনেছি। ঢাকা-চট্টগ্রামে বড় বড় ডাইং-ক্লিনিং, চীনা রেস্তোঁরা চালাত চীনারা, কোথায় তারা এখন? না, সবাই মরে যায়নি, দেশ ছেড়ে গেছে। বাংলাভাষী ঢাকাইয়া চীনাদের সঙ্গে বিদেশে আমার দেখা হয়েছে। গারো, চাকমা ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীদের বড় বড় পাড়া গঠিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া-কানাডা এবং অন্যত্র।
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে কিছু দিন আগে পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের এই বলে দোষ দেওয়া হতো, তারা এ পারে থেকে-খেয়ে ওপারের স্বপ্ন দেখে। তারা ইন্ডিয়ায় টাকা পাঠায়, ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যায় ইত্যাদি। কানাডার বেগমপাড়া এসে সংখ্যালঘুর এই দুর্নাম চিরতরে ঘুচিয়ে দিয়েছে। গত কয়েক মাস থেকে বেগমপাড়ার খ্যাতিসূর্যও অস্তায়মান, কারণ ইতিমধ্যে আমেরিকা-ইংল্যান্ডে ‘মাইট্টা সাহেবপাড়া’, দুবাইয়ে ‘আতরাফ শেখপাড়া’ আবিষ্কৃত হয়েছে। এনারা একেকজন এক দিনে যে টাকা পাচার করেন, হাজার সংখ্যালঘু দশ বছরেও তা করতে পারেনি। পানামা পেপার্স, অফ শোর অ্যাকাউন্টস সবইতো অর্থপাচারের রকমফের।
কোনো দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থপাচারে কী হয়? অর্থই বা আসলে কী? অর্থ হচ্ছে পণ্য বা সেবা বিনিময়ের মাধ্যম। সুতরাং অর্থ পাচার হচ্ছে মানে একটি দেশের এক বা একাধিক প্রজন্মের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা পাচার হচ্ছে। অর্থপাচার হলে দেশ রসাতলে যায় না, তবে টেকসই উন্নতির দিকে না গিয়ে দেশ ও সমাজ বেশ কিছু সময়ের জন্য স্থবির হয়ে পড়ে, কারণ যে অর্থ বিনিয়োগ হয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারত, সেটা হয় না। ‘ধন গোময়ের মতো, ছড়িয়ে দিলে সার হয়ে ফসল ফলায়। এক জায়গায় জমা হয়ে থাকলে গন্ধ ছড়ায়।’ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না হওয়ার কারণে আরও অনেক দিন দেশের লোকজন বিদেশে গিয়ে দাসত্ব করতে হয়। দাসত্ব করে পেটেভাতে টিকে থাকা যায়, দাসত্ব দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়, কারণ দাসমাত্রকেই ঠকানো হয়। যে কোনো দাস-জাতির একাধিক প্রজন্মের সময় ও পরিশ্রম নষ্ট হয়। মাসে শ দেড়েক ডলার বেতন দিয়ে, একটি কক্ষে অনেক শ্রমিককে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করে, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মূলত ঠকানো হচ্ছে।
‘ছোট বালুকার কণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।’ লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সেই দেড়শ ডলারের কিছু অংশ দেশে এসে পুঁজি গঠিত হয়। কিন্তু নবগঠিত পুঁজি মনে করে, স্বদেশে তার না আছে কদর, না আছে নিরাপত্তা। সুতরাং সঙ্গত কারণেই সে ভাবে: ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনো খানে!’ তবে টাকা পাচার যে খুব নিরাপদ তা কিন্তু নয়। টাকা যেখানে পাচার হচ্ছে, সেখানকার অর্থনীতিতেও পাচার করা টাকা সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমন ধরুন, কানাডার বাড়ির বাজার অস্থির করে রেখেছে তৃতীয় বিশ্বের টাকা পাচারকারী ক্রেতারা। যে কোনো পরিমাণ টাকা দিয়ে তারা বাড়ি কিনতে রাজি। ফলে বাড়ির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
