আমার ইদানীং মনে হয়, সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে কোথাও বুঝি খামতি আছে। মাঝে মাঝে দুই একজন চোর-বাটপার ধরা পড়লেও কারোই বিচার হওয়ার নজির নেই।
Published : 23 Aug 2023, 12:18 AM
ঘটনাটি আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে শোনা। আমাদের দেশে একটি কাজ পাওয়ার জন্য চীনা এক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে আলোচনা শেষে তাকে একটি সুন্দর চায়ের প্যাকেট গিফট করলেন। সচিব সাহেব ওই চায়ের প্যাকেট বাসায় নিয়ে স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, চীনের চা, নিশ্চয়ই উপাদেয় হবে। এখনই এক কাপ গরম চা মুখে দিয়ে সারাদিনের অফিসের ক্লান্তি দূর করি।
সচিব-পত্নী চা বানাতে গিয়ে প্যাকেট খুলে তো তাজ্জব। দ্রুত স্বামীর কাছে ফিরে এসে বলেন, আরে, এই চায়ের প্যাকেটে চা কেথায়? এখানে তো দেখছি সুন্দর মোড়কে ডলার। অবাক সচিব মহোদয়ও। গুণে দেখেন ১ লাখ ডলার। এটা যে ঘুষ দিয়ে কাজ পাওয়ার চেষ্টা তা বুঝতে তাঁর কষ্ট হয়নি। তিনি ওই প্যাকেট আর নিজের কাছে না রেখে মন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে দেশে দুর্নীতি হয়, সরকারি বিভিন্ন পদের বড় বড় কর্মকর্তা এমনকি মন্ত্রীরাও দুর্নীতি করেন—এটা বোঝানোর জন্য। তবে দুর্নীতি কেউ বলে-কয়ে কিংবা সবাইকে জানিয়ে করেন না। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর আমাদের স্বাস্থ্যখাতের কিছু দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ হয়েছিল এবং বড় রকমের জালিয়াতির অভিযোগে দু-চারজন গ্রেপ্তারও হয়েছিল। এমন খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনস্ত বিভিন্ন কার্যালয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ, স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে দুর্নীতির শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে, যারা সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, সরঞ্জাম এবং যন্ত্রপাতি কেনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে স্বাস্থ্যখাতে জনসাধারণের জন্য বরাদ্দ সরকারি বাজেটের ৭০-৮০ ভাগই হাতিয়ে নিচ্ছে।
গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে কিছু নড়াচড়া হয় কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এতে দুর্নীতি বন্ধ হয়। সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বা চুরি বন্ধ করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ দু-একজনকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলেও আজ পর্যন্ত কারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে, তা বলা যাবে না। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় কয়েকজনের বাসাবাড়িতে যে বস্তা বস্তা টাকা পাওয়া গেল, ওই টাকা শেষে কোথায় গিয়েছে, কোন কাজে ব্যবহার হয়েছে, তার কোনো খবর কিন্তু কোনো গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়নি। সরকারি লোকজনের দুর্নীতির কথা সরকার স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু অল্প কয়েকজনের চুরির দায় কিন্তু শেষপর্যন্ত গোটা সরকারের ওপরই বর্তায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের ধরে যেন আমরাই চোর হয়ে যাচ্ছি।’ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযানে যদি ধারাবাহিকতা থাকে এবং মানুষের কাছে যদি এটা বিশ্বাসযোগ্য হয় যে, সরকারের কোনো পর্যায় থেকেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না, তাহলেই কেবল মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতা হলো, সরকারে থাকলে দুর্নীতি করতেই হয়—যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। শেখ হাসিনা অবশ্য অনেক কিছুতেই ব্যতিক্রম। সরকারে থেকে সরকারি লোকদের চোর হিসেবে চিহ্নিত করার বুকের পাটা শেখ হাসিনার পক্ষেই দেখানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণ দুর্নীতি বা চুরি হয় গৃহীত ব্যবস্থা সেই তুলনায় অপর্যাপ্ত বলেই মনে করা হয়।
আমাদের দেশে একটি কথা চালু আছে—মানুষের কথায় জয়, মানুষের কথায়ই ক্ষয়। এখন পর্যন্ত দেশের বেশিরভাগ মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, এই দেশকে যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই, তিনিই আমাদের শেষ ভরসা।
এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম যে, শেখ হাসিনা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যেভাবে নিরলসভাবে কাজ করছেন, সেভাবে তিনি প্রশংসিত হচ্ছেন না। বিশেষ করে বিএনপি ও তার মিত্ররা তো সারাক্ষণ শেখ হাসিনারও নিন্দা-সমালোচনা করছে। শেখ হাসিনার কোনো ভালোই তাদের চোখে পড়ে না। এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি দুঃখজনক। কেন এটা ঘটছে?