ভুলক্রমে বা স্বেচ্ছায় পৃথিবীর যে কোনো দেশের সরকার এমন দুই ক্ষেত্রে ক্রমাগত ভুল করে চলে যে দুই ক্ষেত্রে তার ভুল করার কথা নয়। ক্ষেত্র দুটি হচ্ছে: ১. রাজনীতি আর ২. অর্থনীতি। কানাডা সরকার নিয়ম করেছে, বিদেশিরা তিন বছর কানাডায় না থাকলে বাড়ি কিনতে পারবে না। অন্যের নামে, যেমন ধরুন শালা বা ভাইয়ের নামে বাড়ি কিনলে কীভাবে বাধা দেওয়া যাবে? আমার গ্রামের চেয়ারম্যানও নাকি কানাডায় বেনামীতে বাড়ি কিনেছেন। আমার এলাকার সংসদ সদস্যদের নাকি আমেরিকায় এত বাড়ি আছে যে গুনে শেষ করা যাবে না। যদিও এসব শোনা কথা, হয়তো গুজব, তবুও যা রটে, তার কিছুটাতো বটে। কানাডা সরকার একবারও চিন্তা করছে না, বাড়ির দাম বাড়ছে কেন। সরকার ঋণের ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষ যাতে লোকজন বাড়ি কিনতে ব্যাংক থেকে ঋণ না নেয়। সরকার ইচ্ছামতো টাকা ছাপিয়ে আগেই মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করেছিল। সরকারের মূল উদ্দেশ্য এম-থ্রির পরিমাণ কমানো। কিন্তু সরকার এটা ভাবছে না, সব কিছুর দাম যখন আকাশছোঁয়া, বাড়ির দামই বা কম হবে কেন?
বাড়ি যারা ইতোমধ্যে কিনেছে, তাদের মাসে মাসে বেশি টাকা সুদ গুনতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে ভোগের ওপর। পকেটে টাকা কম থাকায় সাধারণ মানুষের ভোগ কমে যাচ্ছে। ভোগ কমার প্রভাব পণ্যের দামের ওপর অবশ্যই পড়ে। সুদ বাড়ার ফলে মানুষ ঋণ নিয়ে বাড়ি কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় বাড়ির দামও কমছে। এতেও সমস্যা আছে। বাড়ির দাম যদি কোনো কারণে অনেক কমে যায়, যে রকম হয়েছে ২০০৭ সালে, তখন বাড়ি যারা কিনেছে, তাদের মাথায় হাত। যে টাকা পাচার করে বাড়ি কেনা হয়েছে, সে টাকার সিংহভাগ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
তাওতো কানাডা বা মালয়েশিয়ার বাড়িগুলো অন্তত টিকবে। নাসার প্রতিবেদন অনুসারে দুবাইয়ের বেলাভূমি প্রতি বছর ইঞ্চিখানেক করে দেবে যাচ্ছে। এদিকে উষ্ণায়নের কারণে উচ্চতর হচ্ছে সমুদ্রস্তর। ডুবতে ডুবতে নিজের নাম সার্থক করছে ‘ডুবাই’। দুবাইয়ের সব বাড়ি আগেপরে ডুববে, সেই সাথে ডুববে পাচারের টাকা। দূর সমুদ্র থেকে বালি তুলে নিকট সমুদ্র ভরাট করে খেজুর পাতা আকৃতির কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে তার উপর যে ভবনগুলো তোলা হয়েছে দুবাইতে, তাতেই নাকি সব অ্যাপার্টমেন্ট কিনছে বাংলাদেশী পাচারকারীরা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশের শ্রমিকদের পাঠানো টাকা দুবাইয়ে পাচার হয়ে কেনা হচ্ছে এমন সব অ্যাপার্টমেন্ট যেগুলো আগে পরে আক্ষরিক অর্থে জলে যাবে।
মেধাপাচার মানে শ্রমপাচারও বটে। দেশত্যাগ ও মেধা পাচার রোধ করা কি সম্ভব? সোজা উত্তর হচ্ছে: ‘না’। প্রাণ মেধা ও পুঁজি সেখানেই যেতে চাইবে, যেখানে সে নিরাপদ। বিদেশে অর্থ পাঠানো কি বন্ধ করা যাবে? উত্তর হচ্ছে ‘না’। আজকাল মানি ট্রান্সফারের আন্তর্জাতিক কোম্পানি হয়েছে। আমেরিকার অফিসে ডলার জমা দেবেন, বাংলাদেশের অফিস থেকে টাকা পাবেন। সরকার চলবে ডালে ডালে, পাচারকারীরা চলবে পাতায় পাতায়। তাছাড়া পাচারের কাজে সরকারি লোকও জড়িত, পাচারকারী বা পাচারে সহায়তাকারী হিসেবে। টাকা পাচারের হাজার এক উপায় আছে। আপনি একটা বন্ধ করবেন, হাজারটা খুলে যাবে। অর্থপাচার বন্ধ করার চেষ্টা অনেকটা পর্নোসাইট বন্ধ করে জনগণকে চরিত্রবান করার ব্যর্থ চেষ্টার মতো। জল, জন, জান আর মাল কখনই আটকে রাখা যায় না।
আজকের পাশ্চাত্যের যে এত রমরমা, তার অনেকটুকু উপনিবেশগুলোকে শোষণ করেই হয়েছে। শোষণ আজও চলমান, কমপক্ষে দুই ভাবে: প্রথমত, স্বাধীন উপনিবেশের লোকজন নিজেদের দেশের টাকা নিজেরাই পাচার করছে মেট্রোপলে, ফলে উপনিবেশককে খামাখা শোষণ করার দুর্নাম কুড়াতে হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, উপনিবেশিতদের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল করে দেওয়া গেছে যে উপনিবেশের শিক্ষা কোনো কাজের নয়, মেট্রোপলের শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। সুতরাং উপনিবেশ থেকে শিক্ষার্থীরা দলে দলে গুচ্ছের ডলার খরচ করে শিক্ষা কিনতে আসছে মেট্রোপলে। এতেও বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর একেকটি পদ্মাসেতুর টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।
চালুনিতে জল ধরে রাখা যায় না। ডেকচিতে জল ধরে রাখা যায় বটে, কিন্তু তলায় ফুটো থাকা চলবে না। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ডেকচিতে বেশ বড়সড় দুটি ফুটো আছে, যার একটি হচ্ছে ‘অবিচার’ আর অন্যটি ‘দুঃশাসন’। যতক্ষণ এই দুই ফুটো বন্ধ না হবে, ততক্ষণ মেধা ও পুঁজি পাচার বন্ধ হবে না। দেশের আইন-শৃঙ্খলা উন্নত হয়ে ন্যায়বিচার যতদিন প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে, ততদিন পুঁজি কিংবা শ্রমিক, কেউই জমি কামড়ে পড়ে থাকবে না।
জীবন একটা প্রতিযোগিতা, দুই ব্যক্তির মধ্যে যেমন, তেমনি দুই দেশ বা সমাজের মধ্যেও। বাংলাদেশের টাকা ও মেধা যদি পাচার হয়ে যায়, তবে বাংলাদেশ দিনকে দিন দুর্বল হতে থাকবে, পাশ্চাত্য কিংবা প্রতিযোগী জাতিগুলো উত্তরোত্তর সবল হতে থাকবে। পাশ্চাত্যের সঙ্গে যুদ্ধে বাংলাদেশ হেরে আছে গত দুই তিন শতকে বাঙালির পূর্বপুরুষের অবিমৃষ্যকারিতা কিংবা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে। আজও যদি সুশাসন এবং সুবিচার নিশ্চিত করে মেধা ও সম্পদ পাচার রোধ করা না যায়, তবে আমাদের উত্তর পুরুষও একটি পরাজিত জাতি হয়েই বেঁচে থাকবে। পরাজিত মানেই দাস, কী অতীতে, কী বর্তমানে।