ব্যক্তিগতভাবে আমার ইদানীং মনে হয়, সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে কোথাও বুঝি খামতি বা ঘাটতি আছে। মাঝে মাঝে দুই একজন চোর-বাটপার ধরা পড়লেও কারোই বিচার হওয়ার নজির নেই। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটার দলকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও হয়তো দেখা যায়।
বিএনপি-জামায়াত আমলে দেশে জঙ্গি উত্থানের ঘটনা ঘটেছিল। আবার ওই আমলেই বাংলাভাইসহ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিচারও শুরু হয়েছিল। কিন্তু এজন্য কী আমরা বিএনপি বা খালেদা জিয়ার ভূমিকাকে জঙ্গিবিরোধী বলে তারিফ করি?
করি না। কারণ ওটা ছিল রাজনৈতিক কৌশল, আন্তর্জাতিক চাপ এবং ক্ষমতায় থাকার হিসাব-নিকাশ।
এ সরকারের আমলে দুর্নীতিবাজ বা চোরদের কেউ কেউ ধরা পড়ছে। কিন্তু বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কয়জনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে?
যারা ফেঁসে যায় তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই ফাঁসে। তার মানে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। তো, এই তথ্য থাকার পরও চোরদের বছরের পর বছর চুরি করার সুযোগ দেওয়া হয় কেন?
আমি বারবার বলি, আওয়ামী লীগের অনেক সঞ্চয় আছে। কিন্তু সেই সঞ্চয়ের যেভাবে অপচয় হচ্ছে, তাতে দেউলিয়া হতেও বেশি সময় লাগবে না।
মানুষের কাছে অসঙ্গতিগুলো যখন ধরা পড়ে তখন তারা হতাশ হয়, প্রশংসার পরিবর্তে তখন নিন্দা করে অথবা যারা নিন্দা করে তাদের ‘সহমত’ ভাই-বোন হয়ে যায়!
কেউ যখন ‘ধরা খায়’ তখন তার গুষ্ঠি উদ্ধার করে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা শুরু হয়। ধরা না-খাওয়া কারও বিরুদ্ধে খবর সাধরণত দেখা যায় না। কোনো গণমাধ্যমে তেমন খবর ছাপা হলেও তা আমলে নেওয়া হয় না। শত্রুপক্ষের রটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, সরকার বা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এসব মহলবিশেষের ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখন অনেকের কাছেই হাস্যকর মনে হয়।
বিপদ তাঁদের, যাঁরা শেখ হাসিনাকে ‘শেষ ভরসা’ বলে মনে করেন। এমন সব ঘটনা ঘটে বা ঘটানো হয়, যার পক্ষে দাঁড়ানো হাসিনাদরদীদের পক্ষেও নৈতিকভাবে সম্ভব হয় না।
সেজন্যই দরকার সরকারি প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে ধারাবাহিক শুদ্ধি অভিযান। যেখানে রোগমুক্তির জন্য শল্য চিকিৎসা দরকার, সেখানে টোটকা চিকিৎসা করলে উপকার পাওয়া যাবে কীভাবে?
বলা হয় ‘সিস্টেম’ বদল করা সহজ নয়। তাই ‘সমঝোতা’ করেই চলতে হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সমঝোতার পথ আত্মঘাতী। আলেন্দে বাঁচেননি, ক্যাস্ট্রো বেঁচেছেন।
মৌচাকে ঢিল দিয়ে মৌমাছির কামড় সহ্য করলেই না মধু পাওয়া যায়। যাঁরা দেশপ্রেম থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে কথা বলার চেষ্টা করেন, তাঁদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু অতি অনুগতরা বিপদের দিনে লাপাত্তা হলেও যাঁদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় তাঁরা বিপদের মুহূর্তেও ঠিকই পাশে থাকবে। খারাপ সময়ে কাছে পাওয়া যাবে না ‘চাটার দল’কে। তাই চাটার দল হতে সময় থাকতেই সাবধান হওয়া জরুরি!
আমাদের আর একটি সমস্যা হলো, কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার পর সেটা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও চরম অনীহা। সমস্যা নিয়ে বসবাস করতে ভালো লাগে। সমাধান হলে যেন হাতে করার মতো আর কাজ থাকবে না। অলস হওয়ার ভয়ে আমরা সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হই না, নাকি নিশ্চেষ্ট থাকাই আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে থাকা স্বভাব?
আমাদের সব কিছুতে দায়সারা ভাবের একটা বড় কারণ হয়তো এই যে, আমরা আসলে আন্তরিকভাবে বড় কোনো পরিবর্তন চাই না। স্থায়ী সমাধানের কথা না ভেবে আমরা জোড়াতালি দিতে বেশি অভ্যস্ত। এতে সম্ভবত লাভ বেশি। যতবার জোড়াতালি ততবার দায়িত্বপ্রাপ্তদের পকেট ভারি হওয়ার সুযোগ থাকে। সেজন্য ঘরের ময়লা-আবর্জনা ঝেড়েমুছে সাফ করে বাইরে না ফেলে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে রাখতে ভালোবাসি। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী প্রশাসন দিয়ে স্বাধীন দেশের শাসন ব্যবস্থা চালিয়ে নিয়েছি। যে ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের জন্য ‘সার্ভিস’ দিয়েছেন, তিনি ১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের খেদমতগার হয়ে গেলেন। তার কাছ থেকে সাধারণ মানুষ কী খেদমত পাবেন—তা বুঝতে কী খুব কষ্ট হওয়ার কথা?
আমরা মানুষের মন না রাঙিয়ে বসন রাঙাতে চেয়েছি, আমরা সব কিছু বাইরে থেকে চাকচিক্যময় করে তুলতে গিয়ে ভেতরের অন্ধকার আড়াল করেছি। আজ তাই, যেদিকে তাকাই সেদিকেই অন্ধকার দেখতে পাই। করোনাকালে দেখলাম স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা। এখন দেখছি শিক্ষার দৈন্য অবস্থা। আমরা ব্যয় করিনি তা নয়। ঋণ করে ঘি খাওয়ার অভ্যাস আমাদের আছে। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়িয়েছি। কাগজে-কলমে বাড়িয়েছি শিক্ষিতের হার। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়িয়ে আমরা আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ কমিয়ে ফেলেছি।
দলবাজি করতে গিয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নোংরা রাজনীতি করতে গিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের মাথা নষ্ট করে দিয়েছি। তাদের কানে মানুষ হওয়ার মন্ত্রণা না দিয়ে কুপথে চলার কুপরামর্শ দিয়েছি। এখন আর শিক্ষক ছাত্রকে শাসন করতে সাহস পান না, উল্টো ছাত্র শিক্ষককে শাসন করে। শিক্ষক ছাত্রের গায়ে বেত মারলে আমরা যতটা হইচই করি, ছাত্র শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেললেও আমাদের চৈতন্য ফিরতে সময় লাগে। শিক্ষকের গলায় কিছু উদ্ভ্রান্ত ছাত্র ও অভিভাবক জুতার মালা পরিয়ে উপহাস করে আর আমাদের শান্তিরক্ষী পুলিশ দল সেই দুর্বৃত্তদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন করে। কি অপূর্ব আমাদের কর্তব্যবোধ। একজন সজ্জন মানুষের বিরুদ্ধে কিছু বদমাশ একটি অভিযোগ তুললেই তার সত্যাসত্য যাচাই না করে ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করা যে ঘোরতর অন্যায় এই বোধটুকুও আমাদের অনেকে হারিয়ে বসেছি।